স্বাধীনতার পর বিগত ৫২ বছরেও প্রশাসনের সংস্কার সম্ভব হয়নি
স্বাধীনতার পর বিগত ৫২ বছরেও প্রশাসনের সংস্কার সম্ভব হয়নি। সংস্কারের লক্ষ্যে ইতোপূর্বে ১৮টি কমিশন বা কমিটি গঠন এবং প্রশাসনিক সংস্কারের নানাবিধ উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। পাশাপাশি কিছু ব্যাচ প্রশাসনের ভারসাম্য নষ্ট করেছে। নিয়োগবিধি লঙ্ঘন করে কোনো কোনো ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতি দিয়ে শীর্ষপদে বসানো হয়েছে অতীতে বহুবার।
এতে অনেক সময় মাথাভারি হয়ে পড়ে প্রশাসন। ভারসাম্যহীন হয়ে পড়ায় প্রশাসনের কর্মকর্তারা পদোন্নতি ও ভালো পোস্টিং পেতে রাজনৈতিক আশ্রয় খুঁজে চলেছে। বিভিন্ন রাজনৈতিক সরকারও এই সুযোগকে কাজে লাগিয়ে প্রশাসনকে কুক্ষিগত করার অপচেষ্টা চালিয়েছে। এতে প্রশাসন যেমন ক্রমান্বয়ে দুর্বল হয়ে পড়েছে। তেমনি রাষ্ট্র ও দেশের জনগণও ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। এই সকল প্রক্রিয়ার অবসন ঘটিয়ে একটি গতিশীল প্রশাসন গড়তে সংস্কারের লক্ষ্যে সরকার একটি কমিশন গঠেন করেছে। কমিশন ইতোমধ্যে কার্যক্রমও শুরু করেছে। একটি বৈঠকও হয়েছে।
প্রশাসন বিশেষজ্ঞদের মতে, প্রশাসন যন্ত্রই একটি দেশের প্রধান চালিকা শক্তি। যে দেশের প্রশাসন যত শক্তিশালী ও স্বচ্ছ, সে দেশ তত গতিশীল। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের প্রশাসন যন্ত্রকে গতিশীল করতে নানা উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা বাস্তবে রূপ লাভ করেনি। প্রশাসনকে গতিশীল করতে বাস্তবধর্মী অনেক উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা আলোর মুখ দেখেনি। শীর্ষ কর্মকর্তারাও এড়িয়ে গেছেন বারবার।
এ নিয়ে কোনো সরকারকে তেমন মাথা ঘামাতে দেখা যায়নি। বরং বিভিন্ন সময়ে সরকারের হটকারী সিদ্ধান্ত প্রশাসন যন্ত্রকে বিকল করার কাজ ত্বরান্বিত করেছে। এর সঙ্গে ব্যক্তি সুবিধা নিতে যুক্ত থেকেছে বিভিন্ন সময়ে কর্মকর্তারা। প্রশাসনের ভবিষ্যৎ নিয়ে কারো কোনো মাথাব্যথা দেখা যায়নি। রাষ্ট্রে প্রয়োজনে বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যাচে কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এই সকল নিয়োগে সরকারের সুদূরপ্রসারি কোনো লক্ষ্যই ছিল না। আর এর দায়দায়িত্ব বহন করতে হচ্ছে রাষ্ট্র ও দেশের জনগণকে।
