ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ০৬ নভেম্বর ২০২৪, ২১ কার্তিক ১৪৩১

বিশেষজ্ঞদের অভিমত

নির্বাচিত সংসদই সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে

জনকণ্ঠ রিপোর্ট

প্রকাশিত: ২৩:০৯, ৫ নভেম্বর ২০২৪

নির্বাচিত সংসদই সংবিধান পরিবর্তন করতে পারে

সংবিধান সংশোধন

সংবিধান সংশোধনের বিষয় নিয়ে সংবিধান বিশেষজ্ঞ  ও রাজনৈতিক নেতৃবৃন্দের মধ্যে ব্যাপক বিতর্ক চলছে। অন্তর্বর্তীকালীন সরকার সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। বিশেষজ্ঞরা বলছেন, সংবিধান সংশোধন বা বাতিলের ক্ষমতা এ সরকারের নাই। নির্বাচিত সংসদ ছাড়া সংবিধান সংশোধন বা বাতিলের কোনো সুযোগ নেই।
এদিকে সংবিধান সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান আলী রিয়াজ জানিয়েছেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ নয়, সুপারিশমালা প্রণয়নে  লিখিত প্রস্তাব চাওয়া হবে। সংবিধান  ১৯৭২ সালের ১৬ ডিসেম্বর থেকে কার্যকর হয়। এরপর ৫২ বছরে সংবিধান সংশোধন হয়েছে ১৭ বার। গণপ্রজাতন্ত্রী বাংলাদেশের সংবিধান স্বাধীন ও সার্বভৌম বাংলাদেশ রাষ্ট্রের সর্বোচ্চ আইন। সংবিধান প্রণয়নের উদ্দেশ্যে ১৯৭২ সালের ১১ এপ্রিল ড. কামাল হোসেনকে সভাপতি করে ৩৪ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়। তৎকালীন গণপরিষদ ভবন যা বর্তমানে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়, সেখানে সংবিধান প্রণয়ন কমিটিকে সহযোগিতা করেন ব্রিটিশ আইনসভার খসড়া আইনপ্রণেতা আই গাথরি।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানের পর অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান সংশোধনের উদ্যোগ নিয়েছে। এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের সিনিয়র আইনজীবী জেড আই খান পান্না জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমান সংবিধান সংশোধন করা যেতে পারে। যেমন ৭০ অনুচ্ছেদ, এটা সংশোধন করে দলের বিপক্ষে ভোট দিলে কোনো এমপির মেম্বারশিপ খারিজ হবে না এটা করা যায়। এখন আছে খারিজ হবে। তবে মূল অংশে হাত না দেওয়াই ভালো। বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক জনকণ্ঠকে বলেন, দেশে সংস্কার কার্যকর করতে হলে রাজনৈতিক দলসমূহকে আস্থায় নিতে হবে।

