ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০১ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১

সেকেন্ড হোমের খোঁজে দুদক

নিয়াজ আহমেদ লাবু

প্রকাশিত: ২২:১০, ৩১ অক্টোবর ২০২৪

সেকেন্ড হোমের খোঁজে দুদক

বহুল আলোচিত সেকেন্ড হোমের খোঁজে মাঠে নেমেছে দুদক

বহুল আলোচিত সেকেন্ড হোমের খোঁজে মাঠে নেমেছে দুদক। এতে আতঙ্কে আছেন অন্তত ১০ হাজার ধনকুবের বাংলাদেশী। সংযুক্ত আরব আমিরাত (দুবাই), মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে তারা সেকেন্ড হোম ক্রয় করেন। সেখানে আলিশান ফ্ল্যাট, বাংলোসহ বিভিন্ন ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন তারা। অনেকে সেখানে মার্কেটও গড়েছেন। 
দুদক সূত্র জানায়, গত দেড় যুগ ধরে দেশ থেকে ২ লাখ কোটি টাকা বিদেশে পাচার করে এসব সম্পত্তি কিনেছেন তারা। গড়েছেন একাধিক ব্যবসা প্রতিষ্ঠান। এদের মধ্যে বিদায়ী আওয়ামী লীগ সরকারের কমপক্ষে এক হাজার সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা ও ব্যবসায়ী রয়েছেন। আর সেকেন্ড হোম কেনার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রয়েছেন বাংলাদেশের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ ও এনজিও কর্মকর্তা ও ধনাঢ্যরা। তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ইতোমধ্যে পাচার হওয়া ২ লাখ কোটি টাকা ফেরত আনতে অনুসন্ধান ও তদন্ত করছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের গঠিত টাস্কফোর্স। 
দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশ থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা পাচার হয়েছে মধ্যপ্রাচ্যের সৌন্দর্যের দেশ দুবাইয়ে। ৪৫৯ জন বাংলাদেশী সেখানে বিভিন্ন সম্পত্তি কিনেছেন। ২০২০ সাল পর্যন্ত তাদের মালিকানায় সেখানে মোট ৯৭২টি প্রপার্টি কেনার তথ্য পাওয়া গেছে। কাগজে-কলমে এসবের প্রায় মূল্য ৩২ কোটি ডলার। বাংলাদেশী  মুদ্রায় ২ হাজার ৭শ’ ৬০ কোটি।
 গোল্ডেন ভিসার সুবিধায় এসব টাকা পাচারের অভিযোগে গত বছরের ৩ এপ্রিল অনুসন্ধানে কমিটি গঠন করে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। ইতোমধ্যে সংস্থাটি সেসব বাংলাদেশীর বেশকিছু তথ্য পেয়েছে। এসব তথ্য প্রমাণ যাচাই-বাছাই শেষে দুদক আইনগত ব্যবস্থা নিয়েছে বলে তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান। উপপরিচালক রামপ্রসাদ মণ্ডলকে প্রধান করে তিন সদস্যের একটি অনুসন্ধান টিম গঠন করেছে দুদক। টিমের অন্য সদস্যরা হচ্ছেন উপপরিচালক আহসান উদ্দিন এবং উপপরিচালক ইসমাইল হোসেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ২০১৯ সালের নবেম্বর করোনাকালীন দুবাইয়ে বাংলাদেশীদের প্রপার্টি কেনার হিড়িক পড়ে যায়। এ সময়ের মধ্যে বিপুল পরিমাণ সম্পত্তি কিনেছেন বাংলাদেশীরা। এ সময় বাংলাদেশের প্রভাবশালী রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী ও ধনীরা সবচেয়ে বেশি প্রপার্টি কিনেছেন। তারা দেশে পুরোপুরি এ তথ্য গোপন করেছেন। সে সময় বিত্তবান বিদেশীদের আকৃষ্ট করতে সংযুক্ত আরব আমিরাত সরকার গোল্ডেন ভিসা সুবিধা চালু করার পর থেকেই বাংলাদেশীরা দুবাইয়ে প্রপার্টি ক্রয়ের মাত্রা বেড়ে যায়। 
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, ৪৫৯ জনের মধ্যে প্রায় ২৫০ জনের বিস্তারিত তথ্য পাওয়া গেছে। সেগুলো যাচাই-বাছাই হচ্ছে এবং বাকিগুলোর তথ্য সংগ্রহ অব্যাহত আছে। সম্পূর্ণ তথ্য পাওয়ার পর তা নিয়ে আইনগত পরবর্তী পদক্ষেপ নেওয়া হবে। সেকেন্ড হোম কেনার প্রতিযোগিতায় এগিয়ে রয়েছেন বাংলাদেশের প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী, এমপি, রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, এনজিও কর্মকর্তাসহ ধনাঢ্যরা।

গত এক দশকে দেশের বিভিন্ন ব্যাংক থেকে হাজার হাজার কোটি টাকা বিদেশে পাচারের খবর এসেছে। কিন্তু গত কয়েক মাসে দেশ থেকে শত শত কোটি  বৈধ টাকা অবৈধভাবে পাচার হয়েছে। ৬ মাস আগে দেশের রাজনৈতিক পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ নানান আশঙ্কা থেকে এক শ্রেণির অসাধু রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী, সাংবাদিক ও এনজিও কর্মকর্তা বিদেশে পাড়ি জমানোর চেষ্টা করছেন। প্রাথমিক ধাপ হিসাবে তারা দেশে নিজেদের নামে-বেনামে সম্পত্তি বিক্রি করছেন।
দুবাইয়ে সবচেয়ে বেশি সম্পত্তি কিনেছেন বাংলাদেশের সাবেক ভূমিমন্ত্রী সাইফুজ্জামান চৌধুরী। গত সেপ্টেম্বরে ‘দ্য মিনিস্টার্স মিলিয়নস’ শিরোনামের একটি অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ করে আল-জাজিরা। সেই প্রতিবেদন অনুযায়ী, বিদেশে তার সম্পত্তির মূল্য আনুমানিক ৫০ কোটি মার্কিন ডলার। এর মধ্যে সংযুক্ত আরব আমিরাতে ২৫০টির বেশি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের তালিকাভুক্ত মালিক তিনি।

এই সম্পত্তির মূল্য ১৪ কোটি মার্কিন ডলারের বেশি। ২০২৩ সালে নতুন করে ফাঁস হওয়া সম্পত্তির নথি থেকে জানা যায়, সাইফুজ্জামানের স্ত্রী রুখমিলা জামান দুবাইয়ে ২ কোটি ৫০ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি মূল্যের আরও ৫০টি সম্পত্তির তালিকাভুক্ত মালিক। অর্থ পাচারের অভিযোগে বাংলাদেশে তার বিরুদ্ধে দুদকে অনুসন্ধান চলছে। দুবাইয়ে সম্পত্তির যে তথ্য আগে ফাঁস হয়েছিল (২০২০ ও ২০২২ সালের), তাতে সেখানে এই দম্পতির ৫৪টি সম্পদের মালিকানার তথ্য উন্মোচিত হয়েছিল। এই তথ্য প্রথমে পায় সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজ (সি৪এডিএস)।

পরে তা গণমাধ্যম প্রতিষ্ঠানই ২৪ ও অর্গানাইজড ক্রাইম অ্যান্ড রিপোর্টিং প্রজেক্টের (ওসিসিআরপি) মাধ্যমে পায় আল-জাজিরা। গোপনে ধারণ করা ভিডিওতে সাইফুজ্জামান দুবাইয়ের অভিজাত অপেরা এলাকায় একটি পেন্টহাউসের মালিক হওয়ার বিষয়ে গর্ব করেছিলেন। জমির রেকর্ড যাচাই করে আল-জাজিরা নিশ্চিত হয়েছে, তিনি সেখানে একটি বিলাসবহুল অ্যাপার্টমেন্টের তালিকাভুক্ত মালিক। যার দাম ৫০ লাখ মার্কিন ডলারের বেশি। নতুন তথ্যে দেখা গেছে, সাবেক এই মন্ত্রী ও তার স্ত্রী সংযুক্ত আরব আমিরাতে ৩০০টির বেশি উচ্চমূল্যের অভিজাত অ্যাপার্টমেন্ট কিনতে প্রায় ১৭ কোটি মার্কিন ডলার ব্যয় করেছেন।

