সনাতনী জাগরণ মঞ্চের নেতা চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহ মামলার প্রতিবাদে শুক্রবার চট্টগ্রামের চেরাগী পাহাড়ে বিক্ষোভ সমাবে
সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ ব্রহ্মচারীসহ অন্যান্যের বিরুদ্ধে দায়ের করা মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার না হলে সোমবার চট্টগ্রাম থেকে কঠোর কর্মসূচি ঘোষণা হবে বলে হুঁশিয়ারি দেওয়া হয়েছে। শুক্রবার বিকেলে নগরীর চেরাগী পাহাড় মোড়ে বাংলাদেশ সনাতনী জাগরণ মঞ্চ আয়োজিত বিক্ষোভ সমাবেশ থেকে এ তথ্য জানানো হয়। একইসঙ্গে কোথাও যদি কোনো সনাতনী নারী-পুরুষের ওপর হামলা- মামলা হয় তাহলে সাধু-সন্তসহ সনাতনী সম্প্রদায় রাজপথে কঠোর আন্দোলন করবে বলে সতর্ক করে দেন জাগরণ নেতৃবৃন্দ। এদিকে, আলোচিত এই মামলার বাদী সিটি করপোরেশনের মোহরা ওয়ার্ড বিএনপির সাধারণ সম্পাদক ফিরোজ খানকে দলের নীতি ও আদর্শ পরিপন্থি কর্মকান্ডের অভিযোগে বহিষ্কার করেছে বিএনপি।
সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র ও পু-রীক ধামের অধ্যক্ষ চিন্ময় কৃষ্ণ দাশ প্রভুসহ ১৯ জনের বিরুদ্ধে মামলা দায়েরের প্রতিবাদে শুক্রবার বিকেলে দেশের ৬৪ জেলায় বিক্ষোভ সমাবেশ ডাকা হয়েছিল চট্টগ্রাম থেকে। এদিন বেলা তিনটার আগে থেকেই স্লোগানে স্লোগানে মুখর হয়ে ওঠে চট্টগ্রামের চেরাগী মোড়। সমাবেশে আগতরা স্লোগান দেন, চিন্ময় প্রভুর কিছু হলে জ্বলবে আগুন ঘরে ঘরে। তুমি কে, আমি কে সনাতনী সনাতনী। জেগেছে রে জেগেছে সনাতনী জেগেছে। কথায় কথায় বাংলা ছাড়, বাংলা কি তোর বাপ দাদার। অসুরের গালে গালে জুতা মার তালে তালে। মামলা দিয়ে আন্দোলন বন্ধ করা যাবে না। সাম্প্রদায়িক কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে দাও। চট্টগ্রামের হাতিয়ার গর্জে উঠুক আরেকবার।
সনাতন জাগরণ মঞ্চের অন্যতম সংগঠক স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ দাস মহারাজ বলেন, সামান্য বিক্ষোভ সমাবেশে প্রশাসন বাধা দিয়েছে। এ অবস্থায় যদি আপনারা ভয় পেয়ে যান তাহলে কী হবে। আমাদের সমাবেশ করতে দিতে হবে। আমাদের কারাগারে নেওয়ার হুমকি দিচ্ছেন, মামলাও করেছেন সাধু ও সনাতনীদের বিরুদ্ধে। সাধুরা কিন্তু ভয় পায় না। আমাদেরের ভগবান কারাগারেই জন্ম হয়েছে। চিন্ময় প্রভুকে কারাগারে রাখলে লাখো চিন্ময় প্রভু রাজপথে আন্দোলন করবে। আমরা ৮ দফা আদায় করব।
সরকার যদি সাধু ও সনাতনীদের কারাগারে নেয় তাহলে লাখ লাখ সনাতনী রাজপথে বিক্ষোভ চালিয়ে যাবেন। সনাতনীদের দমিয়ে রাখতে পারবেন না। প্রশাসনকে সম্মান করি। তাই আমরা শান্তিপূর্ণ আদোলন করছি। রাজপথে আমরা শান্তিপূর্ণ কর্মসূচি পালন করছি। অনেকে বলেন, ১৬ বছর কোথায় ছিলাম, আমরা নাকি আওয়ামী লীগের দালাল। ১৬ বছর আমরা ঘুমিয়ে ছিলাম না উল্লেখ করে তিনি বলেন, যারা এসব কথা বলে তারা ঘুমিয়েছিল। তারা পরিচয় গোপন করে সরকারি দলে লুকিয়ে ছিলেন। ২০২১ সালে রক্তাক্ত শারদ হয়েছিল। শতাধিক দেশে প্রতিবাদ হয়েছে। আগস্ট বিপ্লবে যারা আত্মহুতি দিয়েছিল তারা সুখী মাতৃভূমি বিনির্মাণ করতে দিয়েছিল। হিন্দু মুসলিম বৌদ্ধ খ্রিস্টান ছিল সেই আন্দোলনে। প্রথম শহীদ হয় সনাতনী। অথচ বৈষম্য রয়ে গেল। প্রধান উপদেষ্টাকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, আমরা কোথায় ভালো আছি দেখছেন? আমাদের বিরুদ্ধে মামলা হলো।
আমার দেশের সম্পাদক মাহমুদুর রহমানকে উদ্দেশ করে বলেন, আপনি দেশ ছেড়ে পালাতে চেয়েছিলেন, ধরে নিয়ে এসেছে। এখন বলছেন, সরকারের বিরুদ্ধে আন্দোলন করছি আমরা। আপনি কতবড় দেশপ্রেমিক আমরা দেখেছি। আজকে যারা প্রশাসনের অন্যায়কে প্রশ্রয় দিচ্ছেন তাদের উদ্দেশে বলছি, সত্য বেশিদিন চাপা থাকে না।
৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ ছাড়া সব দল বলেছে, সনাতনীদের সঙ্গে কারও দ্বিমত নেই। আমরা বিশ্বাস করেছিলাম তাদের কথা। তারা বলেছিল, ১৬ বছর কথা বলে পারেনি এখন পারবে। কিন্তু এখন আমরা দেখতে পাচ্ছি, আন্দোলনকে দমাতে অপতৎপরতা শুরু করেছে একটি পক্ষ। প্রশাসনের পক্ষ থেকে বাধা দেওয়া হচ্ছে। বিশ্ব মোড়লরা এখন স্বীকার করছে, বাংলাদেশে ধারাবাহিক হিন্দু নির্যাতন হচ্ছে। সনাতনীদের উদ্যোগে লালদীঘিতে স্মরণকালের বৃহৎ সমাবেশ হয়েছে। এ শান্তি অগ্রযাত্রা বিশেষ গোষ্ঠীর পছন্দ হচ্ছে না। তারা চায়, উপনিবেশিক রাষ্ট্র এখানে বিচরণ করুক। এখানে আসুক, এদেশকে অস্থিতিশীল করুক।
এদিকে, চিন্ময় প্রভুসহ যাদের বিরুদ্ধে ফিরোজ খান নামের বিএনপি নেতা মামলা করেছেন, তাকে বিএনপি ইতোমধ্যে বহিষ্কার করেছে। এখন একটি নাটকের অবতারণা হচ্ছে। বলা হচ্ছে, দুজন সাধুকে বাদ দেবে। বাকিদের নামে মামলা থাকবে। আমরা এটা মানব না। সনাতনী সংগ্রামে যারা এসেছে, যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে সবার নাম প্রত্যাহার করতে হবে।
আমরা আগামী রবিবার জেলা প্রশাসকের মাধ্যমে প্রধান উপদেষ্টা বরাবর স্মারকলিপি দেব। এরপরও যদি মামলা প্রত্যাহার করা না হয় তাহলে সোমবার চট্টগ্রাম থেকে দেশব্যাপী কঠিন কর্মসূচি ঘোষণা হবে।
তিনি জানান, প্রশাসনের লোকেরা আমাদেরকে আটকে দিয়েছিল। ব্যারিকেড ভেঙে এখানে উপস্থিত হয়েছেন সনাতনীরা। নন্দনকানন বৌদ্ধ মন্দিরে আটকে দিয়েছিল, ব্যারিকেড ভেঙে সনাতনীরা চলে আসছে। রাস্ট্রের নিরাপত্তার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহ মামলা করা হয়। অথচ সনাতনীরা কী অপরাধ করল?
