এক ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রেখেছে ভারতের আদানি
ঋণ পরিশোধ না করে বাংলাদেশ চুক্তি ভঙ্গ করেছে অভিযোগে এক ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ রেখেছে ভারতের আদানি পাওয়ার ঝাড়খণ্ড লিমিটেড (এপিজেএল)। একই অভিযোগে সম্প্রতি দেশটির সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়, ৭ নভেম্বরের (আজ বৃহস্পতিবার) মধ্যে সম্পূর্ণ ঋণ পরিশোধ না করলে দ্বিতীয় ইউনিটও বন্ধ করে দেবে কোম্পানিটি।
যদিও পরবর্তীতে এই তথ্যকে ভিত্তিহীন বলে দাবি করা হয় কোম্পানির পক্ষ থেকে। কিন্তু তার পর থেকেই দুই দেশের জ্বালানি বিনিময় ইস্যুতে তৈরি হয় নানামুখী আলোচনা-সমালোচনা। এরই প্রেক্ষিতে বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) বলছে, বাংলাদেশ নয় বরং আদানিই চুক্তি ভঙ্গ করে অস্ট্রেলিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার কয়লা ব্যবহার না করে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশীয় কয়লা ব্যবহার করছে। বিপরীতে কয়লার বাড়তি দামও আদায় করতে চাইছে, যা সম্পূর্ণরূপে অন্যায্য।
পিডিবি সূত্রে জানা যায়, দেশটি থেকে কয়লার দামসহ ৮০ কোটি মার্কিন ডলার বকেয়ার দাবিতে চিঠি দেওয়া হয়েছে। যেখানে কয়লার দাম ধরা হয়েছে ৯৬ ডলার করে। কিন্তু দেশের পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিত এক হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতিটন কয়লার দাম নিচ্ছে ৭৫ মার্কিন ডলার। চট্টগ্রামের বাঁশখালীর এসএস পাওয়ার প্ল্যান্ট ও বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতিটন কয়লার দাম ৮০ মার্কিন ডলারের কম। তার মানে প্রতিটন কয়লায় পায়রা ও রামপালের চেয়ে ১৬ থেকে ২১ মার্কিন ডলার পর্যন্ত বাড়তি দাম চাইছে তারা।
দেশীয় কয়লার বিদ্যুৎ উৎপাদনে কোনো প্রভাব না পড়লেও চুক্তি ভঙ্গ করে কোম্পানিটি বাংলাদেশ থেকে বেশি মুনাফা আদায় করতে চাইছে। শুধু তাই নয়, পিডিবির এক অডিট রিপোর্ট বলছে, ৮০ কোটি নয় বরং কোম্পানিটি বাংলাদেশের কাছে পাবে ৫৪ দশমিক ৮৪ কোটি মার্কিন ডলার। এই বিষয়টি কোম্পানির সামনে তুলে ধরার পর পরই তাদের সুর নরম হয়েছে দাবি করে পিডিবির এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, ইতোমধ্যে আমরা তাদের তিনবার বিল দিয়েছি। কিন্তু তারা কোনো কথা না শুনে প্রতিদিন এক মেগাওয়াট করে প্রতীকী বিদ্যুৎ সরবরাহ কম করার কথা জানায়।
হঠাৎ করে ২ তারিখ তারা টেলিফোনে জানিয়েছে, ৭ নভেম্বর থেকে তোমাদের আর বিদ্যুৎ দেব না। এর পর থেকেই তারা সক্ষমতার অর্ধেক বিদ্যুৎ দিচ্ছে আমাদের। গত সোমবার তারা ৭৩২ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেয়। তখন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি উপদেষ্টা এবং প্রধানমন্ত্রীর প্রেস উইং থেকে বলা হলো, খুবই দুঃখজনক এ ঘটনা। এটা অপ্রতিবেশীসুলভ, অনাকাক্সিক্ষত আচরণ। ততক্ষণে তারা বুঝে গেছে যে, তারা কঠোর অবস্থানে গেলে বাংলাদেশও কঠিন অবস্থানে চলে যাবে। ফলে বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি পুরোপুরি বসিয়ে রাখতে হবে। তখনই সুর নরম করে ফেলে।