এই দম্পতি বিশ্বজুড়ে ৬০০টির বেশি সম্পত্তির তালিকাভুক্ত মালিক। সাবেক এই মন্ত্রী আল-জাজিরার পরিচয় গোপন করা (আন্ডারকভার) সাংবাদিকদের কাছে গর্ব করে বলেছিলেন, যুক্তরাজ্যের লন্ডন, যুক্তরাষ্ট্রের নিউইয়র্ক ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাইয়ে তার অ্যাপার্টমেন্ট রয়েছে। ২০১৬ সাল থেকে তিনি শুধু যুক্তরাজ্যেই ৩৬০টির বেশি বিলাসবহুল বাড়ি কিনেছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, দেশের ব্যবসায়ী এবং রাজনীতিবিদদের অনেকেই সংযুক্ত আরব আমিরাতের দেওয়া এ সুযোগ লুফে নিয়েছেন। এ ছাড়া দেশের ব্যাংক পরিচালক, পোশাক ব্যবসায়ী, রেল ও সড়কের সামনের সারির ঠিকাদারসহ দেশের বড় ও মাঝারি পর্যায়ের অনেক ব্যবসায়ী এখন আমিরাতের গোল্ডেন ভিসাধারী। এমনকি সাবেক মন্ত্রী ও এমপিরা সেখানে প্রপার্টি কিনেছেন। এদের মাধ্যমে দেশ থেকে বিপুল অঙ্কের টাকা পাচার হয়েছে।

যদিও এক সময় অর্থ পাচারের সবচেয়ে আকর্ষণীয় গন্তব্য ছিল সিঙ্গাপুর ও ইউরোপ-আমেরিকার বিভিন্ন দেশ। এখন সে তালিকায় যুক্ত হয়েছে দুবাই। এক্ষেত্রে পাচারের প্রধান মাধ্যম হুন্ডি এবং ডিজিটাল হুন্ডি। আবার বড় ব্যবসায়ীরা আমদানি-রপ্তানির আড়ালে ব্যাংকিং চ্যানেল ব্যবহার করেও টাকা পাচার করেছেন।
জানা গেছে, টাকা পাচারের অভিযোগ থাকলেও ইউএই সরকার গোল্ডেন ভিসার আওতায় আসা বিদেশীদের দেওয়া সুযোগ-সুবিধার পরিমাণ বিভিন্ন সময়ে বাড়িয়েছে। এই ভিসাধারীদের দেওয়া হয় পরিবারসহ ১০ বছরের রেসিডেন্সিয়াল সুবিধা। ইমিগ্রেশন প্রক্রিয়াও বেশ সহজ। এ ছাড়া শিক্ষা ও স্বাস্থ্যসেবার ক্ষেত্রেও তাদের দেওয়া হয় বিশেষ সুবিধা। সহজ করা হয় ব্যবসা চালানোর অনুমতির প্রক্রিয়া। আগে গোল্ডেন কার্ডধারীদের টানা ছয় মাসের বেশি ইউএইর বাইরে অবস্থান করার সুযোগ ছিল না। ২০২২ সালের অক্টোবরে এতেও সংশোধন এনে নিয়ম করা হয় এবং গোল্ডেন ভিসাধারীরা অনির্দিষ্টকালের জন্য দেশটির বাইরে অবস্থান করতে পারবেন।

দুদক কর্মকর্তারা বলছেন, যুক্তরাষ্ট্রভিত্তিক সেন্টার ফর অ্যাডভান্সড ডিফেন্স স্টাডিজের সংগৃহীত তথ্য আন্তর্জাতিক মিডিয়ায় প্রকাশের সূত্র ধরেই হাইকোর্টের নির্দেশনায় অনুসন্ধানে নামে দুদক। দুদকে দাখিল হওয়া অভিযোগে বেশ কিছু নাম সংযুক্ত করা হয়। জানা গেছে, সংযুক্ত আরব আমিরাতে কোনো স্পন্সরশিপ ছাড়াই গোল্ডেন ভিসার জন্য আবেদন করার সুযোগ রয়েছে। কাজ, বসবাস ও পড়াশোনার জন্য এমন সুবিধা পাওয়া যায়। আমিরাত বিভিন্ন ক্যাটাগরিতে গোল্ডেন ভিসা দেয়। মূলত দক্ষ কর্মী ও বিনিয়োগকারীদের আকর্ষণ করতেই এই ভিসা দেয় দেশটি।

বিজ্ঞানী, বিশেষজ্ঞ, সরকারি কাজে বিনিয়োগকারী, আবাসন খাতে বিনিয়োগকারী, উদ্যোক্তা, উচ্চ মাধ্যমিকে ভালো ফলাফলকারী, সংযুক্ত আরব আমিরাত কিংবা অন্যান্য দেশের স্বীকৃত বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকরা এই ভিসার ক্ষেত্রে অগ্রাধিকার পান।
বিশ্বের ধনীদের দ্বিতীয় ঘর হয়ে উঠছে সংযুক্ত আরব আমিরাতের দুবাই। কয়েক বছর ধরেই এটার বাড়বাড়ন্ত চলছে। ২০২২ সালে দুবাইয়ের রেকর্ডসংখ্যক জমি-বাড়ি বেচাকেনা হয়েছে। দেশটির সরকারি নথি অনুসারে, দুবাইয়ে মোট ৯০ হাজার ৮৮১টি জমি ও বাড়ি কেনাবেচা হয়েছে। এর আগে ২০০৯ সালে ৮১ হাজার ১৮২টি জমি-বাড়ি বেচাকেনা হয়েছে।

শুধু ডিসেম্বরেই দেশটিতে আট হাজার আবাসন লেনদেন হয়েছে, যা ২০০৮ সালে একই সময়ের চেয়ে ৬৩ শতাংশ বেশি। খালি জায়গা বিক্রি বেড়েছে ৯২ দশমিক ৫ শতাংশ এবং প্রস্তুতকৃত বাড়ি বিক্রি বেড়েছে ৩২ দশমিক ৪ শতাংশ। চাহিদা বাড়ার সঙ্গে সঙ্গে দুবাইয়ে আবাসনের দামও বেড়েছে। ডিসেম্বর পর্যন্ত গড়ে সম্পদের দাম বেড়েছে ৯ দশমিক ৫ শতাংশ। এর মধ্যে ভিলা বা সুরম্য বাড়ির দাম বেড়েছে ১২ দশমিক ৮ শতাংশ এবং অ্যাপার্টমেন্টের দাম বেড়েছে ৯ শতাংশ।
মালয়েশিয়া ॥ মালয়েশিয়ায় দ্বিতীয় নিবাস গড়ার ‘মালয়েশিয়া মাই সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচিতে অংশগ্রহণকারীদের তালিকায় চতুর্থ অবস্থানে রয়েছে বাংলাদেশীরা। এখন পর্যন্ত তিন হাজার ৬০৪ জন বাংলাদেশী মালয়েশিয়ায় ‘সেকেন্ড হোম’ গড়েছেন। ২৯ মার্চ মালয়েশিয়ার পর্যটন, শিল্প ও সংস্কৃতি মন্ত্রী টিয়ং কিং সিং এক বিবৃতিতে জানিয়েছেন, দেশটিতে গত ৩১ জানুয়ারি পর্যন্ত ৫৬ হাজার ৬৬ জন সক্রিয় ‘সেকেন্ড হোম’ পাস হোল্ডার রয়েছেন।

যার মধ্যে পার্টিসিপেন্ট পাস হোল্ডার ২৭ হাজার ৭৫৯ জন এবং নির্ভরশীল ২৮ হাজার ৩০৭ জন। তালিকায় ২৪ হাজার ৭৬৫ জন পাসধারী নিয়ে শীর্ষে রয়েছে চীন। এর পর যথাক্রমে দক্ষিণ কোরিয়ার চার হাজার ৯৪০ জন, জাপানের চার হাজার ৭৩৩ জন, বাংলাদেশের তিন হাজার ৬০৪ জন, যুক্তরাজ্যের দুই হাজার ২৩৪ জন, তাইওয়ানের এক হাজার ৬১১ জন, যুক্তরাষ্ট্রের এক হাজার ৩৪০ জন রয়েছে।
মালয়েশিয়ায় পিভিআইপি প্রোগ্রামার আবেদন করেছেন মোট ৪৭ জন বিদেশী ধনী বিনিয়োগকারী। যাদের মধ্যে একজন বাংলাদেশী।
মালয়েশিয়া ‘মাই সেকেন্ড হোম’ প্রোগ্রামে ২০১৮ সালে ৫ হাজার ৬১০টি এবং ২০১৯ সালে তিন হাজার ৯২৯টি আবেদন অনুমোদন দেয়। প্রোগ্রামটি ২০২০ সালের আগস্টে সাময়িক বন্ধ ছিল। এর পর ২০২১ সালের অক্টোবর থেকে প্রায় এক হাজার ৪৬৮টি আবেদন অনুমোদন দেওয়া হয়েছিল। ‘সেকেন্ড হোম’ কর্মসূচিতে আরও বেশি বিদেশী আবেদনকারীদের আকৃষ্ট করতে শর্ত সহজ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে দেশটির সরকার।

গত ১৪ মার্চ দেশটির উপ-প্রধানমন্ত্রী দাতুক সেরি ডা. আহমদ জাহিদ হামিদি এক বিবৃতিতে এ তথ্য জানান। তবে শর্ত সংশোধনের ক্ষেত্রে জাতীয় নিরাপত্তার বিষয়টি মাথায় রাখা হবে বলেও জানান তিনি। যেসব শর্ত সংশোধন করা হবে তার মধ্যে রয়েছে, আবেদনকারীদের আবশ্যক ফিক্সড ডিপোজিটের পরিমাণ সিলভার, গোল্ড ও প্লাটিনাম এই তিনটি স্তরে পরিবর্তিত হবে।
গত ১২ মার্চ দেশটির পর্যটন, শিল্প ও সংস্কৃতি মন্ত্রী দাতুক সেরি টিয়ং কিং সিং সংসদে বলেছেন, ‘আরও বিদেশী নাগরিক মাই সেকেন্ড হোম প্রোগ্রামে যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে, কারণ সরকার কিছু শর্ত শিথিল করার দিকে নজর দিয়েছে। ‘ সেকেন্ড হোম’ ক্যাটাগরির নানা আলোচনা ও সমালোচনার পর ২০২২ সালের অক্টোবরে মালয়েশিয়া সরকার নতুন করে পিভিআইপি নামে প্রিমিয়াম ভিসা চালু করেছে, যেটি প্রায় সেকেন্ড হোম ক্যাটাগরির। পিভিআইপি প্রোগ্রামে আবেদন করেছেন মোট ৪৭ জন বিদেশী ধনী বিনিয়োগকারী। যাদের মধ্যে একজন বাংলাদেশী।
সিঙ্গাপুর ॥ দক্ষিণ এশিয়ার সিঙ্গাপুরে ৪১তম শীর্ষ ধনী তালিকায় আছেন বাংলাদেশের সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান মুহাম্মদ আজিজ খান। যুক্তরাষ্ট্র-ভিত্তিক ব্যবসা-বাণিজ্য-বিষয়ক সাময়িকী ফোর্বস প্রকাশিত ২০২৪ সালের ধনকুবের (বিলিয়নিয়ার) তালিকায় এ তথ্য উঠে এসেছে। আগের বছর (২০২৩) সে দেশের শীর্ষ ধনীদের তালিকায় ৪২ নম্বরে ছিলেন। 
আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর তিনি সিঙ্গাপুরে পাড়ি জমিয়েছেন। সেখানে বাংলাদেশের নাগরিকত্ব ছেড়ে দেওয়া আজিজ খান এখন সিঙ্গাপুরের স্থায়ী বাসিন্দা। বাংলাদেশের একটি শীর্ষ বেসরকারি প্রতিষ্ঠান সামিট গ্রুপের কর্ণধার ৬৮ বছর বয়সী আজিজ খান। সামিট গ্রুপ বিদ্যুৎ, বন্দর, ফাইবার অপটিকস, আবাসন ও তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস নিয়ে কাজ করে। 
অর্থ পাচারসংক্রান্ত দুর্নীতি নিয়ে ২০১৬ সালে পানামা পেপারসে সামিট গ্রুপের আজিজ খানের নাম শীর্ষে উঠে আসে। এ বিষয়ে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) অনুসন্ধান শুরু করে। জানা যায়, ক্ষমতার প্রভাব আর আইনি জটিলতায় এখনো শেষ হয়নি অনুসন্ধান।
দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, গত ৭ অক্টোবর সামিট গ্রুপের চেয়ারম্যান আজিজ খানসহ পরিবারের ১১ সদস্যের ব্যাংক হিসাব জব্দ করেছে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যানশিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। 
ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনালের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান জানান, সামিট কমিউনিকেশনের এই অর্থ নয়ছয় করার চেষ্টা এবং পরে অর্থ প্রদান করা, সামিট গ্রুপের ক্ষমতার অপব্যবহারের একটি উদাহরণ। ফলে এই অর্থ প্রদানকে সামনে রেখে যেন সামিটের ক্ষমতার অপব্যবহারের আড়ালে আর্থিক অনিয়ম ঢাকা না পড়ে। এ ছাড়া সিঙ্গাপুরে রয়েছেন এক হাজার ২৮২ জন বাংলাদেশী।  ভারতের এক হাজার ২২৩ জন এবং অস্ট্রেলিয়ার এক হাজার ৬৯ জন। 
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত দেড় যুগ ধরে কিছু অসাধু রাজনীতিবিদ, আমলা, ব্যবসায়ী ও এনজিও কর্মকর্তারা অবৈধভাবে কোটি কোটি টাকা পাচার করে সেকেন্ড হোম হিসাবে যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, কানাডার বেগম পাড়া, সুইজারল্যান্ডসহ ইউরোপের বিভিন্ন দেশ প্রোপার্টি কিনেছেন। সেখানে গ্রীন কার্ডধারীরা হুন্ডির মাধ্যমে দেশে সম্পত্তি বিক্রি করার টাকা পাচার করে সেখানে প্রপার্টি কিনছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়। 
দুদকের প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক হুইপ নজরুল ইসলাম বাবু। ক্ষমতার অপব্যবহার, টেন্ডারবাজি, দখল ও চাঁদাবাজির ও দুর্নীতির মাধ্যমে হাজার কোটি কামিয়ে বাইরে পাচার করেছে। এই টাকায় তিনি রাজধানী কুয়ালালামপুরের ৯৭ পার্সিয়ারাও দোতা, দোতা নুসানতারা শ্রী হাউতোমাস এলাকায় একটি ডুপ্লেক্স বাড়ি রয়েছে নজরুল ইসলাম বাবু। ৫ লাখ ৫ হাজার ৩১৩ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত বা বাংলাদেশী মুদ্রার যার দাম অন্তত ১ কোটি ১১ লাখ টাকা বাড়িটি কেনা হয়েছে।

