বছর জুড়েই তুলার চাহিদা রয়েছে। তবে শীতকাল এলে তুলার চাহিদা দ্বিগুণ বেড়ে যায়। তুলা দিয়ে ভোজ্য তেল ও অয়েল কেক তৈরি হচ্ছে। সাদা তুলার কদর আগেও ছিল এখনো আছে। যদিও কিছু কারখানাজাত দ্রব্য এখন তুলার পরিপূরক হিসেবে বাজারে এসেছে। তবে তুলা এখনো তুলাই আছে। এর সমান্তরাল এখনো কিছু হয়ে উঠতে পারেনি। তুলা দিয়ে বিছানা, বালিশ, তোশক তো আছেই, এ ছাড়াও তুলা দিয়ে পুতুলসহ নানা দ্রব্য তৈরি হয়। তৈরি কাপড়ও। বলা হয়ে থাকে ‘বস্ত্রশিল্পের অন্যতম কাঁচামাল তুলা। বস্ত্রশিল্প আমাদের দেশের অর্থনীতির অন্যতম চালিকাশক্তি। তুলা উৎপাদন বাড়লে আমদানি নির্ভরতা কমবে। এতে আমাদের দেশ অর্থনৈতিকভাবে লাভবান হবে। তবে দেশে বর্তমানে চাহিদার মাত্র তিন শতাংশ তুলা উৎপন্ন হচ্ছে।
জানা গেছে, দেশে প্রতিবছর তুলার চাহিদা রয়েছে প্রায় ৮৫ লাখ বেল। প্রতিবছর আমদানি করতে হয় প্রায় ৮৩ লাখ বেল। এতে খরচ হয় প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা। চাষিদের উৎপাদিত প্রতি মণ তুলা থেকে আঁশ পাওয়া যায় ১২ কেজি আর বীজ ২৮ কেজি। বর্তমানে দেশের ১২টি ¯িপনিং মিল চাষিদের কাছ থেকে উৎপাদিত তুলা কিনছে। তুলা বীজ থেকে উৎপন্ন হয় ভোজ্য তেল ও অয়েল কেক। দেশে চার জাতের তুলা উৎপাদন হয়। এর মধ্যে রয়েছে চরাঞ্চলে চর কটন, পাহাড়ে হিল কটন, সমতলের আপলাইন কটন ও বরেন্দ্র এলাকার ড্রাউট কটন।
কিন্তু উত্তরাঞ্চলসহ সারাদেশে তুলা উৎপাদন সেভাবে বৃদ্ধি পাচ্ছে না। আমদানি নির্ভরতা কমাতে দেশে তুলার চাষ বৃদ্ধির পরিকল্পনা রয়েছে। তবে বাজারদর নিয়ে হতাশ তুলা চাষিরা। তারা জানান, বীজ, সার, ডিজেল ও কীটনাশকের দাম এবং কৃষি শ্রমিকের মজুরি বৃদ্ধিতে তুলা উৎপাদন ব্যয় বেড়েছে।
তুলা চাষিরা জানান, গত বছর প্রতি মণ তুলা (আঁশ ও বীজ) বিক্রি হয়েছিল তিন হাজার ৮০০ টাকা দরে। এ বছর প্রতি মণ তুলার দাম বেড়েছে ১০০ টাকা। এতে উৎপাদিত তুলা বিক্রি করে আশানুরূপ লাভ করতে পারছেন না চাষিরা। তারা জানান, প্রতিমণ তুলার দাম পাঁচ হাজার টাকা নির্ধারণ করা হলে লাভবান হতে পারতেন। তুলা চাষিরা আরও জানান, এ বছর প্রতি বিঘা জমিতে তুলা উৎপাদিত হয়েছে ১৪-১৬ মণ। এতে খরচ হয়েছে ১৬-২০ হাজার টাকা। গত বছর খরচ হয়েছিল ১১-১৪ হাজার টাকা। তুলা চাষের জন্য উঁচু জমির প্রয়োজন। সময় লাগে আট মাস (মধ্য জুলাই থেকে মধ্য মার্চ)। স্বল্পমেয়াদি জাতের তুলা চাষের সুযোগ পেলে তারা জমিতে অন্য ফসল উৎপাদনের সুযোগ পেতেন। এতে অনেকেই তুলা চাষে আগ্রহী হতো।