ফিরোজ খানকে যে ইন্ধন দিয়েছে, তাকে খুঁজে বের করতে হবে উল্লেখ করে স্বতন্ত্র গৌরাঙ্গ মহারাজ বলেন, না হলে বারবার এদেশের নাম ক্ষুণ্ণ হবে। বিশ্ব পরিমন্ডলে বাংলাদেশের নাম ক্ষুণ্ণ হবে।
হাটহাজারী নেহালপুর বাসুদেব আশ্রমের মহারাজ বিপ্লব চৈতন্য ব্রহ্মচারী বলেন, সনাতন ধর্মাবলম্বীরা মৃত্যুকে ভয় পায় না। শান্তি চাই, অশান্তি পছন্দ করি না। ৮দফা দাবি আদায়ে আমরা থাকব। সনাতনীদের উপস্থিতি দেখে আমরা আপ্লুত। ঐক্যবদ্ধভাবে দাবি আদায় করব। সনাতনীদের দমিয়ে রাখা যাবে না।
সনাতনী মঞ্চের জগন্নাথ ব্রহ্মচারী বলেন, কেন জায়গায় জায়গায় বাধা দেওয়া হলো। আমরা বানের জলে ভেসে আসি নাই। সনাতনীরা বিশ্বে সুশৃঙ্খল ধর্মীয় সম্প্রদায় হিসেবে পরিচিত। আমরা সবাই একসঙ্গে কারাগারে যাব। মামলা প্রত্যাহার করুন। না হয় রাজপথ ছাড়ব না। লালদীঘি ময়দানে দেখেছেন। এরচেয়ে আরও লাখ লাখ সনাতনী রাস্তায় নামব।
নন্দনকানন ইসকনের সহসভাপতি অজপানন্দ প্রভু বলেন, বাংলাদেশে অবলা নারীদের নির্যাতনের ইতিহাস আছে, আছে সনাতনীদের নির্যাতনের ইতিহাস। প্রতিবাদের ভাষা শিখেছে সনাতনীরা। লালদীঘির সমাবেশ দেখে ভয় পেয়ে গেছে একটি শ্রেণি। বাংলাদেশে সরকার পরিবর্তন হলে তখনই সনাতনীদের ওপর নির্যাতন হয়েছে। আমরা নির্যাতিত হতে চাই না, চিন্ময় প্রভুকে স্তব্ধ করবেন? লাখ লাখ চিন্ময় আবির্ভূত হবে। টেকনাফ থেকে তেতুঁলিয়াতে আর যদি কোনো সনাতনীর ওপর নির্যাতন হয়, নারীদের ওপর নিপীড়ন হয়, তাহলে সাধুসন্তরা রাজপথে ছাড়বে না।
প্রবর্তক কৃষ্ণ মন্দিরের সাধারণ সম্পাদক চারুদাশ বলেন, স্বাধীনতার পর থেকে হিন্দুরা দিন দিন সংখ্যালঘু হচ্ছে। এক বাড়িতে চার ভাইয়ের মধ্যে দুই ভাই ভারতে চলে গেছে, আর দুইভাই দুর্বল হয়ে পড়ে। তারাও হারিয়ে যাচ্ছে। আমাদের বাকরুদ্ধ করার জন্য রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা হচ্ছে, অথচ জাতীয় পতাকা পদদলিত করা হয়েছে কিছুদিন আগে তাদের নামে মামলা হয়নি। জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের কথা হচ্ছে, অথচ তাদের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহী মামলা হয় নাই। আমাদের দমিয়ে রাখতে মামলা হলো। আমরা ভয় পাই নাই। আমাদের ঘরবাড়ি জ্বালিয়ে দেওয়া হচ্ছে, চাকরিচ্যুত করা হচ্ছে, মা, বোনকে নির্যাতন করা হচ্ছে। সনাতনীরা ঘরে বসে থাকবেন না। আমাদের ঘরে আগুন দেবে। রাজপথে আসুন, সবাই বাঁচব। ঘরে বসে থাকলে মরব। যে জোয়ার সৃষ্টি হয়েছে তার ঐক্য ধরে রাখতে হবে। ৮ দফা দাবি মানতে হবে।
সরকারের উদ্দেশে তিনি বলেন, এ দেশকে অযোগ্য রাষ্ট্রে পরিণত করবেন না। আইনের শাসন প্রতিষ্ঠা করুন। সনাতনীরা অকৃতজ্ঞ নয়, এমন কিছু করুন যাতে সনাতনীরা আপনাদের মনে রাখে। নির্যাতন বন্ধ করার জন্য ব্যবস্থা নেন।
চবি শিক্ষক কুশল বরণ চক্রবর্ত্তী বলেন, জাতীয় সংগীতের মাধ্যমে সমাবেশ হয়েছে লালদীঘিতে। আমরা দেশদ্রোহী কী কাজ করলাম? সনাতনীরা সাম্প্রদায়িক না। আমাদের মধ্যে কোনো দেশবিরোধী ও সাম্প্রদায়িকতা নেই। আমাদের ধর্মে মাতৃভূমিকে ভালোবাসার কথা বলা হয়েছে। পৃথিবীর যেই প্রান্তে থাকি, সনাতনীরা নিজ দেশকে মাতৃরূপে সম্মান করে। ব্যক্তি রাজনীতি করে, কিন্তু মন্দির তো রাজনীতি করে না। বারবার মন্দির, সাধু ও সনাতনীদের ওপর হামলা-মামলা করে আন্দোলন স্তব্ধ করার চেষ্টা হচ্ছে। সাধুদের নামে মামলা দিলেন, প্রতিবাদ করতে এলে বাধা দেন। এসব কী? পথে পথে কেন আটকাবেন?
