দৈনিক জনকণ্ঠে সম্প্রতি ‘রীনা ব্রাউন সিনেমার নান্দনিক সেই বাড়ি ভেঙ্গে ফেলা হচ্ছে’ শিরোনামে প্রকাশিত সংবাদে ভবনের মালিকদের পক্ষে ব্যাখ্যা দিয়েছেন সুমন চক্রবর্তী। তিনি বলেন, প্রতিবেদনে কিছু ভুল তথ্য পরিবেশিত হয়েছে এবং অনেক ক্ষেত্রে প্রকৃত ঘটনা তুলে আনা হয়নি। ভুল তথ্যের মধ্যে রয়েছে, ভবনটি তারকবন্ধু মিত্র নয়, তারকবন্ধু চক্রবর্ত্তী তৈরি করেছিলেন। রিপোর্টে উল্লেখিত ব্যক্তি দিননাথ সেন মিত্র নয়, দিননাথ সেন যিনি সুচিত্রা সেনের পিতা নন, দাদা শ্বশুর ছিলেন।
স্থানীয়রা ভালো করেই জানেন, দিননাথ সেনের বাড়িটি সতীশ সরকার রোডে এখন যে এলাকাটি ফায়ার সার্ভিস বলে পরিচিত সেই জায়গাটি ছিল। সুচিত্রা সেনের সঙ্গে আমাদের বাড়ির কোনো কালেই কোনো সংযোগ ছিল না। সংস্কৃতিকর্মী মানজার চৌধুরীর সঙ্গে যোগাযোগ করলে তিনি জানিয়েছেন, এই বাড়ির বিষয়ে এইরূপ কোনো বক্তব্য তিনি রিপোর্টারকে দেননি। রিপোর্টে বলা হয়েছে, আমরা অর্থের লোভে গোপনে ঐতিহ্য ধ্বংস করছি। গোপনে ধ্বংস করা তো দূরের কথা আমরা কি প্রতিকূলতার মধ্যে এই পর্যন্ত বাড়িটি রক্ষা করেছি তা এলাকাবাসী সবাই জানেন।
প্রকৃত ঘটনা হচ্ছে, আমাদের প্রপিতামহ তারকাবন্ধু চক্রবর্ত্তী এই বাড়িটি এক একর জমির ওপর প্রতিষ্ঠা করেছিলেন। তিনি তার এই বাড়িটি ১৯৩১ সালে একটি রেজিস্ট্রি উইলের মাধ্যমে তার প্রপৌত্র গনকে (আমরা) এই বাড়ির সমস্ত স্বত্বে স্বত্বাধিকারী করেন। ১৯৬৫ সালের পাক ভারত যুদ্ধের পর সরকার বাড়িটি শত্রু সম্পত্তির তালিকাভুক্ত করে।
বিভিন্ন আইনি প্রক্রিয়া শেষে ১৯৭২ সালে বাড়িটি শত্রু সম্পত্তির তালিকা থেকে অবমুক্ত হয়। এর মধ্যে আমাদের বাড়ির ২২ কাঠা জমি বেদখল হয়ে যায়। এরপর অজ্ঞাত কারণে আরও কয়েক দফা বাড়িটি অর্পিত সম্পত্তির তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হয়। আইনি লড়াইয়ের পর ২০১৮ সালে বাড়িটি অর্পিত সম্পত্তির তালিকা হতে অবমুক্ত হয়।
বিজ্ঞ যুগ্ম-জেলা জজ আদালতের ২৯১/২০০৪ নম্বর রায়ের আলোকে সম্পত্তিটি নিজেদের মধ্যে ভাগ-বাটোয়ারার জন্য চলতি বছর ৭ অক্টোবর থেকে বাড়িটি ভাঙা শুরু হয়। ২১ অক্টোবর বিকেল ৪টায় পুলিশ আমাদেরকে জানায়, আরবান স্টাডি গ্রæপ নামের একটি এনজিও সংগঠন এই বাড়িটি পুরাকীর্তির তালিকাভুক্ত মর্মে ভাঙার কাজ বন্ধ রাখার দাবিতে গেন্ডারিয়া থানায় একটি জিডি করেছে।
আমাদের জানামতে, আমাদের বাড়িটি সরকার কর্তৃক ঘোষিত কোনো পুরাকীর্তি নয়। রাজউকের ৭৪টি ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের ৩৫টি পুরাকীর্তি ভবনের তালিকায় এটির নাম নেই। আরবান স্টাডি গ্রুপ নামের একটি এনজিও সংগঠন শুধুমাত্র পুরান ঢাকার ২২০০ ভবন বা স্থাপনা পুরাকীর্তি হিসেবে তালিকাভুক্ত করে সেই তালিকাটি ২০১৭ সালে প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের নিকট জমা দেয়।
২০১৮ সালে তারা ‘কেন প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর তাদের প্রস্তুতকৃত তালিকার ১০০ বছরের পুরানো এই ভবনগুলোর সংরক্ষণের জন্য প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে ব্যর্থ হয়েছে মর্মে উচ্চ আদালতে দুটি রিট পিটিশন দায়ের করে। তালিকা প্রস্তুতের সময় আরবান স্টাডি গ্রুপ আমাদের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করেনি। এমনকি আদালতের শুনানি চলাকালেও আমাদেরকে কিছু জানানো হয়নি। ফলে আদালতে আমাদের বক্তব্য দেওয়ার সুযোগ ছিল না।
উচ্চ আদালত শুনানি শেষে প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরকে এই ভবনগুলো যাচাই-বাছাইয়ের নির্দেশ দেন এবং প্রতি তিন মাস অন্তর তাদের অগ্রগতির রিপোর্ট আদালতে জমা দিতে বলেন। এই তালিকা যাচাই-বাছাই চূড়ান্ত না হওয়া পর্যন্ত এই তালিকায় থাকা ভবনে কোনো স্থাপনা তৈরির অনুমোদন, বা নতুন কোনো ভবন তৈরি করে না দিতে রাজউককে নির্দেশ দেন। একইসঙ্গে মালিকদের এই ভবনগুলোর বর্তমান অবস্থা থেকে পরিবর্তন ও পরিবর্ধন না করারও নির্দেশ দেন। আশ্চর্যের বিষয় মহামান্য আদালত, প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর, রাজউক, এনজিও আরবান স্টাডি গ্রুপ বা অন্য কোনো পক্ষই আমাদেরকে এই নির্দেশের বিষয়ে জানায়নি।
আমরা বাড়ি ভাঙার কাজ বন্ধ রেখে ২৪ অক্টোবর থানার ওসি এবং এসি সাহেবের উপস্থিতিতে রাজউক ও আরবান স্টাডি গ্রæপের সঙ্গে গেন্ডারিয়া থানায় একটি বৈঠকে যোগ দেই। বৈঠকে এসি সাহেব আরবান স্টাডি গ্রæপের তৈমুর ইসলাম সাহেবের কাছে জানতে চান, আমাদের ভবনটি যে ঐতিহ্যবাহী ভবনের তালিকায় আছে তা, রাজউক বা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর কিংবা আমাদেরকে জানিয়েছিলেন কিনা?