কুয়ালালামপুরের পেরিনডাসট্রেইন, নিলাই-২, সেরেমবানে নজরুল ইসলাম বাবু ও তার স্ত্রী সায়মা আফরোজ ইভার নামে আছে একটি বাণিজ্যিক প্লট। ৪ লাখ ৩৫ হাজার ১৫৬ মালয়েশিয়ান রিঙ্গিত বা বাংলাদেশী মুদ্রায় ১ কোটি ২ লাখ ৬৫ হাজার ৩৩০ টাকায় প্লটটি কেনা হয়। এ ছাড়া কুয়ালালামপুরের জালান ডি আইএমবিআই ঠিকানায় মাজু মুহিব্বাহ নামে নজরুল ইসলাম বাবুর একটি কোম্পানি আছে। কোম্পানির নিবন্ধন নম্বর ৮৮৮৫৬-এইচ। হাতে থাকা নথিতে ডুপ্লেক্স বাড়ি এবং বাণিজ্যিক প্লটে বাবু ও তার স্ত্রীর বিনিয়োগ উল্লেখ রয়েছে। এ ছাড়া যুক্তরাজ্যের লন্ডনে একটি ফ্ল্যাট কিনেছেন বাবু। 
এ ছাড়া সাবেক ডিএমপি কমিশনার আছাদুজ্জামান মিয়া অবৈধ অর্থে বিদেশে পাচার করে আমেরিকা, সিঙ্গাপুর, দুবাই, ইংল্যান্ড, মালয়েশিয়া, তুরস্কে অনেক প্রপার্টি কিনেছেন। তিনি নানা কৌশলে অনেক কালো টাকা সাদাও করেছেন। আর সাবেক এমপি আব্দুল সোবাহান গোলাপ। ব্যাপক অনিয়ম ও দুর্নীতি মাধ্যমে অর্থ উপার্জন শুধু দেশে নয়, সদূর মার্কিন মুল্লুকে ৯টি বাড়ি কিনেছেন। আর সাবেক একরামুল করিম চৌধুরী অনিয়মে আয় করা হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন বিদেশে।