ইতোপূর্বে প্রশাসনে নিয়োগ পরিকল্পিত থাকলেও সবচেয়ে বেশি সমস্যা সৃষ্টি হয় সারাদেশে উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ দেওয়া নিয়ে। এর আগেই সচিবালয় ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ৭৭ কর্মকর্তাকে। গ্রুপ ৭৭ নামে পরিচিত এই কর্মকর্তারা সচিবালয় ক্যাডার হিসেবে যোগদান করলেও পরে তাদের প্রশাসন ক্যাডারে সম্পৃক্ত করা হয়। এরপর উপজেলা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয় ৬৫০ কর্মকর্তাকে। তারা ম্যাজিস্ট্রেট হিসেবে চাকরি করবেন বিধায় যাদের বয়স বেশি, তাদের বেতন বেশি নির্ধারণও করা হয়।
কিন্তু পরবর্তী সময়ে সরকারের ঘনিষ্ঠ হয়ে তারাও প্রশাসন ক্যাডারে সম্পৃক্ত হয়। এ সময় স্বল্প মেধার কিছু লোক ঢুকে পড়ে প্রশাসন ক্যাডারে। পরবর্তীকালে আরও দুটি ব্যাচের মধ্যে প্রশাসন ক্যাডারের পাশাপাশি কয়েকশ’ কর্মকর্তাকে সচিবালয় ক্যাডার হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। সচিবালয় ক্যাডার ভেঙে দিয়ে তাদেরও প্রশাসন ক্যাডারে সম্পৃক্ত করা হয়। এ ছাড়াও ইন্ডাস্ট্রিয়াল ম্যানেজমেন্ট সার্ভিসের (আইএমএস) কর্মকর্তাদেরও প্রশাসন ক্যাডারে সম্পৃক্ত করা হয়। সব মিলিয়ে প্রায় দেড় হাজার কর্মকর্তাকে প্রশাসন ক্যাডারে সম্পৃক্ত করায় তা বেসামাল হয়ে পড়ে।
শুরু হয় পদোন্নতি জটিলতা। একই সঙ্গে কর্মকর্তাদের মধ্যে সরকারের আস্থাভাজন হওয়ার প্রবণতা দেখা দেয়। ক্রমান্বয়ে তা বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে বাড়তে থাকে বৈসম্য। এর থেকে তৈরি হয় আন্তঃক্যাডার বৈষম্য। প্রথম দিকে অন্য ক্যাডারদের বঞ্চিত করে প্রশাসন ক্যাডারের কর্মকর্তাদের পদোন্নতিসহ যাবতীয় সুবিধা নিতে দেখা যায়। পরবর্তী সময় এই সমস্যা আরও প্রকট আকার ধারণ করে। তখন সৃষ্টি হয় অন্তঃক্যাডার বৈষম্য। এই ক্যাডারের কর্মকর্তাদের মধ্যে প্রতিযোগিতা শুরু হয় পদোন্নতি ও ভালো নিয়োগের ক্ষেত্রে।
বিভিন্ন সময়ে প্রশাসন ক্যাডারে সম্পৃক্ত হওয়া কর্মকর্তাদের সমন্বয়ে ব্যাচগুলো অস্বাভাবিক হওয়ায় এ ব্যাচের পদোন্নতি দিতে সরকারকেও হিমশিম খেতে হয়। এতে বঞ্চিতের সংখ্যা বাড়তে থাকে। বাড়ে প্রশাসনে অস্থিরতা। সুযোগ সন্ধানী কর্মকর্তারা কাজের চেয়ে সরকারের বা সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তাদের আস্থাভাজন হতে বেশি মনোযোগী হয়। এতে কাজের গতিও মন্থর হতে থাকে। কর্মকর্তারাও হয়ে ওঠে আত্মকেন্দ্রিক।
কোনো কোনো ক্ষেত্রে পদোন্নতি পেতে রাজনৈতিক আশ্রয়ের পাশাপাশি উপঢৌকন প্রথার চালুর অভিযোগও পাওয়া যায়। সে ক্ষেত্রে দুর্নীতিও বাড়তে থাকে। একই সঙ্গে অনেক যোগ্য কর্মকর্তারা বঞ্চিত হতে থাকেন। এতে তারা হতাশ হয়ে পড়েন। তদ্বির বা উপঢৌকনের জোরে অনেক অযোগ্য পদোন্নতি পেয়ে যোগ্যদের চেয়ে সিনিয়র বনে যান। প্রশাসন রাজনৈতিকীকরণ তো আছেই।