এই বিদ্যুৎ কেন্দ্রটি তো শুধু বাংলাদেশে বিদ্যুৎ দেওয়ার জন্য তৈরি করা হয়েছে। বাংলাদেশে না দিতে পারলে কী করবে বিদ্যুৎ দিয়ে। যদিও সম্প্রতি তারা নিজেদের দেশেও কেন্দ্রটি থেকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করার বিধান রেখে নীতিমালা করেছে। তা হলেও তো এটি চুক্তি ভঙ্গের শামিল। তাই বাংলাদেশ নয় বরং তারাই চুক্তি ভঙ্গ করেছে বলে আমি মনে করি।
এ বিষয়ে সরাসরি ভারতকে চুক্তিভঙ্গের দায় না দিলেও ভারত এটি অন্যয্য করেছে উল্লেখ করে পিডিবির চেয়ারম্যান প্রকৌশলী মো. রেজাউল করিম জনকণ্ঠকে বলেন, ভারতের আদানির ঋণ প্রদান একটি নিয়মিত বিষয়। অক্টোবর মাসেও আমরা নয় কোটি সাত লাখ ডলার পরিশোধ করেছি। চলতি মাসেও ডলার প্রাপ্তি সাপেক্ষে বকেয়া পরিশোধের চেষ্টা করা হচ্ছে। আমাদের কাছে বকেয়া আছে সেটা তো সত্যি। ২০২৩ সালের ডিসেম্বর থেকেই এ বকেয়া শুরু। এক দিনেই তো আর পরিশোধ সম্ভব না। তাদের দাবি ৮০ কোটি ডলার। আমাদের হিসাবে হয়তো আরও হয়তো কিছুটা কম হতে পারে। দুই পক্ষের আলোচনায় এর সমাধানে আসা সম্ভব।
তবে ঋণ পরিশোধে পিডিবি নানামুখী পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে বলে জানা গেছে। এক্ষেত্রে সরকার বন্ড ছাড়তে পারে। শুধু তাই নয়, বিদেশী ঋণদাতাদের কাছে সাহায্যও চাওয়া হতে পারে জানিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক পিডিবির এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, সরকার বিভিন্ন সময় বিভিন্ন ধরনের ঋণ পরিশোধ বা সংকটের সময় বন্ড ছাড়ে। দেশ-বিদেশ থেকে প্রাপ্ত বন্ডে টাকা দিয়ে সংকট মোকাবিলা করে থাকে। আদানির ক্ষেত্রেও এরকম করা হতে পারে। এর বাইরেও বাংলাদেশ ব্যাংক থেকে অর্থ ছাড়ের একটা আশা রয়েছে। অর্থ উপদেষ্টা আর জ্বালানি উপদেষ্টা এ বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নেবেন। তবে যেহেতু একদিনে সব অর্থ পরিশোধ সম্ভব নয়, তাই দুই দেশকেই সহনশীলতার সঙ্গে পরিস্থিতি মোকাবিলা করতে হবে।
তিনি আরও বলেন, জুলাই থেকে আগের মাসগুলোর চেয়ে বেশি চার্জ নিচ্ছে আদানি। পিডিবি সপ্তাহে ১৭ থেকে ১৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করছে, যেখানে চার্জ হচ্ছে ২২ মিলিয়ন ডলারের বেশি। এ কারণেই বকেয়া বিল আবার বেড়েছে। এ ছাড়া কৃষি ব্যাংককে গত সপ্তাহে পেমেন্ট জমা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ভারতীয় সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া বিল পরিশোধে ব্যাংকে এক হাজার কোটি টাকা জমা দিয়ে রেখেছে পিডিবি। তবে ডলার সংকটের কারণে ব্যাংক নিয়মিত বিল পরিশোধ করতে পারছে না। আর আদানি কয়লার বাড়তি দাম ধরে বিল জমা দিলেও তারা সেটি এখন পর্যন্ত আমলে নিচ্ছে না। প্রয়োজনে চুক্তি সংশোধন করার ব্যবস্থা করতে হবে।