এই টাকা ভিয়েতনামে গড়েছেন ব্যবসা ও সম্পদ। অপরদিকে ওয়াসা সাবেক এমডি তাসকিম যুক্তরাষ্ট্রের একাধিক বাড়ি কিনেছেন। এ ছাড়া সাবেক মন্ত্রী, এমপি, আমলা, সরকারি কর্মকর্তা, ব্যাংকারসহ বহু বাংলাদেশী সেখানি দামি অ্যাপার্টমেন্ট কিনেছেন।
সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানায়, গত ৪৪ বছরে বাংলাদেশ থেকে ৯ লাখ কোটি টাকা পাচার হয়ে গেছে। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা  দ্বৈত নাগরিকত্বের সুযোগে সবকিছু পাচার করছেন। দেশ থেকে বিদেশী ব্যাংকে টাকা পাচার হয়ে যাচ্ছে। ধনাঢ্য ব্যক্তিরা আজকে যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, কানাডা, মালয়েশিয়া, মরিশাসসহ বিভিন্ন দেশে ‘সেকেন্ড হোম’ কিনছেন। 

বিদেশে পাচার হওয়া অর্থ ফিরিয়ে আনার উদ্যাগ ॥ গত ১৬ বছরে বিদেশে পাচার হওয়া দুই লাখ কোটি টাকা অর্থ পাচার হয়েছে। পাচারকৃত অর্থ দেশে ফিরিয়ে আনতে এখন পর্যন্ত ১২ দেশে ৭১টি মিউচুয়াল লিগ্যাল অ্যাসিস্ট্যান্স রিকোয়েস্ট (এমএলএআর) পাঠিয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। এর মধ্যে ২৭টি এমএলএআরের জবাব পেয়েছে সংস্থাটি। মঙ্গলবার দুদক কর্মকর্তাদের সঙ্গে ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) চার সদস্যের একটি প্রতিনিধি দলের সভা অনুষ্ঠিত হয়। সভা শেষে দুদকের মহাপরিচালক মোঃ আক্তার হোসেন এ তথ্য জানান।
দুদক মহাপরিচালক জানান, বাংলাদেশ থেকে আমেরিকা, কানাডা, সুইজারল্যান্ড, মালয়েশিয়ায়, সিঙ্গাপুরে মানি লন্ডারিং বেশি হয়। পাচার হওয়া অর্থের তথ্য চেয়ে দুদক ৭১টি চিঠি পাঠিয়ে জবাব পেয়েছে মাত্র ২৭টির। পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনতে দুদক কীভাবে সহযোগিতা পেতে পারে, তা নিয়ে আলোচনা হয়েছে  বৈঠকে।
এর আগে যুক্তরাষ্ট্রের ফেডারেল ব্যুরো অব ইনভেস্টিগেশন (এফবিআই), ইউনাইটেড ন্যাশনস অফিস ফর ড্রাগস অ্যান্ড ক্রাইম (ইউএনওডিসি), বিশ্বব্যাংক ও এশিয়ান ডেভেলপমেন্ট ব্যাংক (এডিবি) ধারাবাহিকভাবে দুদকের সঙ্গে পাচারকৃত অর্থ ফেরতসহ বিভিন্ন বিষয় নিয়ে সভা করেছেন।

×