সাগরে মাছ ধরার প্রস্তুতি জেলেদের। শনিবার চট্টগ্রামের ফিশারিঘাট থেকে তোলা
আজ মধ্যরাত থেকেই শেষ হচ্ছে সাগর ও নদীতে মাছ ধরার ওপর ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা। সেই সঙ্গে হচ্ছে জেলেদের ২২ দিনের অপেক্ষার অবসান। মধ্যরাত থেকে সাগরে ইলিশ ধরতে নেমেছেন উপকূলীয় অঞ্চলের জেলেরা। তাই শেষ সময়ে সাগর যাত্রার প্রস্তুতিতে দম ফেলার ফুরসত নেই জেলেদের। চট্টগ্রাম অফিস জানায়, ইলিশ ধরতে সাগর যাত্রায় প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন উপকূলীয় মৎস্যজীবীরা। জাটকা সংরক্ষণ ও মা ইলিশ রক্ষায় ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত সাগর ও নদীতে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার। এ সময় মাছ আহরণ, পরিবহন ও বিপণন নিষিদ্ধ ছিল।
এ নিষেধাজ্ঞা বাস্তবায়নে মৎস্য বিভাগসহ প্রশাসনের সব স্তরের কর্মকর্তারা তৎপর ছিলেন। এবার নিষেধাজ্ঞা শেষে সাগর ও নদীতে নৌকা ও ট্রলারযোগে মাছ ধরা শুরু করতে যাবতীয় প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন জেলেরা। মৎস্যজীবীরা জানিয়েছেন, গেল মৌসুমে আশানুরূপ রুপালি ইলিশ শিকার হয়নি। ঋণের টাকা পরিশোধ হয়নি। একই সঙ্গে ইলিশ ধরার ব্যয়ও উঠে আসেনি। গেল মৌসুমে অমাবস্যার জো ও পূর্ণিমার জো কোনোটাতেই পর্যাপ্ত ইলিশ মেলেনি। জেলেদের আশা এবার সাগরে জাল ফেললেই ঝাঁকে ঝাঁকে ইলিশ ধরা পড়বে।
এদিকে, সাগর যাত্রার প্রস্তুতি হিসেবে জাল, জ্বালানি তেল, বরফ, চাল, ডালসহ খাবার পানি গুছিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন চট্টগ্রাম উপকূলের লক্ষাধিক জেলে। একই সঙ্গে ট্রলারের যাবতীয় মেরামত, তৈরি করা নতুন জাল, নৌকায় তোলা, পুরনো জাল, সেলাইসহ সমুদ্রে মাছ ধরার সব প্রস্তুতি এরই মধ্যে শেষ হয়েছে। চট্টগ্রামের ফিশারিঘাট, ব্রিজঘাট, অভয়মিত্র ঘাট, আনোয়ারা, বাঁশখালী, সীতাকু-, মীরসরাই এবং কাট্টলীসহ প্রত্যেক উপকূলীয় অঞ্চলে নৌযান নিয়ে সাগরে নামার অপেক্ষায় রয়েছেন জেলেরা।
গত মৌসুমে একের পর এক বৈরী আবহাওয়ায় মাছ শিকারে প্রতিবন্ধকতা তৈরি হয়েছিল। একই সঙ্গে নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধি ও জ্বালানি তেলের মূল্য বৃদ্ধিসহ বিভিন্ন সমস্যায় বেহাল অবস্থায় ছিল জেলেদের। ফলে ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞায় অর্থ কষ্ট ও অনাহারে দিন কাটিয়েছেন মৎস্যজীবীরা। তাই এবার এক বুক আশা নিয়ে লাখ লাখ জেলে সাগরে মাছ ধরা শুরু করবে।
ভোলা থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, আজ রবিবার মধ্যরাত থেকে শুরু হচ্ছে ভোলার মেঘনা-তেঁতুলিয়া নদীতে মাছ ধরা। ভোলা জেলার দুই লক্ষাধিক জেলে নতুন উদ্যোমে মাছ ধরার জন্য প্রায় সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। মৎস্য ঘাট ও জেলে পল্লীতে উৎসবের আমেজ। জেলেরা তারা এখন বিগত দিনের ধারদেনা কাটিয়ে ঘুরে দাঁড়ানোর স্বপ্ন দেখছেন।
সরেজমিনে ভোলা সদর উপজেলার ইলিশা মেঘনা নদীর তীরে মাছঘাটে গিয়ে দেখা যায়, কেউ নৌকা মেরামত করছেন। কেউবা ট্রলারে আলকাতরা রং করে শেষ সময়ের ইঞ্জিনের খুঁটিনাটি ত্রুটিগুলো পরীক্ষা-নিরীক্ষা করে দেখছেন। জেলেরা তাদের নৌকা, জাল গুছিয়ে সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছেন। রবিবার রাত ১২টার পর নদীতে মাছ ধরতে নেবে যাবেন। প্রচুর পরিমাণে ইলিশ পেলে ২২ দিনের ক্ষতি পুষিয়ে সকল ধার-দেনা কাটিয়ে ওঠার স্বপ্ন দেখছেন জেলেরা।
মৎস্য আড়তগুলোতে আবার প্রাণচাঞ্চল্য ফিরে আসবে এমনটাই মনে করছেন আড়তদাররা। মৎস্য বিভাগ জানিয়েছে, ইলিশের প্রধান প্রজজন মৌসুমে মা ইলিশ রক্ষার জন্য গেল ১৩ অক্টোবর থেকে ভোলার মেঘনা ও তেঁতুলিয়া নদীতে সকল ধরনের মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞার জারি করা হয়। মাছ ধরা বন্ধ থাকায় ভোলার দুই লক্ষাধিক জেলে বেকার হয়ে পড়ে। বিকল্প কোনো কর্মসংস্থান না থাকায় পরিবার পরিজন নিয়ে গত ২২ দিন জেলেরা চরম দুর্ভোগে দিন কাটে। অনেকে ঋণগ্রস্ত হয়ে ধার-দেনা করে সংসার চালিয়েছে। এখন সময় এসেছে ক্ষতি পুষিয়ে নেওয়ার।
মৎস্য বিভাগের হিসাবে, ভোলায় নিবন্ধিত জেলের সংখ্যা এক লাখ ৬৮ হাজার ৬৪৭ জন। এর মধ্যে নিষেধাজ্ঞাকালীন সরকারি ভিজিএফের ২৫ কেজি করে চাল বরাদ্দ দেওয়া হয় ১ লাখ ৪০ হাজার ৯০০ জেলের জন্য। নিবন্ধিত জেলের বাইরে আরও লক্ষাধিক জেলে রয়েছেন। তাই সকল জেলের ভাগ্যে চাল জোটেনি। অভাব অনটনে কেটেছে তাদের সংসার। অন্যদিকে এনজিওর সাপ্তাহিক কিস্তি নেওয়া বন্ধ রাখার নির্দেশ থাকা সত্ত্বেও বন্ধ ছিল না কিস্তির টাকা তোলা।
তাই ভোগান্তির মাত্রা আরও বাড়িয়ে তুলেছিল বলে জানান জেলেরা। তারা বলছেন, কাক্সিক্ষত ইলিশ জালে ধরা পড়লে বিগত সকল ধার-দেনা কাটিয়ে উঠতে পারবে এমনটাই প্রত্যাশা জেলে ও আড়তদারদের। তারা বলেন, প্রকৃত জেলেদের শনাক্তকরণের মাধ্যমে নতুন করে জেলে কার্ডের তালিকা প্রণয়ন কর যাতে হয়। পাশাপাশি ইলিশের উৎপাদন রক্ষায় নদীতে বাধা ও খুঁটি-জাল অপসারণে দাবিও জানান জেলেরা।
জেলা মৎস্য কর্মকর্তা বিশ্বজিৎ কুমার দেব সাংবাদিকদের জানান, জেলেদের ও প্রশাসনের সহযোগিতায় ২২ দিনের মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান সফলভাবে সম্পন্ন হয়েছে। তাই এ অর্থ বছরে ইলিশ উৎপাদনে যে লক্ষমাত্রা তা অর্জিত হবে বলে আশা করেন এ কর্মকর্তা। মৎস্য বিভাগের তথ্য অনুযায়ী এ অর্থবছরে ভোলায় ১ লাখ ৮৫ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ উৎপাদন লক্ষমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। ইতোমধ্যে সেপ্টেম্বর ২০২৪ মাস পর্যন্ত ৬৮ হাজার মেট্রিক টন ইলিশ এ জেলায় উৎপাদন হয়েছে।
বরগুনা থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, সরকারি নিষেধাজ্ঞা শেষে জেলেসহ মৎস্য সংশ্লিষ্টরা এখন মাছ ধরার স্বপ্নে বিভোর। জেলেদের আশা, এবার তাদের জালে ধরা পড়বে কাক্সিক্ষত ইলিশ। প্রস্তুত তারা।
সরেজমিন দেখা যায়, নিষেধাজ্ঞার শেষ সময়ে জাল-দড়ি গুছিয়ে প্রস্তুতি নিচ্ছেন বরগুনা উপকূলের লক্ষাধিক জেলে। জেলেরা জানান, একের পর এক বৈরী আবহাওয়ায় চলতি ইলিশ মৌসুমে ব্যাপক লোকসানের মুখে পড়েছেন তারা। এ ছাড়াও জ্বালানি তেলসহ নিত্যপণ্যের দাম বৃদ্ধিতে যখন বেহাল অবস্থা। ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞায় বেকার হয়ে পড়েছেন অনেক জেলে।
রবিবার মধ্যরাতে নিষেধাজ্ঞা শেষ হবার সঙ্গে সঙ্গে মাছ শিকার শুরু করবেন তারা। এর আগে গত ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ইলিশ আহরণ, পরিবহন, মজুত, বাজারজাতকরণ, ক্রয়-বিক্রয় নিষিদ্ধ ঘোষণা করে সরকার।
প্রতি বছর আশ্বিন মাসের পূর্ণিমার শেষের দিকে (১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর) গভীর সমুদ্র থেকে নদীর মোহনায় এসে ডিম ছাড়ে মা ইলিশ। ইলিশের বাধাহীন প্রজননের জন্য ওই সময়টাতে সাগর ও নদীতে মাছ ধরার ওপর নিষেধাজ্ঞা আরোপ করে সরকার।
সরকার ঘোষিত ২২ দিনের নিষেধাজ্ঞা শেষ হচ্ছে রবিবার রাত ১২টায়। ট্রলার মেরামত, নতুন জাল তৈরি ও পুরনো জাল সেলাইসহ সমুদ্রে মাছ ধরার সব প্রস্তুতি শেষ করে অপেক্ষায় আছেন উপকূলের জেলেরা। সাগরে ৮-১০ দিন অবস্থান করার মতো খাবারও প্রস্তুত করা হচ্ছে।
একই অবস্থা কূয়াকাটা উপকূলে। কেউ ট্রলার মেরামত করছেন, কেউ ট্রলারে রং করছেন, কেউ ট্রলার ধোয়া মোচা করছেন, কেউবা আবার জাল বুনছেন, কেউ কেউ ট্রলারে জালসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম তুলছেন। এভাবেই সাগর যাত্রায় প্রস্তুতি নিতে ব্যস্ত সময় পার করছেন জেলেরা। এখন ইলিশের সন্ধানে সাগরে যাওয়ার অপেক্ষায় আছেন উপকূলের মৎস্যজীবীরা।
কলাপাড়া উপজেলার গঙ্গামতি এলাকার জেলে মমিন উদ্দিন বলেন, অবরোধ মেনে আমরা এই ২২ দিন কর্মহীন সময় পার করেছি। এই নিষেধাজ্ঞার সময় আমাদের মাত্র ২৫ কেজি চাল দেওয়া হয়েছে। পরিবারের ৫ জন্য সদস্য এই চাল দিয়ে কিছুই হয়নি। তাই এই ২২ দিনে ৭ থেকে ৮ হাজার টাকার মতো দেনায় পড়েছি। সরকারের কাছে প্রণোদনার চাল বাড়ানোর দাবি জানাচ্ছি।
পটুয়াখালীর কলাপাড়া উপজেলার উপকূলীয় অঞ্চলের হাজার হাজার জেলে তাদের সব ধরনের প্রস্তুতি এরই মধ্যে সম্পন্ন করেছেন। আলীপুর, মহিপুর ও কুয়াকাটা অঞ্চলের জেলেরা তাদের ট্রলার ও জাল মেরামতের পাশাপাশি ইঞ্জিনের কাজে শেষ সময়ের প্রস্তুতি নিচ্ছেন।
আলীপুরের জেলে একলাস গাজী বলেন, সরকারি প্রণোদনার তালিকায় প্রকৃত অনেক জেলের নাম নেই। যারা অন্য পেশায় জড়িত দেখেছি তারা সরকারি চাল পেয়েছে। তাই প্রণোদনার তালিকায় প্রকৃত জেলেদের নাম অন্তর্ভুক্ত করার দাবি জানাচ্ছি।
অপর এক জেলে আলী হোসেন বলেন, আগামীকাল রাতে আমরা গভীর সাগরের উদ্দেশে যাত্রা করব। তাই ট্রলারে জাল ও বরফসহ আনুষঙ্গিক সরঞ্জাম তুলছি। গতকাল আমাদের ট্রলারের রং করার কাজ শেষ হয়েছে।
উপজেলা মৎস্য অফিস সূত্র জানা গেছে, কলাপাড়ার নিবন্ধিত ১৮ হাজার ৩০৭ জন জেলে রয়েছেন । অবরোধ চলাকালে প্রত্যেককে ২৫ কেজি করে সরকারি প্রণোদনার চাল দেওয়া হয়েছে। অবরোধ শতভাগ সফল করতে সাগর ও নদীতে উপজেলা প্রশাসন, মৎস্য বিভাগ, নৌ-পুলিশ, কোস্ট গার্ড ও নৌবাহিনী ব্যাপক অভিযান পরিচালনা করেছেন।
উপজেলা ফিশিং ট্রলার মাঝি সমবায় সমিতির সভাপতি মো. মন্নান মাঝি বলেন, দেশের জেলেরা অবরোধ পালন করেছেন। প্রশাসন ভারতীয় জেলেদের আটক করেছেন। আশা করছি অবরোধ শেষে জালে কাক্সিক্ষত ইলিশ মাছ ধরা পড়বে। সাগরে কাক্সিক্ষত মাছ পেলে পেছনের ধার-দেনা কাটিয়ে উঠতে পারব। আমরা সাগরে যাওয়ার সকল প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছি।
প্রতি বছর আশ্বিন মাসের পূর্ণিমার শেষের দিকে গভীর সমুদ্র থেকে নদীর মোহনায় এসে ডিম ছাড়ে মা ইলিশ। তাই ২০০৬ সাল থেকে মা ইলিশ রক্ষায় ২২ দিন অবরোধ দিয়ে আসছে সরকার। এ সময় সব ধরনের মাছ শিকার, পরিবহন, মজুত, ক্রয়-বিক্রয় ও বিনিময় নিষিদ্ধ করেছে মৎস্য অধিদপ্তর। এবার প্রশাসনের তৎপরতা বেশি থাকায় উপকূলজুড়ে মাছ ধরা পুরোপুরি বন্ধ রয়েছে। এদিকে অবরোধের সময় বাংলাদেশের জলসীমানায় ঢুকে মাছ শিকারের দায়ে ভারতীয় জেলেদের আইনের আওতায় এনেছেন। এর জন্য প্রশাসনকে সাধুবাদ জানিয়েছেন জেলে ও মৎস্যজীবীরা।
মহিপুর মৎস্য আড়ত মালিক সমিতির সভাপতি মো. ফজলু গাজী বলেন, যেহেতু নিষেধাজ্ঞার আগে মাছ ধরা পড়েনি, তাই আমরা আশা করছি নিষেধাজ্ঞা শেষে বড় সাইজের পর্যাপ্ত ইলিশের দেখা মিলবে।
কলাপাড়া সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা অপু সাহা জানান, উপকূলের জেলেরা নিজেরাই অনেকটা সচেতন হয়েছেন। আমরা এ পর্যন্ত যৌথ অভিযান চালিয়ে ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে ভারতীয় জেলেদের জরিমানা আদায় এবং জালসহ তাদের ট্রলার জব্দ করেছি। তিনি আরও বলেন, আমরা দিন-রাত মা ইলিশ রক্ষায় কাজ করেছি। আশা করছি, আমরা এ বছর শতভাগ সফল হয়েছি। কারণ হিসেবে তিনি উল্লেখ করেন, গত পূর্ণিমা ও অমাবস্যার জোতে প্রচুর পরিমাণে বৃষ্টি হয়েছে।