ক্ষোভ আর হতাশা থেকে যোগ্যরা অনেকটা নিষ্ক্রিয় হয়ে পড়েন। প্রশাসন হয়ে পড়ে অনেকটা মেধাশূন্য। তাই কোনো অবস্থায় গতি ফিরে পাচ্ছে না প্রশাসন যন্ত্র। ফাইলের স্তূপ অধিকাংশ ক্ষেত্রে। যুগ্ম-সচিব পর্যায়ে নিম্পন্ন হওয়ার ফাইল পাঠানো হয় সচিব বা মন্ত্রীর কাছে। সচিব বা মন্ত্রীর নিম্পন্ন যোগ্য ফাইল পাঠানো হয় প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে। যোগ্য কর্মকর্তার সংখ্যা কমে যাওয়ায় প্রশাসন কিছুতেই গতি ফিরে পাচ্ছে না।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের অনেক কর্মকর্তা দায়িত্ব নিয়ে কাজ করতে চান না। তারা অনেকেই নিজেদের চেয়ার ধরে রাখতে জি হুজুরের ভূমিকায় অবতীর্ণ হন। কিন্তু সরকারের আমলাতন্ত্রে কাজ সরকারকে সঠিকভাবে পরিচালিত করতে সহযোগিতা করা। তারা শুধু নিজেদের স্বার্থের দিকে বেশি নজর রাখেন। বিশ্বের বিভিন্ন দেশের আমলাতন্ত্র জটিলতা মুক্ত করে জনগণের সেবা করে থাকে। কিন্তু বাংলাদেশের আমলাতন্ত্র সম্পর্কে বলতে শোনা যায়, এরা হলো জটিলতা সৃষ্টিতেই বেশি তৎপর।
বিগত তত্ত্বাবধায় সরকার প্রশাসনের সংস্কারের জন্য নানাবিধ উদ্যোগ নেয়। কিন্তু তার কোনোটিই আলোর মুখ দেখেনি। রাজনৈতিক সরকারগুলো ক্ষমতায় এসে প্রশাসনিক সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করে। ধীরে ধীরে তা চলে যায় হিমাগারে। প্রশাসনকে গতিশীল করতে নেওয়া ৯০ শতাংশেরও বেশি প্রস্তাব বাস্তবায়ন হয় না। নেতাদের রাজনৈতিক কমিটমেন্ট না থাকা, প্রভাবশালী আমলাদের অনীহা, সিভিল সোসাইটি প্রশাসনিক সংস্কার নিয়ে কথা না বলা এবং জনগণ কথা বললেও তাদের কোন ফোরাম না থাকায় এ প্রস্তাবসমূহ শেষ পর্যন্ত আলোর মুখ দেখে না।
সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অধিকাংশ ফাইল ঘুরতে থাকে বৃত্তাকারে। সরকারের সদিচ্ছা থাকলেও কিছু কর্মকর্তার দৃষ্টিভঙ্গির কারণে তা বাস্তবায়ন হয় না। আবার কোনো কোনো ক্ষেত্রে কর্মকর্তারা চাইলেও দাতাদের কারণে তা বাস্তবায়ন করা সম্ভব হয় না। কোনো কোনো ফাইল বছরের পর বছর ঘুরতে থাকে। কিছু ক্ষেত্রে প্রস্তাবের নাম পরিবর্তন করেও ঘোরানো হচ্ছে। প্রশাসনিক সংস্কারের লক্ষ্যে ১৯৭৩ সালের নেওয়া প্রস্তাব এখনও বাস্তবায়ন না করে ঝুলন্ত অবস্থায় থাকার নজির রয়েছে প্রশাসনে। সরকার আসে সরকার যায়, কিন্তু ফাইল ঘুরতে থাকে।
