ট্রাম্পের নীতি বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে
যুক্তরাষ্ট্রের নবনির্বাচিত প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের রক্ষণশীল ও বাণিজ্য নীতি বাংলাদেশের ব্যবসায়ীদের জন্য নতুন সুযোগ সৃষ্টি করতে পারে বলে মনে করছেন অর্থনীতিবিদ ও রপ্তানিকারকরা। নতুন বাণিজ্য নীতিতে, প্রতিপক্ষ চীনের প্রতি ট্রাম্পের কঠোর অবস্থানের কারণে অনেক রপ্তানি আদেশ বাংলাদেশে স্থানান্তরিত হতে পারে বলে আশাবাদী হয়ে উঠছেন তারা।
পোশাক রপ্তানিকারকরা আশা প্রকাশ করছেন, বৈশ্বিক পোশাক বাজারে বাংলাদেশের অন্যতম প্রধান প্রতিদ্বন্দ্বী চীনের ব্যাপারে যুক্তরাষ্ট্রের বাণিজ্যনীতি দেশের পোশাক শিল্পের জন্য আগামী বছরগুলোতে গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠতে পারে। যুক্তরাষ্ট্র বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানির বৃহত্তম একক রপ্তানি বাজার হওয়ায় দেশটির নীতি পরিবর্তন হলে বাংলাদেশ বিশেষ সুবিধা পেতে পারে।
বাংলাদেশের তৈরি পোশাক খাতের রপ্তানিকারকরা বলছেন, চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের ওপর চড়া শুল্ক আরোপের পরিকল্পনা রয়েছে রিপাবলিকান ট্রাম্পের প্রশাসনের। টাম্পের এই সিদ্ধান্তের ফলে বাংলাদেশের পোশাক রপ্তানি বাড়তে পারে। ব্যবসাবান্ধব হিসেবে সুপরিচিত ট্রাম্প আন্তর্জাতিক সঙ্ঘাত-সংঘর্ষে জড়াতে অনীহার কথাও বলেছেন, যা বৃহত্তর বৈশ্বিক স্থিতিশীলতা ও অনুকূল ব্যবসায়িক পরিবেশ সৃষ্টি করতে পারে।
অর্থনীতিবিদ ও ব্যবসায়ীরা আশা প্রকাশ করেছেন যে ট্রাম্পের প্রশাসনের অধীনে সারাবিশ্বে বিভিন্ন সংঘর্ষে মার্কিন সামরিক সম্পৃক্ততা কমতে পারে। এর জেরে বিভিন্ন সংঘাত-সংঘর্ষে বিগত কয়েক বছর ধরে অস্থির হয়ে থাকা বিশ্বে স্থিতিশীলতা ফিরতে পারে, যা বিশ্বজুড়ে ব্যবসাবান্ধব পরিবেশ তৈরি করতে পারে।
এনভয় টেক্সটাইলসের প্রতিষ্ঠাতা কুতুবউদ্দিন আহমেদ বলেন, মার্কিন প্রেসিডেন্ট নির্বাচিত হওয়া ডোনাল্ড ট্রাম্প মূলত ব্যবসাবান্ধব মানুষ হিসেবে সুপরিচিত। তবে চীনের ব্যাপারে তার কঠোর অবস্থানের কারণে ক্রেতারা চীন থেকে অন্য দেশে অর্ডার স্থানান্তরে উৎসাহী হতে পারে। বিশ্বের দ্বিতীয় বৃহত্তম পোশাক রপ্তানিকারক হিসেবে বাংলাদেশ এই সুযোগটি নিতে পারে। ট্রাম্পের আগের মেয়াদে কিছু রপ্তানি আদেশ কিন্তু বাংলাদেশে সরে আসতে শুরু করেছিল। কুতুবউদ্দিন বলেন, ট্রাম্প এর আগে নানা রকমের চাপের মধ্যেও সামরিক সংঘাত এড়িয়ে গিয়েছিলেন।
ডিবিএল গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এম এ জব্বারও এ বিষয়ে অনেকটা একই ধরনের মতামত পোষণ করেন। তবে তিনি এও বলেন, মার্কিন সরকারের সঙ্গে আমাদের যোগাযোগের দিকে মনোযোগ দিতে হবে আমাদের। তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উচিত দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্যের উন্নতির দিকে মনোযোগ দেওয়া। এটা নির্ভর করছে আমাদের আলোচনার সক্ষমতার ওপর।
কুতুবুদ্দিন আরও বলেন, ট্রাম্পকে অন্যদের তুলনায় কঠোর মনে হলেও তিনি সামরিক সংঘর্ষে না জড়িয়ে মূলত ব্যবসার ওপরই মনোযোগ দেন বেশি। বর্তমানে যুক্তরাষ্ট্রে অবস্থানরত জব্বার বলেন, আমরা লক্ষ্য করেছি, মার্কিন জনগণ সব দিক বিবেচনা করে দেশের নেতৃত্ব দেওয়ার জন্য সঠিক ব্যক্তিকে বেছে নেয়। আর তার (ট্রাম্প) ওপর মানুষের ব্যাপক আস্থা রয়েছে। আশা করছি তিনি অত্যন্ত বুদ্ধিমত্তার সঙ্গে নিজের দায়িত্ব পালন করবেন। পলিসি এক্সচেঞ্জ বাংলাদেশের চেয়ারম্যান এম মাসরুর রিয়াজ বলেন, ট্রাম্পের বিজয়ে বাংলাদেশের মতো দেশের জন্য সুযোগ ও ঝুঁকি উভয় পথই খুলে গেছে।
এর ব্যাখ্যা দিতে গিয়ে তিনি বলেন, বাংলাদেশের জন্য স্বল্প থেকে মধ্যমেয়াদের সুযোগ বেশি। কারণ, চীন থেকে আমদানির বিষয়ে ট্রাম্পের অবস্থানের কারণে বাংলাদেশী পণ্যের চাহিদা বাড়তে পারে। ট্রাম্প যদি চীন থেকে আমদানিকৃত পণ্যে চড়া শুল্ক আরোপ করে, তা হলে যুক্তরাষ্ট্রের আমদানিকারকরা বিকল্প উৎস খুঁজতে পারে। সেক্ষেত্রে বাংলাদেশ প্রতিযোগিতামূলক সুবিধা দিতে পারবে, বিশেষ করে পোশাক খাতে।
মাসরুর রিয়াজ আরেকটি সম্ভাবনার কথা বলেন, চীনা পণ্যের ওপর মার্কিন শুল্ক এড়াতে বিকল্প উৎপাদন কেন্দ্র খোঁজা চীনা প্রস্তুতকারকদের কাছ থেকে প্রত্যক্ষ বৈদেশিক বিনিয়োগ (এফডিআই) আসতে পারে বাংলাদেশে। আর এর অর্থ হচ্ছে, তারা বাংলাদেশের মতো প্রমাণিত উৎপাদন হাবগুলোতে উৎপাদন কারখানা স্থাপন করতে চাইবে যাতে এসব দেশের লেবেলে সেখান থেকে উৎপাদন ও রপ্তানি করা যায়, বলেন তিনি।
মাসরুর রিয়াজ আরও বলেন, কাজেই বাংলাদেশ যদি সঠিকভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ ও কৌশল প্রণয়ন করতে পারে, তবে তা পোশাক খাতে ভালো পরিমাণে চীনা এফডিআই আনতে পারবে। পাশাপাশি হালকা নির্মাণ, যন্ত্রপাতি, কৃষি প্রক্রিয়াকরণ, প্লাস্টিক জাতীয় পণ্যের মতো বিকল্প খাতেও এফডিআই বাড়াতে পারবে। তবে দীর্ঘমেয়াদে ঝুঁকিও আছে। কারণ বিশ্বায়নের প্রতি ট্রাম্পের দৃষ্টিভঙ্গি অত্যন্ত নেতিবাচক। অথচ বিশ্বায়নই আন্তর্জাতিক ভ্যালু চেইন ও আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের মূল চালিকাশক্তি।
কাজেই তিনি বিশ্বায়নবিরোধী অথবা বিশ্বায়নের চেতনাকে ব্যাহত করে এমন কোনো কড়া পদক্ষেপ নেন, তা হলে তা সবার জন্যই ক্ষতিকর হবে। বর্তমান যেসব বৈশ্বিক অংশীদার বাণিজ্য ও আন্তর্জাতিক বাজার থেকে লাভবান হচ্ছে, তারাও ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। এর ফলে সব দেশই ক্ষতিগ্রস্ত হবে। বিশেষ করে বাংলাদেশ, ভিয়েতনামের মতো আন্তর্জাতিক ভ্যালু চেইনের অংশীদার দেশগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হবে বেশি।