গত রবিবার ভারতীয় সংবাদ মাধ্যম টাইমস অব ইন্ডিয়ায় প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়, প্রায় ৮৫ কোটি ডলারের বকেয়া নিষ্পত্তির সুরাহা না হলে আদানি পাওয়ার আগামী ৭ নভেম্বর (আজ) থেকে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেবে। ভারতের ঝাড়খ- রাজ্যের গোড্ডায় কয়লাভিত্তিক ওই বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি ইউনিট থেকে প্রতিদিন ১৪শ’ থেকে ১৫শ’ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ দেশে আসছিল। বকেয়া না পাওয়ায় গত ৩১ অক্টোবর তারা একটি ইউনিটের বিদ্যুৎ উৎপাদন বন্ধ করে দেয়। এর আগে বকেয়া পরিশোধের সময়সীমাও বেঁধে দেয় কোম্পানিটি।
চুক্তি অনুযায়ী আদানিকে সোনালী ব্যাংকের মাধ্যমে অর্থ পরিশোধ করার কথা পিডিবির। কিন্তু ডলার সংকটের কারণে ব্যাংকটি অপারগতা প্রকাশ করায় সেই অর্থ কৃষি ব্যাংকের মাধ্যমে পিডিবির কর্মকর্তারা পাঠাতে চেয়েছিলেন। কিন্তু তা চুক্তির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ না হওয়ায় আদানি পাওয়ার তাতে সম্মতি দেয়নি। কিন্তু বিপরীতে বিদ্যুৎ উৎপাদনে দেশীয় কয়লা ব্যবহার করে কোম্পানিটি নিজেই চুক্তি ভঙ্গ করেছে উল্লেখ করে জ্বালানি বিশেষজ্ঞ ও কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, তাদের সঙ্গে চুক্তিতে অনেক ধরনের বাড়তি খরচ ধরা হয়েছে।
পদে পদে সুবিধা নিয়েছে তারা। এর ফলে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ ডলার নিয়ে যাচ্ছে আদানি। অস্ট্রেলিয়া বা ইন্দোনেশিয়ার কয়লার নাম করে তারা দেশীয় কয়লা ব্যবহার করছে। এতে করে তো তারা চুক্তি ভঙ্গ করেছে। তাই আমরা বলব, এটি একটি একতরফা চুক্তি, সেই সুযোগটাই নিচ্ছে আদানি। তাই এ চুক্তি থেকে অবিলম্বে সরে আসা দরকার সরকারের। সরকার বাতিল করতে না পারলে আদালতে যাবে ক্যাব।
আদানির সঙ্গে এই বিতর্কিত চুক্তির দায় বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের বলে উল্লেখ করা হয়েছে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস উইং থেকেও। গত রবিবার সন্ধ্যায় রাজধানীর ফরেন সার্ভিস একাডেমিতে সংবাদ সম্মেলনে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল ইসলাম বলেন, বিদ্যুৎ আমদানির জন্য ভারতের আদানি গ্রুপ টাকা পায় এটা সত্য। তাদের পেমেন্ট দেওয়ার ক্ষেত্রে গতি বাড়ানো হয়েছে। পূর্বের যে বিল বাকি আছে, সেটার জন্য মূলত পূর্ববর্তী আওয়ামী লীগ সরকারই দায়ী।
তিনি বলেন, আদানি গ্রুপকে গত মাসে ৯ দশমিক ৭ মিলিয়ন ডলার পেমেন্ট করা হয়েছে। যেটা আগস্ট বা আগের মাসের চেয়ে দ্বিগুণ। পেমেন্ট আরও দ্রুত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে।
তবে আদানি বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখলেও চাহিদা কমায় খুব একটা প্রভাব পড়ছে না বলে জানিয়েছে পিডিবি। আদানির ওই ইউনিট থেকে দেশের জাতীয় গ্রিডে সরবরাহ বন্ধ রয়েছে প্রায় ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। একই সময়ে কয়লার অভাবে পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে মাতারবাড়ি বিদ্যুৎ কেন্দ্রের দুটি ইউনিটই।