তুলা উন্নয়ন বোর্ড সূত্রে জানা গেছে, এ বছর রংপুর অঞ্চলের পাঁচ জেলা নীলফামারী, লালমনিরহাট, কুড়িগ্রাম, গাইবান্ধা ও রংপুরে মাত্র সাত হাজার চাষি দুই হাজার ৩৭৫ হেক্টর জমিতে তুলা চাষ করেছেন। গত বছর জমির পরিমাণ ছিল দুই হাজার ৩৫২ হেক্টর।
সংশ্লিষ্ট সূত্রমতে এ বছর সারাদেশে ৪৬ হাজার হেক্টর জমিতে তুলা চাষ হয়েছে। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয় দুই লাখ ২৮ হাজার বেল (প্রতি বেলে ১৮২ কেজি)। গত বছর ৪৫ হাজার ১৫০ হেক্টর জমিতে তুলা উৎপাদন হয়েছিল দুই লাখ ১০ হাজার বেল। দেশে প্রতিবছর তুলার চাহিদা রয়েছে প্রায় ৮৫ লাখ বেল। প্রতি বছর আমদানি করতে হয় প্রায় ৮৩ লাখ বেল। এতে খরচ হয় প্রায় ৩৫ হাজার কোটি টাকা।
তুলা চাষি মনজুর আহমেদ জানান, গত বছর থেকে তারা হাইব্রিড জাতের তুলা চাষ করছেন। দুই বছর আগে স্থানীয় জাতের তুলা চাষ করে কম ফলন পেয়েছিলেন। তিনি বলেন, আমরা তুলার ফলন পাচ্ছি আশানুরূপ। কিন্তু বাজারদর নিয়ে হতাশ। প্রতি মণ তুলা পাঁচ হাজার টাকা দরে বিক্রি করতে পারলে প্রত্যাশিত লাভ পেতাম। তুলা চাষে সময় লাগে আট মাস। এই সময়ে জমিতে দুই ধরনের ফসল উৎপন্ন করা যায়।
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের কটন ইউনিট অফিসার রেজাউল করিম বলেন, তুলা চাষে কৃষকদের আগ্রহ বাড়ছে। তুলা চাষের জমিতে সাথী ফসল হিসেবে বিভিন্ন শাক-সবজি চাষের চর্চা শুরু হয়েছে। এতে সফলতাও পেয়েছেন কৃষকরা। বর্তমানে ৯০ শতাংশ কৃষকই হাইব্রিড জাতের তুলা চাষ করছেন। ১০ শতাংশ কৃষক স্থানীয় জাতের তুলা চাষ করছেন। আমাদের উৎপাদিত তুলা আন্তর্জাতিক মানের। আমরা মাঠপর্যায়ে কৃষকদের তুলা চাষের পদ্ধতি শেখাচ্ছি, বলেন তিনি।
তুলা উন্নয়ন বোর্ডের নির্বাহী পরিচালকের কার্যালয় সুত্র মতে, দেশে তুলা চাষ সম্প্রসারিত করতে বিভিন্ন ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে। খাদ্যশস্য উৎপাদন যাতে ব্যাহত না হয়, এরকম জমি চিহ্নিত করা হয়েছে তুলা চাষের জন্য। তুলা চাষে কৃষকদের প্রণোদনা দিতে ১০ কোটি টাকা বরাদ্দ পাওয়া গেছে। এ বছরই সারাদেশে প্রশিক্ষিত ১২ হাজার ৩৭৫ কৃষকের মাঝে এ প্রণোদনা বিতরণ করা হয়। পাশাপাশি স্বল্পমেয়াদি জাতের তুলা চাষের প্রস্তুতি নেওয়া হয়েছে। এদিকে খাদ্যশস্য উৎপাদন ঠিক রেখে ২০৪০ সালের মধ্যে দুই লাখ হেক্টর জমি থেকে ১৫ লাখ ৮০ হাজার বেল তুলা উৎপাদনের পরিকল্পনা রয়েছে তুলা উন্নয়ন বোর্ডের।
বীজ থেকে তৈরি হচ্ছ ভোজ্য তেল ও অয়েল কেক
দেশে তুলার চাহিদা ৮৫ লাখ বেল উৎপাদন হচ্ছে মাত্র ২ লাখ
শীর্ষ সংবাদ: