.
স্কুল আছে। কিন্তু পর্যাপ্ত শিক্ষার্থী নেই। আবার কখনো পাশেই রয়েছে বড় স্কুল এন্ড কলেজ। সেখানে শিক্ষার্থীরও অভাব নেই। কিন্তু সংসদ সদস্যের ইচ্ছায় কোনো নিয়ম নীতির তোয়াক্কা করা হয়নি। বরং সারাদেশে অপ্রয়োজনীয় প্রকল্পের একটা বড় অংশ ব্যয় হয়েছে শিক্ষা ব্যবস্থায়। শিক্ষার মৌলিক উন্নয়নে যেখানে সরকারের নজর দেওয়ার কথা ছিল, সেটি না করে বড় বড় ভবন নির্মাণ করেই উন্নয়ন দেখানো হয়েছে। সেক্ষেত্রে প্রতিটি সংসদীয় এলাকায় সংসদ সদস্যের খায়েশ বাস্তবায়নে একটি প্রকল্প নেয় শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর। যার নাম নির্বাচিত বেসরকারি মাধ্যমিক বিদ্যালয় উন্নয়ন প্রকল্প। প্রকল্পের নামে নির্বাচিত হলেও মূলত এমপিদের ইচ্ছা অনুযায়ীই স্কুলগুলো করা হয়েছে। এক্ষেত্রে ৩০০ আসনের প্রত্যেক সংসদ সদস্য ১০টি করে স্কুল করার সুযোগ পেয়েছেন। স্কুল নির্মাণের জন্য জায়গা, শিক্ষার্থী সংখ্যা, ভবনের প্রয়োজনীয়তা, বিদ্যালয়ের ফল কোনো কিছুই বিবেচনায় নেওয়া হয়নি। বরং সুপারভিশনের নামে নামকাওয়াস্তে একটি সম্ভাব্যতা যাচাই করে সারাদেশে তিন হাজার স্কুল বাস্তবায়ন করা হচ্ছে। আর এমপিদের ইচ্ছাতে ব্যয় করা হচ্ছে প্রায় ১১ হাজার কোটি টাকা। প্রকল্পের দীর্ঘসূত্রতার কারণে এর ব্যয় আরও বৃদ্ধির সম্ভাবনার কথা খোদ শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তর (ইইডি) থেকে জানানো হয়েছে।
এ বিষয়ে শিক্ষা মন্ত্রণালয়ের উচ্চ শিক্ষা বিভাগের সচিব সিদ্দিক জোবায়ের জনকণ্ঠকে বলেন, শিক্ষার শুধু এই প্রকল্পেই সমস্যা নয়। প্রতিটি প্রকল্পেই সমস্যা রয়েছে। তবে আমরা এখন ভাবছি যে প্রকল্পগুলোর ভবন নির্মাণের কাজ শেষ বা শেষ পর্যায়ে সেগুলো সম্পন্ন করব। বাকি কোনো প্রকল্প পাস হয়ে জমি অধিগ্রহণ হওয়ার পরও যদি ভবনের কাজ শুরু না হয়, তবে সেগুলোতে আমরা আর এগোব না।
শিক্ষা প্রকৌশলের প্রধান প্রকৌশলী (রুটিন দায়িত্ব) রায়হান বাদশা। এই প্রকৌশলীকে শিক্ষা সচিব জিজ্ঞাসা করেছিলেন, আপনারা প্রকল্পের মেয়াদ নির্ধারণ করেন। এর পরও কেন নির্দিষ্ট সময়ে কাজ শেষ হয় না। জানা যায়, এ বিষয়ে রায়হান বাদশা কোনো সদুত্তর দিতে পারেননি।
তবে শিক্ষা সচিব জানান, এর পর কোনো কাজের সম্ভাব্যতা যাচাই আর শিক্ষা প্রকৌশল করবে না। তাদের পছন্দের ঠিকাদারদের দিয়েও কাজ করানো হবে না। এ বিষয়ে বড় একটি পরিবর্তন আসবে। তবে চলমান প্রকল্পের ক্ষেত্রে তিনি বলেন, যেসব জায়গায় স্কুল হয়েছে, হোস্টেল হয়েছে ওসব স্কুলের জন্য আববাবপত্র, আইসিটি সামগ্রী কেনা হবে। এ ছাড়া আগামীতে শিক্ষায় খুব বড় প্রকল্প আসারও তেমন কোনো সম্ভাবনা নেই বলেও তিনি নিশ্চিত করেন।
সারাদেশের তিনশ’ আসনের মধ্যে মাগুরায় রয়েছে দুটি সংসদীয় আসন। নিয়ম অনুযায়ী এই জেলায় ২০টি বিদ্যালয় নির্মাণ করা হচ্ছে। এর মধ্যে রয়েছে পঞ্চপল্লী মাধ্যমিক বিদ্যালয়, শ্রীপুর মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, চরগোয়ালপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, জারিয়া মাধ্যমিক বিদ্যালয়, চর মহেশপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, মির্জাপুর মাধ্যমিক বিদ্যালয়, আদর্শ সম্মিলনী মাধ্যমিক বালিকা বিদ্যালয়, খামারপাড়া মাধ্যমিক বিদ্যাল্যয়, ভাবনহাটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়, রাউতারা এইচ এন স্কুল এন্ড কলেজ, অভয়চরণ মাধ্যমিক বিদ্যালয়সহ আরও অন্তত ১০টি।
এসব স্কুলের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু ছিল তা জানতে যোগাযোগ করা হয় মাগুরা জেলার শিক্ষা প্রকৌশলের নির্বাহী প্রকৌশলী মো. হারুনের সঙ্গে। এসব বিদ্যালয়ে কাজের অগ্রগতি ও প্রয়োজনীয়তা সম্পর্কে জনকণ্ঠকে তিনি নিশ্চিতভাবে কিছুই বলতে পারেননি।
শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, নিয়ম অনুযায়ী সরকারি ব্যয়ে এসব স্কুলের জন্য অন্তত ৩০০ শিক্ষার্থী থাকা প্রয়োজন। কিন্তু এসব নিয়ম কানুনের ধার ধারা হয়নি। এমপিরা যে স্কুল উন্নয়নে নির্দেশনা দিয়েছেন, সেই স্কুলের নির্মাণ কাজ করা হয়েছে।
প্রকল্পের পরিচালক সমীর কুমার রজক দাস জনকণ্ঠকে জানান, নগর অঞ্চলে এই প্রকল্পের স্কুলগুলো ৬তলা করা হচ্ছে। প্রতিটি স্কুলের জন্য অর্থ ব্যয় ধরা হয়েছে ১২ কোটি টাকা। জেলা পর্যায়ের স্কুলগুলোতে ৪তলা ভবন করা হয়েছে। এর জন্য ব্যয় ধরা হয়েছে সাড়ে তিন থেকে ৪ কোটি টাকা। এ ছাড়া উপকূলীয় এলাকায় ভবনগুলো ৪তলা করা হচ্ছে। তবে নিচতলা ফাঁকা রাখা হয়েছে।
প্রকল্প সূত্রে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় আসার পর ২০১৮ সালে এই প্রকল্প নেওয়া হয়। প্রকল্পের মেয়াদ শেষ হওয়ার কথা জানুয়ারির ২০২৫ সালে। তবে আওয়ামী সরকারের পতন, ঠিকাদারদের পলায়ন ও কাঁচামালের দাম বৃদ্ধির কারণে মেয়াদের পাশাপাশি অর্থের ব্যয়ও বাড়বে।
সাবেক সংসদীয় কমিটির অনুমিত শাখার একজন সদস্য এ বিষয়ে জনকণ্ঠকে জানান, শিক্ষার এমন শত শত ভবন বিভিন্ন চরাঞ্চল থেকে গ্রাম পর্যায়ে পড়ে আছে। কিন্তু সেখানে না আছে শিক্ষক না আছে শিক্ষার্থী। এর ফলে জনগণের শুধু টাকাই অপচয় হয়নি। শিক্ষা ব্যবস্থারও মারাত্মক ক্ষতি হয়েছে। এ জন্য প্রয়োজনীয় শিক্ষক নিয়োগ দেওয়া আগে প্রয়োজন বলে মনে করেন তিনি।
এ বিষয়ে জানতে শিক্ষা প্রকৌশল অধিদপ্তরের সাবেক প্রধান প্রকৌশলী নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, এমন নানা উন্নয়ন প্রকল্প নেওয়া হয়েছে সরকারের সিদ্ধান্তে। এটি রাজনৈতিক প্রকল্প। তবে ভবিষ্যতের কথা মাথায় রেখে এ ধরনের প্রকল্প নেওয়া হয়েছে।