তবে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের চেয়ারম্যান মোহাম্মদ আব্দুর রাজ্জাক বলেন, ‘ট্রাম্পের নীতিমালা বাংলাদেশের জন্য সুযোগ ও চ্যালেঞ্জের একটি মিশ্রণ হয়ে আসতে পারে। চীনের প্রতি তার কঠোর অবস্থানের কারণে রপ্তানি আদেশ চীন থেকে অন্যান্য সরবরাহকারীদের কাছে সরে যেতে পারে। এতে বাংলাদেশের মতো দেশগুলো লাভবান হতে পারে।
এ ছাড়া ট্রাম্পের সামরিক সংঘাত এড়িয়ে চলার প্রবণতা আন্তর্জাতিক স্থিতিশীলতা বাড়াতে ভূমিকা রাখতে পারে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র ও চীনের মধ্যে পূর্ণাঙ্গ বাণিজ্যযুদ্ধ শুরু হলে তা বৈশ্বিক অর্থনীতিকে ক্ষতিগ্রস্ত করবে। ট্রাম্পের আগের মেয়াদে তার প্রশাসনের বাণিজ্যনীতি বৈশ্বিক বাণিজ্যে মন্থরতা তৈরির পেছনে অবদান রাখে। এ ছাড়া ২০১৯ সালের জুলাই থেকে ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত পাঁচ মাস বাংলাদেশ নেতিবাচক রপ্তানি প্রবৃদ্ধি দেখেছে।
রাজ্জাক আরও বলেন, ট্রাম্প প্রশাসন নতুন করে সুরক্ষামূলক পদক্ষেপ নিলে বিশ্বজুড়ে আরও কঠোর বাণিজ্য নীতির পুনরুত্থান হতে পারে, যা বাংলাদেশের মতো দেশগুলোর ওপর উল্লেখযোগ্য প্রভাব ফেলতে পারে। এই চ্যালেঞ্জ এমন এক সময় এলো যখন বাংলাদেশ স্বল্পোন্নত দেশ থেকে উন্নয়নশীল দেশের কাতারে উত্তীর্ণ হতে যাচ্ছে। এ উত্তরণের ফলে দেশের রপ্তানি খাতে প্রতিযোগিতা সক্ষমতার চাপ আরও তীব্র হতে পারে। তিনি বলেন, সব মিলিয়ে এই পরিস্থিতি বাংলাদেশের জন্য সম্ভাবনা ও চ্যালেঞ্জের জটিল পরিবেশ সৃষ্টি করেছে।
সম্পর্কে বড় কোনো পরিবর্তন হবে না-উপদেষ্টা ॥ কূটনৈতিক রিপোর্টার জানান, যুক্তরাষ্ট্রে প্রেসিডেন্ট হিসেবে নির্বাচিত হয়েছেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। কিন্তু এই জয়ের কারণে যুক্তরাষ্ট্রের সঙ্গে বাংলাদেশের সম্পর্কে বড় কোনো পরিবর্তন হবে বলে মনে করেন না পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন।
বৃহস্পতিবার সন্ধ্যায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে তিনি সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের স্পেকুলেট করার প্রয়োজন নেই। আমরা ২-৩ মাস দেখি। দু’মাস সময় তো আছে। তারপর তারা দায়িত্ব এবং পদক্ষেপ নেবেন। তিনি তো বলেননি যে, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক ভালো করবেন বা খারাপ করবেন। তিনি কিছুই বলেননি।
তৌহিদ হোসেন বলেন, বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক শুধু দলের ভিত্তিতে হয় না। আমাদের সঙ্গে যেসব বিষয় নিয়ে বাইডেন প্রশাসনের আলাপ চলছিল বা তাদের যা চাওয়া ছিল বা আলোচনা চলছিল- সেগুলো এর আগের ট্রাম্প প্রশাসনের সঙ্গেও ছিল। কাজেই এটি বলা ঠিক হবে না যে, ট্রাম্প প্রশাসন এবং বাইডেন প্রশাসনের মাঝে বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্কের ক্ষেত্রে বড় কোনো পরিবর্তন হবে। এটি আমি মনে করি না। আমরা দেখি এবং যোগাযোগ প্রতিষ্ঠা করব।’