.
বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড- পিডিবির কাছে ভারতের আদানি পাওয়ার ঝাড়খ- লিমিটেডের (এপিজেএল) পাওনা ৮৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার। অন্তর্বর্তী সরকার মাঝখানে কিছু পরিশোধ করলেও তা মূল পাওনার চাইতে খুবই স্বল্প দাবি করে বাংলাদেশে বিদ্যুৎ সরবরাহ অর্ধেকে নামিয়ে এনেছে কোম্পানিটি। ফলে জাতীয় গ্রিডে পাওয়া যাচ্ছে প্রায় ৭০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ। কিন্তু চাহিদার তুলনায় বর্তমানে বিদ্যুতের সরবরাহ পর্যাপ্ত রয়েছে দাবি করে বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, আদানির সরবরাহ বন্ধেও খুব একটা নেতিবাচক প্রভাব পড়বে না জাতীয় গ্রিডে।
তবে অভিযোগ পাওয়া গেছে গত বৃহস্পতিবার মধ্যরাত থেকে দেশের বিভিন্ন এলাকায় লোডশেডিং বেড়েছে। বিশেষ করে উত্তর-পূর্বাঞ্চল ও মধ্যাঞ্চলে অসহনীয় ছিল লোডশেডিং। বিদ্যুৎ বিভাগ আদানি কর্তৃপক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার চেষ্টা করছে। তবে আদানির স্বার্থরক্ষার এই চুক্তি বাতিল করার আহ্বান জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। সরকার যদি বাতিল না করে তা হলে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) আদালতে যাওয়ার হুঁশিয়ারিও দিয়েছে।
বাংলাদেশে নিযুক্ত আদানির এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে জানান, সময়মতো বকেয়া বিল না পাওয়ায় এই পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। আন্তর্বর্তী সরকারকে বারবার চাপ দিয়েও তারা বকেয়া আদায় করতে পারছে না বলে দাবি করেন তিনি। তাই ১ হাজার ৪৯৬ মেগাওয়াট ক্ষমতাসম্পন্ন বিদ্যুৎকেন্দ্রটি বর্তমানে একটি ইউনিট থেকে ৭০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদন করছে, যা জাতীয় উৎপাদনকে প্রভাবিত করেছে। পিডিবি বলছে, গত বৃহস্পতিবার রাতে দেশজুড়ে ১ হাজার ৬০০ মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হয়েছে। বকেয়া বিল আদায়ের লক্ষ্যে গত ২৭ অক্টোবর পিডিবিকে চিঠি দেয় আদানি কর্তৃপক্ষ। ওই চিঠিতে ৩০ অক্টোবরের মধ্যে বকেয়া পরিশোধ করতে বলে এপিজেএল। কিন্তু নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে বিল না পাওয়ায় ৩১ অক্টোবর বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে বিদ্যুৎ ক্রয় চুক্তির (পিপিএ) আওতায় প্রতিকারমূলক ব্যবস্থা নিয়েছে জানিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বাংলাদেশে কর্মরত আদানির এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, এখন পর্যন্ত পিডিবি বাংলাদেশ কৃষি ব্যাংক থেকে ১৭ কোটি ৩০ হাজার ডলারের ঋণপত্র দেওয়া হয়নি ও বকেয়া ৮৪ কোটি ৬০ লাখ ডলার পরিশোধ করেনি। তিনি বলেন, খোদ গৌতম আদানি প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস বরাবরে বকেয়া পরিশোধের জন্য চিঠি দিয়েছেন। কিন্তু তাতেও কাজ না হওয়ায় এই কঠিন সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে।
তবে পিডিবি বলছে, অন্তর্বর্তী সরকার ক্ষমতায় আসার পর এর আগের বকেয়ার একটি অংশ পরিশোধ করা হয়েছিল। তবে জুলাই থেকে আগের মাসগুলোর চেয়ে বেশি চার্জ নিচ্ছে আদানি। পিডিবি সপ্তাহে ১৭ থেকে ১৮ মিলিয়ন ডলার পরিশোধ করছে, যেখানে চার্জ হচ্ছে ২২ মিলিয়ন ডলারের বেশি। এ কারণেই বকেয়া বিল আবার বেড়েছে। এ ছাড়া কৃষি ব্যাংককে গত সপ্তাহের পেমেন্ট জমা দেওয়া হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ভারতীয় সব বিদ্যুৎকেন্দ্রের বকেয়া বিল পরিশোধে ব্যাংকে এক হাজার কোটি টাকা জমা দিয়ে রেখেছে পিডিবি। তবে ডলার সংকটের কারণে ব্যাংক নিয়মিত বিল পরিশোধ করতে পারছে না। আর আদানি কয়লার বাড়তি দাম ধরে বিল জমা দিলেও সেটি এখন পর্যন্ত আমলে নিচ্ছে না পিডিবি। প্রয়োজনে চুক্তি সংশোধন করার ব্যবস্থা করতে হবে।