সনাতন জাগরণ মঞ্চের অন্যতম সমন্বয়ক জুয়েল আইচ বলেন, একজন চিন্ময় কৃষ্ণকে মামলা দিয়েছেন, হাজার হাজার সনাতনী এলো সমাবেশে। কারা আমাদের রাস্তায় নামিয়েছে? তাদের চিহ্নিত করেন। অনেক জায়গায় বাধা দেওয়া হলো আজ। সমুদ্রের পানিকে বালি দিয়ে বাধা দেওয়ার চেষ্টা করবেন না। আমরা সরকারের সহযোগী হতে চাই। ৮দাবি বাস্তবায়ন হলে আর রাস্তায় নামব না। আর যদি মনে করেন আমাদের কারাগারে নেবেন তাহলে যাব, ভগবানের জন্ম কারাগারে। রাস্তায় যেহেতু নেমেছি দাবি আদায় করে যাব। কেউকি বলতে পারবে আমাদের আন্দোলন থেকে আগুন দেওয়া হয়েছে? কেউ বলতে পারবে ভাঙচুর করা হয়েছে? তাহলে কেন বাধা দিলেন? সুশৃঙ্খল আন্দোলনে বাধা দেওয়া উচিত নয়। চট্টগ্রাম সিটি গেট বন্ধ করে দিলে সব বন্ধ হয়ে যাবে। আমরা শান্তিতে বসবাস করতে চাই। কেউ বাধ্য করবেন না ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক বন্ধ করতে।
উল্লেখ্য, চট্টগ্রামের নিউ মার্কেট মোড়ে জাতীয় পতাকার ওপর গেরুয়া রঙের আরেকটি পতাকা ওড়ানোর অভিযোগে সনাতন জাগরণ মঞ্চের মুখপাত্র চিন্ময় কৃঞ্চ ব্রহ্মচারীসহ ১৯ জনের নাম উল্লেখ করে এবং অজ্ঞাতপরিচয় আরও ১৫ থেকে ২০ জনের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রদ্রোহের অভিযোগ আনা হয়েছে।
ফিরোজ খান নামের এক ব্যক্তি বুধবার গভীর রাতে নগরীর কোতোয়ালি থানায় দ-বিধির ১২০(খ)/ ১২৪(ক)/ ১৫৩(ক)/ ১০৯/৩৪ ধারায় মামলাটি করেন।এই মামলার প্রতিবাদে চেরাগী পাহাড় মোড়ে শুক্রবার বিক্ষোভ সমাবেশে হাজার হাজার নারী-পুরুষ অংশ নেন। সেনাবাহিনী, বিজিবি ও পুলিশের বিপুলসংখ্যক সদস্যের উপস্থিতিতে সেখানে বক্তব্য রাখেন সাধুসন্তরা।
চট্টগ্রাম নগর পুলিশের উপকমিশনার লিয়াকত আলী খান জানান, প্রশাসনের অনুমতি ছিল না চেরাগী মোড়ে সমাবেশ করার। কিন্তু বাধা উপেক্ষা করে জমায়েত হয়েছে। প্রশাসনের পক্ষ থেকে লালদীঘি ময়দানে সমাবেশ করার জন্য আহবান জানালেও আয়োজকরা সেখানেই সমাবেশ করেন।