নতুন সরকার ক্ষমতায় এসে প্রশাসনকে গতিশীল করতে বিভিন্ন উদ্যোগ গ্রহণ করলেও আস্তে আস্তে তা ঝিমিয়ে পড়ে। প্রথম দিকে ঢাক-ঢোল পিটিয়ে সংস্কারের উদ্যোগ গ্রহণ করলেও অল্পদিনের মধ্যে নীরব হয়ে যায়। আর ক্ষমতার অর্ধেক সময় পার হলেই সরকারের মতিগতিও পাল্টে যায়। পরে সময়ের অভাব দেখিয়ে পাঠানো হয় হিমাগারে।
বিগত আওয়ামী আমলে সংস্কারের উদ্যোগ ॥ বিগত তত্ত্বাবধায়ক আমলের অধিকাংশ সুপারিশ আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে যাচাই-বছাই করে জনপ্রশাসন (সংস্থাপন) মন্ত্রণালয়। এর মধ্যে ক্যারিয়ার প্লানিংয়ের বেশি জোর দেওয়া হয়। কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রত্যেকের জন্য প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করার প্রস্তাব দেওয়া হয়। এ ছাড়া বিগত আমলের বিতর্কিত পদোন্নতি বিধিমালা সংশোধনসহ বিভিন্ন প্রস্তাব তৈরি করে মন্ত্রণালয়।
সিভিল সার্ভিস অ্যাক্ট চূড়ান্ত পর্যায়ে এসে হিমাগারে ঢুকে পড়ে। পাশাপাশি ক্যাডার বৈষম্য কমিয়ে আনতে ক্যাডারের সংখ্যাও কমিয়ে আনার প্রস্তাব তৈরি করা হয়। এ ক্ষেত্রে প্রশাসন, পুলিশ, শিক্ষা, স্বাস্থ্য, পররাষ্ট্র, আনসার, কাস্টমস অ্যান্ড ডিউটি, অডিট অ্যান্ড অ্যাকাউন্টস ফ্যামিলি প্লানিং, পাবলিক ওয়ার্কার্স ক্যাডারকে ঠিক রাখার সুপারিশ তৈরি করে। ফুড, কো-অপারেটিভ, ফরেস্ট, ট্রেড এবং পোস্টাল ক্যাডারকে বিলুপ্ত করার সুপারিশ তৈরি করা হয়।
এ ছাড়াও ফিশারিজকে এগ্রিকালচার এবং সাধারণ শিক্ষাকে ও টেকনিক্যাল এডুকেশনকে শিক্ষা ক্যাডারে অন্তর্ভুক্ত করার সুপারিশও তৈরি করা হয়। একই সঙ্গে ইকোনমিক ও স্ট্যাটিসটিকস ক্যাডারকে যুক্ত করে ইকোনমিক ও স্ট্যাটিসটিকস, রোডস অ্যান্ড হাইওয়ে ও পাবলিক হেলথকে যুক্ত করে ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাডার, টেলিকমিউনিকেশনকে ইনফরমেশন এবং টেলিকমিউনিকেশন নামে নতুন ক্যাডার করাসহ জুডিসিয়ালকে বিলুপ্ত করে জুডিসিয়াল সর্ভিস কমিশন, রেলওয়ে ট্রান্সপোর্ট অ্যান্ড কমার্শিয়াল এবং রেলওয়ে ইঞ্জিনিয়ারিং ক্যাডারকে রেলওয়ে ক্যাডার করার প্রস্তাব করা হয়।
কিন্তু এর কোনোটিই আলোর মুখ দেখেনি। বর্তমানে সরকারি কর্মচারী আইনটি প্রণয়নের উদ্যোগ নিলেও তা আলোর মুখ দেখবে কি-না তাতে সংশ্লিষ্ট অনেকেই সন্দেহ প্রকাশ করেন। তারা বলেন, আইনটিতে বিশেষ শ্রেণিকে সুবিধা দেওয়ার কথা বিবেচনায় নেওয়ায় এটি অনুমোদনের সুযোগ হারিয়েছে।
তত্ত্বাবধায়ক আমলে সংস্কারের উদ্যোগ ॥ বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকার দায়িত্ব গ্রহণের পর প্রশাসনিক সংস্কার সংক্রান্ত নানামুখী উদ্যোগ গ্রহণ করে। এর মধ্যে ছিল মন্ত্রণালয়গুলোকে চার গুচ্ছে বিভক্তকরণ। পরে তা আবার ছয়টি গুচ্ছে বিভক্ত করা সুপারিশ করা হয়। এটি এখনো প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। জানা গেছে, ১৯৭৩ সাল থেকে এই প্রস্তাবটি জুলন্ত অবস্থায় রয়েছে। সরকার আসে, সরকার যায়। কিন্তু এ প্রস্তাবটি বাস্তবায়ন হয় না। ঘুরিয়ে ফিরিয়ে অধিকাংশ সরকারের সময় এই প্রস্তাবটি নিয়ে আলোচনা হয়।
এ ছাড়া প্রশাসনকে গতিশীল করতে নানা বিধি-বিধান বদল, কর্মকর্তাদের প্রত্যেকের জন্য প্রশিক্ষণ বাধ্যতামূলক করা, ক্যারিয়ার প্লানিং উন্নয়ন করা, বিশেষ করে কর্মকর্তাদের দক্ষতা বৃদ্ধি ও টেম্পারিং রোধে নতুন এসিআর পদ্ধতি চালু করা, পদোন্নতির নতুন বিধিমালা তৈরি-এতে ছিল পরীক্ষার মাধ্যমে যোগ্যতা নির্ধারণ, পদ শূন্য না থাকলেও নির্ধারিত সময়ে পদোন্নতি প্রদান, কাজের গতি বাড়াতে বিভিন্ন মন্ত্রণালয়ের জন্য সাবেক সচিবদের জন্য বিশেষজ্ঞ টিম গঠন, প্রশাসনকে রাজনৈতিক প্রভাব মুক্ত করার জন্য সিভিল সার্ভিস কমিশন গঠন, প্রশাসনের স্থবিরতা নিরসনে ভিজিল্যান্স টিম গঠন, রিসোর্স পারসনস পুল গঠনসহ বিভিন্ন উদ্যোগ নেয়া হয়।
তত্ত্বাবধায়ক সরকারের নেওয়া এর কোনো পদক্ষেপই আলোর মুখ দেখেনি। প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত অধিকাংশ প্রস্তাব বাস্তবায়িত না হওয়ায় প্রশাসন ক্রমান্বয় গতিহীন ও অস্বচ্ছ হয়ে পড়ছে। প্রশাসন বিশেষজ্ঞরা বলেন, ১৯৭২ সালে গঠন করা প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস কমিটি প্রশাসনকে গতিশীল করতে বিস্তারিত সুপারিশ করে। এতে সার্বিক বিষয়ে ধারণা দেওয়া হয়। কর্মকর্তা-কর্মচারীদের জন্য কতগুলো বেতন স্কেল করা প্রয়োজন তাও এই সুপারিশে উল্লেখ ছিল। এই প্রস্তাবগুলো বাস্তবায়িত হলে প্রশাসনের এ হাল হতো না।
প্রস্তাবগুলো ঝুলে যায় যেভাবে ॥ অনুসন্ধানে জানা গেছে, ১৯৭৩ সালে মোজাফফর কমিটি কাজের ধরন অনুযায়ী মন্ত্রণালয়গুলোকে বিভিন্ন গুচ্ছে (ক্লাস্টার) বিভক্তির প্রস্তাব দেয়। এর পর দীর্ঘ সময় এ নিয়ে সরকারের কোনো উচ্চবাচ্য না থাকায় ক্লাস্টারিং প্রথা তৈরির প্রক্রিয়া ঝিমিয়ে পড়ে। পরে পাবলিক অ্যাডমিনিস্ট্রেশন রিফর্মেশন কমিটি (পার্ক) ২০০০ সালে মন্ত্রণালয়গুলোকে বিভিন্ন গুচ্ছে বিভক্ত করার জন্য জোরেশোরে কাজ শুরু করে।
এটি বাস্তবায়নের লক্ষ্যে এই আলোকে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে সুশাসন বিষয়ে গুড গভর্নেন্স সেল তৈরি করা হয়। তখন মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ থেকে মন্ত্রণালয়গুলোকে ৫টি গুচ্ছে বিভক্ত করার প্রস্তাব করা হয়। পরে অনুমোদনের জন্য এটি মন্ত্রিপরিষদে উপস্থাপন করা হয়। মন্ত্রিপরিষদ প্রস্তাবকৃত ৫টির পরিবর্তে মন্ত্রণালয়গুলোকে ৪টি গুচ্ছে বিভক্ত করার অনুমতি দেয়। ২০০৪ সালে অনুমোদন দেওয়া এই প্রস্তাবের পর কোনো মন্ত্রণালয় কোন গুচ্ছের অধীনে থাকবে, তা নির্ধারণ করতে একটি কমিটিও গঠন করা হয়। কিন্তু কাজের কাজ কিছুই হয় না।
কমিটি ব্যস্ত থাকে ফাইল চালাচালি নিয়ে। এর পর বিগত তত্ত্বাবধায়ক সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. ফখরুদ্দীন আহমদ উদ্যোগ নেওয়ার পর আবার তা যাচাই-বাছাই শুরু হয়। যাচাই-বাছাই শেষে এবার মন্ত্রণালয়গুলো ৬টি গুচ্ছে বিভক্তের সুপারিশ করে জনপ্রশাসন (সংস্থাপন) মন্ত্রণালয়। কিন্তু সেটিও আলোর মুখ দেখে না। সিভিল সার্ভিস কমিশনও ঝুলে যায় তখন।
প্রশাসনকে গতিশীল করতে জনপ্রশাসন (সংস্থাপন) মন্ত্রণালয় পদোন্নতি ও নিয়োগ বিধিমালা সংশোধন এবং ক্যারিয়ার প্লানিং রূপরেখা প্রণয়ন সংক্রান্ত প্রস্তাব করে ২০০৭ সালের গোড়ার দিকে। এটি বাস্তবায়নের জন্য হিউম্যান রিসোর্স ম্যানেজমেন্ট কমিটি একটি উপ-কমিটি গঠন করে দেয়। খসড়া প্রণয়ন করে উপ-কিমিটি এই কমিটির কাছে তা জমা দেয়। কিন্তু রহস্যজনক কারণে প্রশাসনের শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তা এগুলো অগ্রসর না করার জন্য পরামর্শ দেওয়া হয়।
২০০৪ সালে রিসোর্স পারসন্স পুল তৈরির জন্য ২০৬ জনের প্রাথমিক তালিকা নিয়ে কাজ শুরু করা হয়। কিন্তু রিসোর্স পারসন্স তালিকা তৈরি করা সম্ভব হয়নি। দক্ষতার ভিত্তিতে পুল গঠন করে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ কেন্দ্র ও উপযুক্ত স্থানে তাদের পদায়নের জন্য এ পদক্ষেপ নেওয়া হয়। এ ছাড়া ২০০৭ সালে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সহযোগিতায় সিভিল প্রশাসন থেকে ইউএন মিশনে কর্মকর্তা পদায়নের নীতিমালা তৈরির কার্যক্রম, প্রশিক্ষণ নীতিমালা, সিআর অধিশাখার সঙ্গে এসিআর মূল্যায়ন পদ্ধতিতে সম্পৃক্ততা করার জন্য নেওয়া উদোগসহ বিভিন্ন প্রস্তাব আজও আলোর মুখ দেখেনি।
ইতোপূর্বে গঠিত বিভিন্ন কমিশন ও কমিটি ॥ বাংলাদেশে অভ্যুদয়ের পর সরকারের জন্য সংগঠন কাঠামো প্রণয়নের লক্ষ্যে ১৯৭১ সালে গঠন করা হয় প্রশাসনিক পুনর্গঠন কমিটি (এআরসি), সার্ভিস কঠামো গঠনের লক্ষ্যে ১৯৭২ সালে গঠিত হয় প্রশাসনিক ও সার্ভিস কঠামো পুনর্গঠন কমিটি, একই বছর ১৯৭২ সালে গঠন করা হয় জাতীয় বেতন কমিশন, এরপর সার্ভিস কাঠামো ও বেতন সংক্রান্ত বিষয়াবলি সমাধানের লক্ষ্যে ১৯৭৭ সালে গঠন করা হয় বেতন ও সার্ভিস কমিশন, এর পর ১৯৮২ সালে মন্ত্রণালয়/বিভাগ/পরিদপ্তর ও অন্যান্য সংস্থার সাংগঠনিক কাঠামো পরীক্ষা সংক্রান্ত সামরিক আইন কমিটি গঠন করা হয়।
এর প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সরকারি খাতের সংস্থাসমূহের সংগঠন ও জনবল যৌক্তিকীকরণ। একই বছর ১৯৮২ সালে জেলা/উপজেলা ও মাঠ পর্যায়ের প্রশাসনের পুনর্গঠনের লক্ষ্যে গঠিত হয় প্রশাসনিক সংস্কার ও পুনর্গঠন কমিটি, ১৯৮৪ সালে গঠন করা হয় তৃতীয় বেতন কমিশন, পদোন্নতি বিষয়াবলী সংক্রান্ত বিষয়ে ১৯৮৫ সালে গঠন করা হয় প্রশাসনিক উন্নয়ন সংক্রান্ত সচিব কমিটি, সিনিয়র সার্ভিস পুল কাঠামোকে (এসএসপি) উদ্দেশ্য করে ১৯৮৫ সালে গঠন করা হয় সিনিয়র সার্ভিস পুল কঠামো পুনর্বিবেচনা সংক্রান্ত বিশেষ কমিটি, ১৯৮৭ সালে গঠন করা হয় মন্ত্রিপরিষদ উপকমিটি।
উদ্দেশ্য ছিল এসএসপি পর্যালোচনা ও পদোন্নতির বিভিন্ন বিষয়, কতিপয় সরকারি দপ্তর রাখা বা না রাখার প্রয়োজনীয়তা দেখা দেওয়ায় এ লক্ষ্যে ১৯৮৯ সালে গঠন করা হয় পরিবর্তিত অবস্থার আলোকে কতিপয় সরকারি দপ্তর রাখার প্রয়োজনীয়তা পুনঃপরীক্ষা কমিটি, একই বছর ১৯৮৯ সালে গঠিত হয় চতুর্থ জাতীয় বেতন কমিশন, ১৯৯১ সালে গঠন করা হয় স্থানীয় সরকার পর্যালোচনা কমিশন, ১৯৯৬ সালে গঠন করা হয় পঞ্চম জাতীয় বেতন কমিশন, মন্ত্রণালয়/অধিদপ্তর ইত্যাদি কাঠামো ও জনবল যৌক্তিকীকরণ বিষয়ে ১৯৯৬ সালে গঠন করা হয় প্রশাসনিক পুনর্বিন্যাস কমিটি (এআরসি), স্থানীয় সরকার প্রতিষ্ঠানগুলোর শক্তি বৃদ্ধির লক্ষ্যে ১৯৯৭ সালে গঠিত হয় স্থানীয় সরকার কমিশন।
এর পর ২০০৫ ও ২০০৯ সালে ষষ্ঠ ও সপ্তম পে-কমিশন বাস্তবায়ন করা হয়। এ টি এম শামসুল হক কমিশনের রিপোর্টে সিভিল সার্ভিসে নিয়োগের ক্ষেত্রে কোটা পদ্ধতি ক্রম বিলোপ করার সুপারিশ করা হয়। এ ছাড়া পাবলিক সার্ভিস পরীক্ষায় বস্তুনিষ্ঠতা বাড়ানো (ঐচ্ছিক বিষয় বাদ দেওয়া, পৃথক মনস্তাত্ত্বিক পরীক্ষা ব্যবস্থা করা), নির্ধারিত মেয়াদে (যোগ্যদের) অটোপদোন্নতি প্রদান করা, মন্ত্রণালয়গুলোকে বিভিন্ন গুচ্ছে বিভক্ত করা, চাকরি থেকে অবসরের বয়স ৬০ বছরে উন্নীত করা, কাজের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ প্রশিক্ষণের ব্যবস্থা করা, সুশাসনের প্রতিশ্রুতি সম্বলিত একটি বেতন নীতি চালু করাসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ সুপারিশ করে।