.
দীর্ঘদিন বন্ধ রয়েছে আবাসিক প্রাকৃতিক ভবনগুলোতে গ্যাসের সংযোগ। ফলে বাধ্য হয়ে ভোক্তাদের ঝুঁকিতে হয়েছে তরলীকৃত প্রেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দিকে। আর এর ফলে গুটিকয়েক বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের কাছে জিম্মি হয়ে পড়েন ভোক্তারা। বাংলাদেশ এনার্জি রেগুলেটরি কমিশন (বিইআরসি) নিয়মিত দাম নির্ধারণ করে দিলেও তার তোয়াক্কা না করে নিজেদের ইচ্ছামতো দামে বিক্রি করে চলেছে।
জানা যায়, গ্যাস সংকটের কথা উল্লেখ করে ২০০৯ সালে তৎকালীন সরকার আবাসিক গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়। পরে ২০১৩ সালের শেষের দিকে আবাসিকে গ্যাস সংযোগ চালু করা হলেও ২০১৪ সালের পর জ্বালানি বিভাগ গ্যাস বিতরণ কোম্পানিগুলোকে আবাসিকের নতুন আবেদন নিতে নিষেধ করে। এরপর ২০১৯ সালে লিখিতভাবে আবাসিক সংযোগ স্থগিত রাখার আদেশ জারি করা হয়। বর্তমানে সারাদেশে বেক্সিমকোর পাশাপাশি বসুন্ধরা, ওমেরা, মেঘনা গ্রুপ অব ইন্ডাস্ট্রিজ (ফ্রেশ), এস আলম গ্রুপ, জেএমআই গ্রুপ, সিটি গ্রুপের মতো শিল্প জায়ান্টসহ প্রায় ৩০টি অপারেটর এলপিজি ব্যবসা করছে। এর বাইরেও ফ্রান্সের টোটালগ্যাজ, ডাচ পেট্রোম্যাক্স এবং হংকংয়ের কাই হেং লং গ্লোবাল এনার্জির মতো বিদেশী অপারেটরগুলোও বাজারে তাদের উপস্থিতি জানান দিয়েছে। ফলে গত এক দশকে দেশের এলপিজি বাজার উল্লেখযোগ্য হারে বড় হয়েছে।
বাজার অপারেটররা জানান, ২০১৩ সালে এলপিজির চাহিদা ছিল ৮০ হাজার টন। ২০২৩ সালের শেষ নাগাদ এই চাহিদা ১৪ লাখ টন ছাড়িয়ে যায়। অর্থাৎ এক দশকের মধ্যে এলপিজির চাহিদা বেড়েছে ১৫ গুণ। আর এটারই সুবিধা নিয়েছে গুটিকয়েক কোম্পানি। এর মধ্যে বেক্সিমকো, বসুন্ধরা, ওমেরা অন্যতম।
বর্তমান এলপিজি অপারেটরগুলোর মধ্যে সবচেয়ে বেশি স্টোরেজ ক্ষমতা রয়েছে জেএমআই গ্রুপের- ১৪ হাজার টন। স্টোরেজ সক্ষমতার দিক থেকে এরপরই আছে বিএমআই এনার্জি (১০ হাজার ৭০০ টন), ওমেরা (৯ হাজার ৬০০ টন) এবং বসুন্ধরা (৯ হাজার ৩০০ টন)।
টানা তিন মাস ঊর্ধ্বমুখী এলপিজির বাজার ॥ এদিকে কোটা সংস্কার আন্দোলনের জেরে গত আগস্ট মাসে দেশ যখন উত্তাল তখন ১১ টাকা বাড়ানো হয়েছিল তরলীকৃত পেট্রোলিয়াম গ্যাসের (এলপিজি) দাম। তখন ১২ কেজির একটি সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করা হয়েছিল ১ হাজার ৩৭৭ টাকা। এরপর সেপ্টেম্বরে একলাফে বাড়ানো হয় ৪৪ টাকা। সেপ্টেম্বর মাসের জন্য ১২ কেজির একেকটি এলপি গ্যাসের সিলিন্ডারের দাম নির্ধারণ করা হয় ১ হাজার ৪২১ টাকা। এরই ধারাবাহিকতায় অক্টোবরেও বাড়ে দাম। সেপ্টেম্বর মাসের তুলনায় অক্টোবর মাসে ১২ কেজি সিলিন্ডার গ্যাসের দাম ৩৫ টাকা বাড়িয়ে ১ হাজার ৪৫৬ টাকা নির্ধারণ করে বিইআরসি। যদিও আন্তর্জাতিক বাজারের সঙ্গে সমন্বয়ের কথা বলা হচ্ছে দাম বাড়ানোর সময়। কিন্তু সংশ্লিষ্ট অনেকেই দাবি করছেন, এলপিজির বাজারে অস্থিরতা নিয়ন্ত্রণে অনেকটা সময় লাগবে। আর তাই চাইলেও কমানো যাবে না এলপিজির মূল্য।