আদানি পাওয়ার লিমিটেডের প্রতিনিধি ও যৌথ সমন্বয় কমিটির সভাপতি এম. আর. কৃষ্ণ রাও এক বিদেশী সংবাদ মাধ্যমে দেওয়া স্বাক্ষাৎকারে বলেছেন, সময়মতো এলসি না দেওয়া এবং বকেয়া পরিশোধ না করার ফলে পাওয়ার পার্চেজ অ্যাগ্রিমেন্টের আওতায় ‘মেটেরিয়াল ডিফল্ট’ ঘটেছে, যা আদানি পাওয়ারের সরবরাহ বজায় রাখতে বাধা দিচ্ছে। তিনি আরও বলেন, বহু বকেয়া পরিশোধ ও এলসির অভাবে আমরা কয়লা সরবরাহকারী এবং অপারেশন ও রক্ষণাবেক্ষণ কন্ট্রাক্টরদের জন্য কাজের মূলধন নিরাপদে রাখতে পারছি না, আমাদের ঋণদাতারাও সহায়তা প্রত্যাহার করছে।
তবে বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বিদ্যুৎকেন্দ্রে ব্যবহৃত কয়লার বাড়তি দাম ধরে হওয়া চুক্তির একতরফা সুযোগ নিচ্ছে কোম্পানিটি। উৎপাদন শুরুর আগেই কয়লার দাম নিয়ে বিতর্ক হলেও বিগত সরকার চুক্তিটি করে তৎকালীন নানান স্বার্থ বিবেচনায়। কয়লার বাড়তি দাম দিতে পিডিবি অস্বীকৃতি জানালেও দাম কমাতে রাজি হয়নি আদানি। পায়রা ও রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রের চাইতে কম দামে কয়লা সরবরাহের প্রতিশ্রুতি দিলেও এক বছর পর এখন আবার ২২ শতাংশ বাড়তি দাম চাইছে আদানি।
কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, পটুয়াখালীর পায়রায় নির্মিত ১ হাজার ৩২০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎকেন্দ্র প্রতি টন কয়লার দাম নিচ্ছে ৭৫ মার্কিন ডলার। চট্টগ্রামের এস এস পাওয়ার বিদ্যুৎকেন্দ্র ও বাগেরহাটের রামপাল বিদ্যুৎকেন্দ্রে প্রতি টন কয়লার দাম ৮০ ডলারের কম। অথচ আদানি প্রতি টন কয়লার দাম চাইছে ৯৬ ডলার। তার মানে প্রতি টন কয়লায় গড়ে ২১-১৬ ডলার বাড়তি চাইছে তারা। তাদের সঙ্গে চুক্তিতে অনেক ধরনের বাড়তি খরচ ধরা হয়েছে। পদে পদে সুবিধা নিয়েছে তারা। এর ফলে দেশ থেকে বিপুল পরিমাণ ডলার নিয়ে যাচ্ছে আদানি। এটি একটি একতরফা চুক্তি, সেই সুযোগটাই নিচ্ছে আদানি। তাই এ চুক্তি থেকে অবিলম্বে সরে আসা দরকার সরকারের। সরকার বাতিল করতে না পারলে আদালতে যাবে ক্যাব।
বিদ্যুৎ বিভাগ ও আদানি বিদ্যুৎকেন্দ্রের একটি সূত্র মতে, প্রতি সপ্তাহে আদানির বিল পাওনা হচ্ছে ২ কোটি ২০ লাখ থেকে আড়াই কোটি ডলার। এর বিপরীতে পিডিবি তাদের পরিশোধ করছে ১ কোটি ৮০ লাখ ডলারের মতো। আগে পরিশোধের পরিমাণ আরও কম ছিল। এতে অক্টোবর পর্যন্ত তাদের বকেয়া দাঁড়িয়েছে প্রায় ৮৫ কোটি ডলার।
তবে শুধু আদানি নয় একইসঙ্গে উৎপাদন কমিয়ে দিয়েছে আরও কয়েকটি পাওয়ার প্ল্যান্টও। কয়লার অভাবে বন্ধ রয়েছে মাতারবাড়ী বিদ্যুৎকেন্দ্র। বকেয়া জটিলতায় উৎপাদন কমেছে রামপাল ও বাঁশখালী বিদ্যুৎকেন্দ্রে। এতে গত বৃহস্পতিবার ঘণ্টায় দেড় হাজার মেগাওয়াটের বেশি লোডশেডিং হয়েছে। এতে করে দেশে আবারও লোডশেডিং তীব্র হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।
তবে এই আশঙ্কা নাকচ করে দিয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান বলেছেন, চাহিদার তুলনায় আমাদের যথেষ্ট সরবরাহ রয়েছে। সংকট কিছুটা হবে। কিন্তু লোডশেডিংয়ের তীব্রতা এত বেশি হবে বলে আমরা মনে করছি না। তিনি বলেন, আদানি বিল জমা দিলেই হবে না। বাড়তি দাম দেওয়ার প্রশ্নই ওঠে না। কয়লার বাড়তি দামের বিষয়টি পিডিবি দেখবে। আন্তর্জাতিক নিয়ম মেনে পেশাদারির সঙ্গে নিরপেক্ষতা বজায় রেখেই চুক্তির বিষয়গুলো দেখা হবে। ইতিমধ্যে চুক্তি পর্যালোচনা কমিটি এ নিয়ে কাজ শুরু করেছে। দেশের স্বার্থ অক্ষুণœ রেখে আমরা যেকোনো সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।