সংবিধান বাতিল বা পরিবর্তন করা অন্তর্বর্তী  সরকারের কাজ নয়। তিনি আরও বলেন, অন্তর্বর্তী সরকার এ ব্যাপারে রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে কথাবার্তা বলবে আলাপ- আলোচনা করবে। একটা মতামত গঠনের চেষ্টা নেবে। কিন্তু আমি মনে করি যে সংশোধন বা পরিবর্তন করার ক্ষেত্রে নির্বাচিত জনপ্রতিনিধি বা পরবর্তী পার্লামেন্ট উপযুক্ত। আমি মনে করি, এবারের সংবিধান সংশোধনী বা পুনর্লিখনের ব্যাপারটায় অন্তর্বর্তী সরকারের হাত দেওয়া উচিত নয়। 
গত রবিবার সংবিধান সংস্কার কমিশনের চেয়ারম্যান আলী রিয়াজ জানান, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংলাপ নয়, সুপারিশমালা প্রণয়নে লিখিত প্রস্তাব চাওয়া হবে। তিনি আরও বলেন, বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ও গণঅভ্যুত্থানকে পাশ কাটিয়ে সংবিধান প্রণয়নের কোনো  সুযোগ নেই। জনআকাক্সক্ষার বাস্তবায়ন ঘটাতে চাইলে নিঃসন্দেহে সংবিধানে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের বিষয়টি রাখতে হবে। গণঅভ্যুত্থান না হলে এই কমিশন হতো না। এমনকি আমরা এখানে উপস্থিতও হতে পারতাম না।
এদিকে সোমবার সংবিধান দিবসের আলোচনা সভায় ১৯৭২ সালের সংবিধান প্রণেতা ড. কামালসহ সংবিধান বিশেষজ্ঞরা তাদের মতামত তুলে ধরেন। সেখানে ড. কামাল হোসেন বলেন, জনগণ মনে করলে সংবিধান সংশোধনী আনা যেতে পারে। সংবিধানে ষোলোটি সংশোধনী হয়েছে। যখন দেখেছে সংবিধানে কোনো ঘাটতি আছে, যে বিধান আছে তা মানুষের স্বার্থে কাজে লাগছে না, সেটা বদলানো হয়েছে। এ কারণে হয়েছে যে, এটা মানুষের করা আইন, এটাতে কোনো ভুল হলে বা সময়ের পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে শোধরাতে পারে। এটা করতে হবে জনগণকে নিয়ে। কোনো ব্যক্তি কিংবা রাষ্ট্রপতিও যদি মনে করেন, তবু কলমের এক খোঁচায় বদলাতে পারবেন না। 
তিনি বলেন, সংখ্যাগরিষ্ঠ মত যদি গড়ে ওঠে তখন সংবিধানে হাত দেওয়া যেতে পারে। এটাকেই সংবিধানের পবিত্রতা বলি। এটাকে মৌলিক আইন কেন বলি? কারণ সব আইনের ঊর্ধ্বে এর একটা মর্যাদা আছে। যেন-তেনভাবে এটাতে হাত দেওয়া যায় না। এমনকি, পার্লামেন্টও সংবিধানের মৌলিক বিষয়ে হাত দিতে পারে না।
ড. কামাল হোসেন বলেন, সাম্প্রতিক ঘটনাবলির পর আমরা দেখতে পেয়েছি, আমাদের আইন ও প্রাতিষ্ঠানিক সুরক্ষাগুলোকে আরও দৃঢ় করতে হবে। আমাদের স্বাধীন বিচারব্যবস্থা নিশ্চিত করতে হবে। সুষ্ঠু নির্বাচন প্রক্রিয়া বজায় রাখতে হবে। সব স্তরে স্বচ্ছতা আনতে হবে। আমাদের সংবিধানকে অত্যাচারের বিরুদ্ধে একটি সুরক্ষাকবচ হিসেবে দাঁড় করাতে হবে। যার সুরক্ষাবলয়ে কোনো নাগরিক অবিচার এবং অন্যায়ের আশঙ্কায় জীবন-যাপন করবে না। তিনি বলেন, সংবিধানের রক্ষক জনগণ। জনগণকে সতর্ক থাকতে হবে। সক্রিয়ভাবে পাহারাদারের ভূমিকায় থাকা দরকার। সংবিধান নিয়ে সরকার যেভাবে বাখ্যা করছে- তা ভুল হলে সেটা বলতে হবে। সংবিধান জনগণের জন্য। জনগণই এর হেফাজত করবে। সংবিধান সংশোধন করলে সাধারণ মানুষের মতামত যেন তাতে প্রতিফলিত হয়।    
ড. শাহদীন মালিক বলেন, ৫২ বছরে আমার হিসাবে আমরা ১২ বার সরকার পদ্ধতি পরিবর্তন করেছি। ১৯৭১ থেকে ১৯৮২ পর্যন্ত আমরা ৫ বার সরকার ব্যবস্থা পরিবর্তন করেছি। তিনি বলেন, ২০০৮ সালে এই বিতাড়িত সরকার ক্ষমতায় আসল। ২০০৯ সাল থেকে আমরা সংসদীয় একনায়কতন্ত্র কায়েম করলাম। আফ্রিকার কিছু দেশে আছে। সংসদ আছে তার পরেও একনায়কতন্ত্র।
অধ্যাপক আনোয়ার হোসেন বলেন, সংবিধানে ইংরেজি শব্দে কিছু ভুল আছে। এগুলো সংশোধন হওয়া উচিত। ৮৪টি সংশোধনের পর ১৯৭২ সালে সংবিধান প্রণীত হয়েছে। সেই সংবিধান, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সংগীত বদল হতে পারে না। ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন বলেন, সংবিধান নিয়ে ষড়যন্ত্র করলে নির্বাচন ভ-ুল হয়ে যেতে পারে। সংবিধান জনগণের দলিল। এটা কেন বাদ হবে। গ্রামে মুরগি চুরির বিচার হয়, সংবিধান লঙ্ঘন করলে বিচার হয় না।

ছাত্রদের দাবি ছিল চাকরিক্ষেত্রে বৈষম্য দূর করতে হবে। সেটা বাস্তবায়ন হয়েছে। তারা তো বলেনি রাষ্ট্রীয় কাঠামো সংশোধন করব। অন্তর্বর্তী সরকার সংবিধান বাতিল করলে একদল রাস্তায় নেমে যাবে। তখন প্রশ্ন আসবে সংবিধানে কী থাকবে ইসলামী জাতীয়তাবাদ, না বাঙালি জাতীয়তাবাদ। এগুলো অন্তর্বর্তী সরকারের কাজ নয়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করে সংবিধান সংশোধনের গাইডলাইন তৈরি করুন। অ্যাগ্রিমেন্ট হোক। নয়তো সমস্যা তৈরি হবে। গাইডলাইন দিয়ে যান। 
এস এম সবুর বলেন, সংবিধান নিয়ে যে বিতর্ক তোলা হয়েছে আশা করছি ড. ইউনূসের নেতৃত্বে সরকার তার অবসান ঘটাবে। আমরা মনে করি, অন্তর্বর্তী সরকারের দায়িত্ব সব দলের সঙ্গে আলোচনা করে অংশগ্রহণমূলক নির্বাচনের ব্যবস্থা করা। এ সংবিধানের আলোকে তারা শপথ নিয়েছে। তিনি আরও বলেন, সংবিধান সংশোধন হতে পারে। এটাও সংসদ করবে। মানুষকে সংবিধান নিয়ে বিভ্রান্ত করা হচ্ছে।
জগলুল হায়দার আফ্রিক বলেন, সংবিধান সংশোধনের বিষয়ে অন্তর্বর্তী সরকার সুপারিশ করতে পারে। তবে এ বিষয়ে নির্বাচিত সরকারই ব্যবস্থা নেবে। অ্যাডভোকেট সুব্রত চৌধুরী বলেন, জাতীয় ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করবেন না। তাহলে আপনারাই মুছে যাবেন। তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের উদ্দেশে বলেন, ১০টি সংস্কার কমিশন করেছেন করেন, সংস্কার করেন। কিন্তু নীতিমালা হওয়ার আগে কীভাবে বিচারপতি নিয়োগ হলো। ১৫ জন বিচারপতি বিচারের বাইরে।

এসবের জবাব থাকা উচিত। সরকার যেভাবে রাষ্ট্রের জন্ম ইতিহাসকে তুচ্ছতাচ্ছিল্য করছে, পরে হয়তো বলবে মুক্তিযুদ্ধ বাতিল। আমরা কি কিছুই করিনি? অতীতের কিছু থাকবে না? এই ষড়যন্ত্র চলতে দেওয়া যাবে না। জাতির ইতিহাস মুছে ফেলার চেষ্টা করবেন না। তিনি আরও বলেন, সংবিধানের চার মূলনীতির সঙ্গে রাষ্ট্রধর্ম ইসলাম সাংঘর্ষিক। আগামীতে যারা নেতৃত্বে আসবেন, তারা এই গোঁজামিল মুক্ত করবেন।

×