অস্থির বাজার ॥ ২০২১ সালের ১২ এপ্রিলের আগে পর্যন্ত এলপিজির দর ছিল কোম্পানিগুলোর ইচ্ছাধীন। ওইদিন বিইআরসি কর্তৃক দর ঘোষণার সময় বলা হয় আমদানিনির্ভর এই জ্বালানি সৌদি রাষ্ট্রীয় কোম্পানি আরামকো ঘোষিত দরকে ভিত্তি মূল্য ধরা হবে। এর পর থেকে প্রতি মাসেই এলপিজির দর ঘোষণা করে আসছে বিইআরসি। তবে বিইআরসির ঘোষিত দরে বাজারে পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ রয়েছে ভোক্তাদের। তাদের অভিযোগ হচ্ছে, বাজারে নির্ধারিত মূল্যে পাওয়া যায় না এলপিজি সিলিন্ডার। বিক্রেতারা ইচ্ছামতো দর আদায় করেন। কমক্ষেত্রেই শাস্তির আওতায় আনা হয়েছে।
অভিযোগ পাওয়া যায়, রাজধানীর প্রায় প্রতিটা এলাকার খুচরা থেকে পাইকারি এলপিজি সিলিন্ডার বিক্রেতারা সিলিন্ডার প্রতি অন্তত ২ থেকে আড়াইশ টাকা বাড়তি আদায় করেন ক্রেতাদের কাছ থেকে।
দীর্ঘদিন ধরেই কৃত্রিম সংকট দেখিয়ে ব্যবসায়ীরা নির্ধারিত মূল্যের চাইতে অনেক বেশি দাম আদায় করে নিচ্ছে বাসাবাড়িতে রান্নার কাজে ব্যবহৃত এক একটি সিলিন্ডারে। বিইআরসি নির্ধারিত মূল্যের তোয়াক্কা না করেই উৎপাদনকারী কোম্পানিসহ খুচরা পর্যায়ের বিক্রেতারা ভোক্তাদের জিম্মি করে আদায় করছেন এই অতিরিক্ত অর্থ। একেকটা সিলিন্ডার প্রতি ৩শ’ থেকে ৫শ’ টাকা বাড়তি আদায় করা যেন এখন নিয়ম হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর এর জন্য উৎপাদনকারী প্রতিষ্ঠান এবং খুচরা বিক্রেতারা দায়ী করছেন একে অপরকে। গত ফেব্রুয়ারিতে ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণের এক জরিপে বলা হয়, এক সিলিন্ডার এলপি গ্যাস কিনতেই ভোক্তাদের মাসে অন্তত ২১৫ কোটি টাকা গচ্চা দিতে হচ্ছে। সমন্বিতভাবে এই অর্থ লোপাটে নেতৃত্ব দিচ্ছে উৎপাদনকারী মিল, ডিলার এমনকি খুচরা বিক্রেতারা। যার খেসারত দিতে হচ্ছে সাধারণ গ্রাহকদের।
এমন পরিস্থিতিতে বিব্রত খোদ বিইআরসির চেয়ারম্যান জালাল আহমেদ। জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, আমরা দর ঘোষণা করে দেই। আমদানিকারকদের সঙ্গে বসেই দর চূড়ান্ত করি। ব্যবসায়ীদের অবশ্যই নতুন দাম মেনে চলবে। এক্ষেত্রে বড় ব্যবসায়ীদের সঙ্গে আলোচনা করে একটা সিদ্ধান্ত নেয়া হবে। বিশেষ করে খুচরা বিক্রেতাদের যাতে করে লাইসেন্সের আওতায় নিয়ে আসা যায় সেই ব্যবস্থা করতে হবে। নইলে বাজার তদারকি করা মুশকিল। আমরা তো মাত্র কয়দিন হলো দায়িত্ব নিয়েছি। এ বিষয়ে আশা করি খুব দ্রুত কাজ শুরু করতে পারব। এক্ষেত্রে বাজার নজরদারির কোনো ব্যবস্থা করা হবে কি না জানতে চাইলে তিনি বলেন, এলপিজির বাজার তো অনেক বড়। সুনির্দিষ্ট অভিযোগ পেলে অবশ্যই ব্যবস্থা নেওয়া হবে।
আবাসিকে পুনঃপ্রাকৃতিক গ্যাস সংযোগের গুজব ॥ এদিকে সম্প্রতি সরকারের একটি অনির্দিষ্ট কোনো সূত্রের বরাত দিয়ে কয়েকটি গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে যে, আবারও আবাসিকে প্রাকৃতিক গ্যাসের সংযোগ দিতে যাচ্ছে সরকার। যা সম্পূর্ণ ভিত্তিহীন বলে জানিয়েছে গ্যাস সরবরাহকারী সংস্থা তিতাস। বৃহস্পতিবার গণমাধ্যমে পাঠানো এক বিবৃতিতে তিতাস জানায়, সরকারি সিদ্ধান্ত অনুযায়ী বাসাবাড়িতে নতুন গ্যাস সংযোগ এবং লোড বৃদ্ধির সংযোগ বন্ধ রয়েছে। সম্প্রতি কিছু গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে নতুন সংযোগ দেওয়ার বিষয়ে সংবাদ প্রকাশিত হয়েছে। তা সম্পূর্ণ গুজব ও ভিত্তিহীন। এতে আরও বলা হয়, কিছু প্রতারক চক্র জনগণকে বিভ্রান্ত করছে। তা থেকে সংশ্লিষ্ট সকলকে সতর্ক থাকার পরামর্শ দেওয়া হয়। তা ছাড়া প্রয়োজনে গ্যাস বিতরণ কোম্পানির সঙ্গে যোগাযোগ করার জন্য অনুরোধও করা হয় বিজ্ঞপ্তিতে।