বৃষ্টি হলে সব ডিমওয়ালা মা মাছ দ্রুত ডিম ছেড়ে দেয়।’ মধ্য রাত থেকে শরীয়তপুরের জাজিরার নাওডোবা থেকে গোসাইরহাটের মাঝের চর পর্যন্ত পদ্মা-মেঘনার ৮০ কিলোমিটার নদীতে মাছ শিকার করতে নামবেন জেলেরা। অভিযান সফল হওয়ায় আগামীতে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে বলে মনে করছেন জেলা মৎস্য বিভাগ।
ইলিশের প্রজনন নির্বিঘœ করতে ১৩ অক্টোবর থেকে আগামী ৩ নভেম্বর পর্যন্ত ২২ দিন পদ্মা-মেঘনা নদীতে ইলিশ ধরা নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছে সরকার। এ সময়ে ইলিশ বিক্রি, মজুত ও বাজারজাতকরণও নিষিদ্ধ করা হয়েছে। জেলা টাস্কফোর্স কমিটি শরীয়তপুরের ৮০ কিলোমিটার পদ্মা নদীর অংশে নিয়মিত অভিযান পরিচালনা করছে। ৩ নভেম্বর থেকে ইলিশ শিকারে নামবে জেলেরা। মাছ শিকারের প্রস্তুতিতে নিষেধাজ্ঞার শেষ মুহূর্তে ব্যস্ত সময় কাটছে শরীয়তপুরের জেলে পল্লীগুলোতে। জাল আর মাছ ধরার নৌকা মেরামত করে আগেই প্রস্তুতি সেরে নিচ্ছেন তারা। পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা হয়েছে নদীর পাড়ের মাছের আড়তগুলো।
জেলা মৎস্য বিভাগ সূত্রে জানা যায়, মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান বাস্তবায়ন উপলক্ষে ২০ হাজার জেলে পরিবারকে নিরাপদ জীবনযাপনের জন্য ২৫ কেজি করে ৫০০ মেট্রিক টন ভিজিএফ চাল বরাদ্দ দিয়েছেন। তবে জেলায় ২৫ হাজার ৮২৬ জন নিবন্ধিত জেলে রয়েছেন। মা ইলিশ সংরক্ষণ অভিযান সফল করতে কাজ করছেন জেলা-উপজেলা প্রশাসন, পুলিশ ও মৎস্য বিভাগ।
জয় নামের এক জেলে বলেন, অভিযানের সময় আমরা মাছ ধরা বন্ধ রেখেছেন। অভিযান শেষে মাছ ধরার প্রস্তুতি নিচ্ছি এখন। তবে অভিযানের সময় যে সহযোগিতা পেয়েছি তা আমাদের জন্য পর্যাপ্ত নয়। আরেক জেলে বলেন, মাছ ধরেই আমাদের জীবন চলে। এই অভিযানের সময় আমরা মাছ ধরি না। তাই সরকারের পক্ষ থেকে আমাদের জন্য চালের ব্যবস্থা করে। এর পাশাপাশি অন্য কিছুর ব্যবস্থা করলে ভালো হতো।
জেলা সহকারী মৎস্য কর্মকর্তা আব্দুল্লাহ আল মাহমুদ বলেন, অভিযান সফল হওয়ায় আগামীতে ইলিশের উৎপাদন বৃদ্ধি পাবে বলে জানান তিনি।
বাগেরহাট, মোরেলগঞ্জ থেকে নিজস্ব সংবাদদাতা জানান, মধ্য রাত থেকেই সাগরে মাছ ধরতে যাচ্ছেন বাগেরহাটের মোরেলগঞ্জের কয়েক হাজার জেলে। শত কষ্টের মাঝেও চোখে মূখে তৃপ্তির হাসি নিয়ে জেলেদের ঘরে ঘরে বইছে আনন্দের উৎসব। মহাজনদের কাছ থেকে দাদন নিয়ে জাল নৌকা মেরামত শেষে সাগরে যাওয়ার প্রস্তুতি। তবুও স্বপ্ন বুনছেন তারা একটু সুখের আশায়।
সরেজমিন খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, উপজেলার বলইবুনিয়া-পুটিখালী ইউনিয়নের শ্রেণীখালী, দোনা ও সোনাখালী গ্রামের অর্ধ শতাধিক নৌকা-ট্রলার মেরামত শেষে সাগরে যাওয়ার প্রস্ততি নিচ্ছেন শত শত জেলে। ১৩ অক্টোবর থেকে ৩ নভেম্বর ২২ দিন অবরোধ শেষে রবিবার মধ্য রাত থেকে সাগরে মাছ ধরবেন তারা। মৌসুমের শুরুতেই নভেম্বর থেকে ৫ মাস সাগরে কাটাতে হবে শুঁটকি জেলেদের। সোনাখালী গ্রামের ২০ জেলে ট্রলার বহাদ্দর এদের প্রতি ট্রলারে ১৫-২০ জন করে বেতনভোগী শ্রমিক, চালকেরই বেতন দেড় লাখ টাকা।
বাকি কোনো কোনো শ্রমিকদের ৬০ হাজার থেকে ১ লাখ টাকা এক সিজনে দিতে হবে। এ বছর সাগরে যাওয়ার শুরুতেই ট্রলার মালিকরা সৈয়দপুর ও খুলনার মহাজনদের কাছে থেকে ট্রলার প্রতি ৬ লাখ টাকা নিয়েছেন দাদন। অন্যদিকে তাদের ট্রলারে বেতনে থাকা শ্রমিকদের অর্ধেক টাকা অগ্রিম দিয়ে নিতে হচ্ছে সাগরে। জেলেদের স্বপ্ন, প্রাকৃতিক দুর্যোগ না হলে মহাজনদের টাকা পরিশোধ করে কিছুটা লাভবান হতে পারেন। তবে স্বপ্ন শুধু স্বপ্নই থেকে যায় বছর পর বছর।
মহাজনদের দেনা কাঁধে নিয়ে অনেকেই ছেড়েছেন পেশা। বংশ পরম্পরায় যুগের পর যুগ, দাদার পর পিতা এখন ছেলে যাচ্ছেন সাগরে। কালের বিবর্তনে আধুনিকতার ছোঁয়ায় মৎস্য সম্পদ বৃদ্ধি হলেও পরিবর্তন হয়নি জেলেদের জীবন যাত্রার মান। জেলেরা বলছেন, এতটুকুই পরিবর্তন হয়েছে, আগে সাগরে যেতাম নৌকা নিয়ে, এখন যাচ্ছি ট্রলার নিয়ে।
এ রকম কথা হয় সোনাখালী গ্রামের ট্রলারের মালিক সাগরের জেলে আলমাছ খান, সবুর হাওলাদার, সেকেন্দার আলী খান, আঃ রহিম খান, ফারুক খান, দুলাল শেখ, বাদশা শেখ, এছাহাক আলী শেখ, বিটুল শিকদার, মুসা হাওলাদার, খলিল শেখ। শ্রেণীখালী গ্রামে সাখাওয়াত হোসেন ধলাই, এমদাদুল খান, মহারাজ খান, সরোয়ার খান। দোনা গ্রামের সুলতান শেখ, আশ্রাব আলী শেখ, মুনসুর আলী শেখ ও অবায়দুল শেখের সাথে। তারা বলেন, বাপ দাদার আমল থেকেই এ পেশার সঙ্গে।
যুগের পর যুগ কেটে গেলেও ভাগ্যের পরিবর্তন হলো না। ছেলেমেয়েদের ভাগ্যে কি আছে জানি না। মহাজনদের দাদনের টাকা না পেলে ব্যবসা বন্ধ। দেনা কিভাবে শোধ করব। সরকার সব পেশার মানুষের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তন করলেও আমাদের ক্ষেত্রে শুধু কয়েক কেজি চাল। তাও আবার বিতারণের ক্ষেত্রে চরম অনিয়ম, টাকা না দিলে তালিকায় যাচ্ছে না নাম। সরকারের প্রতি দাবী খাদ্য সহায়তা বৃদ্ধি, প্রকৃত জেলেদের তালিকায় অন্তর্ভুক্তকরণ। মহাজনদের কাছ থেকে বছরে যে টাকা দাদন আনতে হয়, সেই পরিমাণ টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে বিনা সুদে ঋণের ব্যবস্থা করা।
তা হলেই আর সাগর নির্ভরশীল জেলেদের এ পেশা ছেড়ে যেতে হবে না। এ বিষয়ে সিনিয়র উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা রণজিৎ কুমার বলেন, এ উপজেলায় প্রায় ১১ হাজার নিবন্ধিত জেলে রয়েছে। এদের মধ্যে সাগরে নির্ভরশীল ৪ হাজার ৪৩৪ জেলে পরিবারকে অবরোধকালীন সময়ে সরকারিভাবে খাদ্য সহায়তা প্রদান করা হয়। তবে জেলেদের জীবনযাত্রার মান পরিবর্তনের জন্য মৎস্য অধিদপ্তরের পরিকল্পনা অনুযায়ী সরকারের নানামুখী পদক্ষেপ অব্যাহত রয়েছে।