তৈমুর ইসলাম সাহেব বলেন, কোর্টের নির্দেশনা অনুযায়ী উনি, রাজউক বা প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর এ ব্যাপারে ভবন মালিকদের জানানোর কথা নয়। তালিকাভুক্ত কোনো ভবনের মালিক যখন রাজউকে প্ল্যানের জন্য আবেদন করবেন তখন রাজউক তা আটকে দেবে এবং ভবন মালিককে এ ব্যাপারে জানাবে। রাজউকের প্রতিনিধি তোহা সাহেব জানান, আমাদের ভবনটি রাজউকের ৭৪টি ভবন বা তাদের কাছে থাকা আরবান স্টাডি গ্রুপের ২২০০ ভবনের তালিকায় নেই এবং আমরা রাজউকে কোনো নতুন ভবনের প্ল্যানের জন্য আবেদন করিনি। এসি সাহেবের অপর প্রশ্নের জবাবে রাজউক প্রতিনিধি জানান, আইন অনুযায়ী ভবন ভাঙার জন্য রাজউক বা অন্য কোনো পক্ষের অনুমতির প্রয়োজন নাই।
পরে অবশ্য রাজউক প্রতিনিধি ২২ অক্টোবর ইস্যুকৃত একটি চিঠি উপস্থাপন করেন যাতে উল্লেখ আছে ‘এ ধরনের পুরাতন ভবনে অপসারণ, পরিবর্ধন, সংশোধন এবং পরিমার্জন করার ক্ষেত্রে ভবন মালিককে স্থাপত্য অধিদপ্তর, রাজউক, সিটি করপোরেশনসহ অন্যান্য দপ্তরকে অবহিত করা প্রয়োজন’। আমাদের জানা মতে, এ ধরনের কোনো আইন বা নীতিমালা নাই।
তখন এসি সাহেব রাজউকের অনাপত্তি না আসা পর্যন্ত আমাদের ভবন ভাঙা বন্ধ রাখতে বলেন। ২৫ অক্টোবর প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তর আমাদের ভবনের তালিকাসহ থানায় জিডি করেছে। এর আগে পর্যন্ত কোনো সরকারি সংস্থা আমাদের ভবনটি ভাঙার ওপর আদালতের নিষেধাজ্ঞার কথা জানায়নি। আমরা সকল সময় আইনের প্রতি শ্রদ্ধাশীল। বস্তুত ২১ অক্টোবর বিকেল থেকে ভবন ভাঙা বন্ধ রয়েছে। যেহেতু আদালতের নিষেধাজ্ঞার কথা জানতেই পারিনি তাহলে কিভাবে আমরা নিষেধাজ্ঞা অমান্য করলাম ?
আদালতের রায় পর্যালোচনা করলে দেখা যায় আরবান স্টাডি গ্রুপ শুধুমাত্র ১০০ বছরকে মানদণ্ড বিবেচনা করে এই তালিকা তৈরি করেছে। এটি কোনো মানদÐ হতে পারে না। এর জন্য স্থাপনার ইতিহাস, ঐতিহ্যসহ অনেক কিছু বিবেচনায় আনতে হবে। ২০১৮ থেকে এই পর্যন্ত ৬ বছরে প্রতœতত্ত¡ অধিদপ্তর মাত্র ৩৯০ বাড়ির রিপোর্ট আদালতে জমা দিতে পেরেছে। এভাবে চললে ২২০০ বাড়ির রিপোর্ট দিতে ৩৫-৪০ বছর লেগে যাবে। এই বাড়িগুলোর বাসিন্দারা এখনই অবর্ণনীয় দুর্দশা ও ঝুঁকির মধ্যে বসবাস করছেন। আরও ৩৫-৪০ বছর বাড়ির সংস্কার ছাড়া বসবাস করলে কতটি দুর্ঘটনা ঘটতে পারে কিংবা বসিন্দাদের কি অবস্থা হবে তা কি কেউ ভেবে দেখেছেন ?
এসআর