ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ৩১ অক্টোবর ২০২৪, ১৬ কার্তিক ১৪৩১

দ্য লাস্ট সাপার, শেষ ভাত: তোফাজ্জলকে কি মনে পড়ে !

প্রকাশিত: ১৯:১০, ৩১ অক্টোবর ২০২৪

দ্য লাস্ট সাপার, শেষ ভাত: তোফাজ্জলকে কি মনে পড়ে !

ফলোআপ নিউজ

উশকোখুশকো চুল, গলায় ঝুলছে তাবিজ। উদোম শরীরে সামনে ভাতের থালা। হাত ধুয়ে কয়েক মুঠো মুখেও নিলেন পঁয়ত্রিশ পেরোনো তোফাজ্জল হোসেন। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের (ঢাবি) ফজলুল হক (এফএইচ) মুসলিম হলের ক্যান্টিনে  রাত ৯টার দিকে এ যুবককে ঘিরে চলছিল শিক্ষার্থীদের হাসিঠাট্টা, মশকরা।

ছাত্রদের কেউ তাঁর কাছে জানতে চায়, ‘খাবার কেমন?’ ভয়ার্ত তোফাজ্জলের উত্তর, ‘খুব ভালো।’ কেউ বলছিল, ‘সেলফি ল, সেলফি ল।’ একজন জানতে চান, ‘আর কিছু লাগব?’ মাথা নেড়ে ‘না’ বলছিলেন তোফাজ্জল। কে জানত– ওটা তাঁর শেষ খাবার!

মোবাইল চুরির অপবাদ দিয়ে  রাতে প্রথম দফা তাঁকে হলের অতিথি কক্ষে নিয়ে মারধর করা হয়। এরপর ক্যান্টিনে নেওয়া হয় খাওয়াতে। এরপর তাঁর ওপর নেমে আসে বিভীষিকা। ২৫ থেকে ৩০ শিক্ষার্থী দল বেঁধে তোফাজ্জলকে বেধড়ক পেটাতে থাকে। স্টাম্প দিয়ে পিষে দেওয়া হয় হাতের আঙুল। বেশুমার মারে তাঁর শরীর থেকে ঝরতে থাকে রক্ত। রক্তভেজা শরীরে তাঁকে নাচতে নির্দেশ দেয় শিক্ষার্থীরা। এমন মর্মন্তুদ ঘটনার মধ্য দিয়ে শেষ হয় তোফাজ্জলের কষ্টমাখা জীবন। তাঁর ওপর নির্মমতার খণ্ড খণ্ড ছবি সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ছড়িয়ে পড়লে অনেকে এর সঙ্গে জড়িতদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তির দাবি তুলেছেন।

তোফাজ্জলের পরিচিতজন ও প্রতিবেশীর কাছ থেকে জানা যায়, তিনি ছিলেন মেধাবী। তবে প্রেমবিষয়ক ঘটনায় মানসিক ভারসাম্য হারান। এর আগে তাঁর মা-বাবা মারা যান। গত বছর একমাত্র বড় ভাই মারা গেলে তিনি একা হয়ে পড়েন।

তোফাজ্জল বরগুনার পাথরঘাটার কাঁঠালতলী ইউনিয়নের তালুকের চরদুয়ানী গ্রামের মৃত আবদুর রহমানের ছেলে। দুই ভাইয়ের মধ্যে তোফাজ্জল ছিলেন ছোট। 

প্রায়ই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় এলাকায় দেখা যেত তাঁকে। নানাজনের কাছ থেকে খাবার চেয়ে নিতেন। আবার অনেক সময় টাকাও চাইতেন। অধিকাংশ সময় রাত কাটাতেন ফুটপাতে।

তোফাজ্জলের এমন মৃত্যুর খবর মেনে নিতে পারছে না তাঁর পরিবারের সদস্যরাও। তাঁর বড় ভাইয়ের স্ত্রী শরীফা আক্তার বলেন, ‘মানসিক সমস্যা থাকায় সে পরিবার থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছিল। তাই বলে তাকে হত্যা করতে হবে? আমরা এই হত্যার বিচার চাই।’

তোফাজ্জল হত্যার বিচার চান তাঁর চাচা ফজলুল হকও। ঢামেক মর্গে গিয়ে দেখা গিয়েছিল কান্নায় ভেঙে পড়েন তোফাজ্জলের মামাতো বোন আসমা আক্তার তানিয়া। তিনি বলেন, ফুফুর পরিবারে ওরা দুই ভাই ছাড়া আর কেউ ছিল না। রাতে শিক্ষার্থীরা তোফাজ্জলকে বেধম মারধর করার সময় আমার বাবার (ওর মামা) নম্বরে এক শিক্ষার্থী ফোন করে ৩৫ হাজার টাকা দাবি করেন। তোফাজ্জল কোনো অপরাধ করলে তাকে থানায় দিয়ে দিতে বলেন বাবা। এর কিছু সময় পর আরেকটি নম্বর থেকে তাঁর ভাবির কাছে দুই লাখ টাকা দাবি করা হয়।

তানিয়া বলেন, বরিশাল বিএম কলেজ থেকে অর্থনীতিতে মাস্টার্স করার পর তোফাজ্জল মানসিক সমস্যার কারণে নতুন জীবন শুরু করতে পারেনি। ২০১৫ সালে ওর মা বিউটি বেগমের মৃত্যু হয়। এর আগে ওর বাবা আবদুর রহমান সড়ক দুর্ঘটনায় মারা যান। সর্বশেষ গত বছর তোফাজ্জলের বড় ভাই পুলিশের উপপরিদর্শক (এসআই) নাসির হোসেন ক্যান্সারে মারা যান।

মারধর করার বিষয়টি জানতে পেরে ওই নম্বরে ফোন করে তোফাজ্জলের মানসিক অসুস্থতার কথাও বলি। কিন্তু ওরা বলে, এত ফোন নম্বর মনে রাখতে পারে, সে কীসের পাগল! পরিবারের এমন পরিস্থিতিতে কেউ সুস্থ থাকতে পারে– আপনারাই বলেন? তোফাজ্জল তাদের মোবাইল ফোন চুরি করেছে বলে জানায় শিক্ষার্থীরা। তাহলে পুলিশে দিয়ে দিতে পারত, তা না করে আমার ভাইকে এভাবে মেরে ফেলল।

ওড়নায় মুখ লুকিয়ে তানিয়া বলেন, তোফাজ্জল টিএসসি ও হাকিম চত্বর এলাকায় ঘোরাফেরা করত। যে যা দিত সেটাই খেত। হয়তো রাতে অনুষ্ঠান দেখে ওখানে খেতে গেছে। কিন্তু কত নিষ্ঠুর হলে একজনকে ভাত খাওয়ানোর পর পিটিয়ে মেরে ফেলে? তোরা মেরেই যখন ফেলবি, তখন ভাত কেন খাওয়াইলি? আমরা এ ঘটনায় হত্যা মামলা করব। এ ঘটনায় জড়িতদের সর্বোচ্চ শাস্তি চাই।

এ ঘটনায় ছয়জনকে গ্রেপতার করলে ও রায় এখনো আসে নি।  

ঠান্ডামাথায় মানসিক ভারসাম্যহীন তোফাজ্জলকে ভাত খাওয়ানো হয়। তারপর তার মৃত্যু নিশ্চিত করা হয়। সারাদেশের মানুষ এখনো তোফাজ্জলকে ভুলে নি।তোফাজ্জল থাকবে আজীবন আমাদের হৃদয়ে ,দেশবাসী সেটাই মনে করেন।দেশবাসীর একটাই আরজি যত দ্রুত সম্ভব দোষীদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করা।

ফুয়াদ

×