আইনজীবী ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাশেম (আরমান)
গুম হওয়ার দীর্ঘ ৮ বছর পর কথিত বন্দিশালা ‘আয়না ঘর’ থেকে সদ্য মুক্তি পাওয়া সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী ব্যারিস্টার মীর আহমদ বিন কাশেম (আরমান) গুম কমিশনে অভিযোগ দায়ের করেছেন।
মঙ্গলবার (২৯ অক্টোবর) দুপুরে তার পক্ষে সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী মুহাম্মদ মুজাহিদুল ইসলাম শাহিন গুম কমিশনে অভিযোগ দাখিল করেন। গুম কমিশনের সদস্য নূর খান লিটন আবেদন গ্রহণ করে গুরুত্ব সহকারে তদন্ত করা হবে বলে জানিয়েছেন।
ব্যারিস্টার আরমানের অভিযোগ, ‘২০১৬ সালের ৯ আগস্ট রাত ১১টার দিকে আমার বাসায় সিভিল পোশাক পরিহিত ৭/৮ জন ব্যক্তি কলিং বেল প্রেস করে। দরজা খুলে দিলে তারা বাসায় প্রবেশ করে। তাদের সবার কাছে অস্ত্র ছিল এবং অস্ত্রের মধ্যে সিরিয়াল নাম্বারও লেখা ছিল। দেখে বোঝা যাচ্ছিল তারা কোনো বাহিনীর লোক। তখন তারা আমাকে বলে যে, আমার কাছে তাদের কিছু প্রশ্ন আছে এবং আমাকে তাদের সাথে যেতে হবে। আমি বলেছিলাম আপনারা কারা, কেন আমাকে নিয়ে যাবেন? আমার নামে কোন ওয়ারেন্ট আছে কি না?’
‘তারা বলে, আমাদের সাথে গেলেই সব বুঝতে পারবেন। অত:পর জোরপূর্বক আমাকে আমার স্ত্রী-সন্তানদের সামনে থেকে টেনে-হিঁচড়ে নিয়ে যায় ও সাদা মাইক্রো গাড়িতে উঠায়। গাড়িতে উঠানোর পর তারা আমার হাত ও চোখ বেঁধে দেয়। আমি বলি আমার চোখ বাঁধছেন কেন? তারা বলেন, এটাই আমাদের নিয়ম এবং সাথে গেলেই সবকিছু বুঝতে পারবেন।’
‘আমার পিতা মীর কাসেম আলী বাংলাদেশের একজন বিশিষ্ট ব্যবসায়ী ও রাজনীতিবিদ। তার বিরুদ্ধে মানবতাবিরোধী অপরাধের অসত্য অভিযোগ এনে তৎকালীন শেখ হাসিনা সরকার আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কথিত বিচার শুরু করেন। আমি আমার বাবার মামলা পরিচালনায় পারিবারিকভাবে দায়িত্বরত ছিলাম এবং একজন আইনজীবী হিসেবে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করার লক্ষ্যে আইনজীবী প্যানেলের সাথে বাবার হয়ে আইনি লড়াই চালিয়ে যাচ্ছিলাম। সে কারণে বাবার মামলা সংক্রান্ত অনেক গুরুত্বপূর্ণ তথ্য ও নথি আমার কাছে সংরক্ষিত ছিল।’
‘বাবার মামলাটি যখন শেষ পর্যায়ে ছিল অর্থাৎ ট্রাইব্যুনালের রায়, এরপর আপিল, আপিলের পর রিভিউ শুনানির একেবারে শেষ পর্যায়ে এবং কিছুদিন পরেই রায় কার্যকর হয়ে যাবে। এমতাবস্থায়, বাবার মামলা পরিচালনা এবং ন্যায় বিচার বাধাগ্রস্ত করার পূর্বপরিকল্পিত উদ্দেশ্যেই আমার বাবা মীর কাসেম আলীর ফাঁসি কার্যকর হওয়ার চার সপ্তাহ পূর্বে আমাকে জোরপূর্বক গুম করা হয়। পরিবারের সদস্যরা আমার নিখোঁজ হওয়ার সাথে সাথেই নিকটস্থ পল্লবী থানায় শরনাপন্ন হলে দায়িত্বরত অফিসাররা কোনো আইনী পদক্ষেপ নেয়নি এবং আমাকে খুঁজে পাওয়ার বিষয়ে কোনো সহযোগীতা করেনি বরং আমি আত্মগোপন করেছি বলে আমার পরিবারের সদস্যদের কাছে অপবাদ দেওয়া হয়।’
‘অতঃপর তারা আমাকে একটি জায়গায় নিয়ে গিয়ে একটি নির্জন কক্ষে/সেলে বন্দি করে রাখে। জায়গাটি কোথায় আমি বুঝতে পারিনি। কিন্তু এতটুকু বলতে পারি যে, সেলটি খুবই পুরোনো ছিল। সেখানে আমি ১৬দিন অবস্থান করি। স্যাতস্যেতে আবহাওয়া এবং ফ্লোরে ইঁদুর ঘুরে বেড়াতো।’
‘সার্বক্ষণিক তারা আমার চোখ ও হাত বেধে রাখতো। সেখানকার অস্বাস্থ্যকর পরিবেশে আমি প্রচণ্ড অসুস্থ হয়ে পড়ি। ১৬ দিনের মাথায় এক মধ্যরাতে আমাকে সেখান থেকে গাড়িতে করে অন্যত্র নিয়ে যাওয়া হয়। বুঝতে পারছিলাম না কোথায় নিয়ে যাচ্ছে।’
‘আনুমানিক আধা ঘণ্টার মধ্যে আমাকে নিয়ে তারা দ্বিতীয় লোকেশনে পৌঁছায়। সেখানে টাইলস করা ফ্লোর আর রুমের সাথে টয়লেট ছিল। সেখানকার প্রহরীরা অনেক কঠোর ছিল। তাদের কথাবার্তা খুবই কঠোর, চাল-চলন অনেক সুশৃঙ্খল, খাওয়া দাওয়ার বিষয়টিও ছিল নিয়মতান্ত্রিক। সবসময় বলতো তাদের উপর আদেশ করা হয়েছে। দিনের বেলা দুই হাতে সামনের দিক থেকে হাতকড়া পরানো থাকতো আর রাতে হাত পিছনে নিয়ে হাতকড়া পরিয়ে রাখতো। টয়লেটের ভেতর গোসল করার সময় হাত খোলার অনুমতি ছিল। একহাতে হাতকড়া পরানো থাকতো, আরেক হাত খোলা থাকতো। গোসল শেষ করে ভালমতো চোখ বেধে ওদেরকে আওয়াজ দিতে হতো। তখন ওরা এসে আবার চেক করতো সব ঠিকঠাক বাধা আছে কি না। তারপর তারা চলে যেতো। তিনবেলা খাবার দেওয়া হতো। গোসলের সময় বামহাত খুলে দিতো, আর খাবারের সময় ডান হাত খুলে দিতো। যখন হাতকড়া খুলে দিতো তখন একটু চোখ খুলতে পারতাম কিন্তু ওরা বকাবকি করতো। কোনদিকে তাকানোর নিয়ম ছিল না। প্রচণ্ড কঠোরতা অবলম্বন করা হতো।’
‘আমি যেখানে ছিলাম সেখান থেকে খুব কাছেই ইন্টারোগেশন রুম ছিল। আমি ইন্টারোগেশনের হালকা আওয়াজ শুনতে পেতাম। যাদের ওপর নির্যাতন চলছে তাদের আওয়াজে ঘুমাতে পারতাম না। এভাবে দীর্ঘ ৮ (আট) বছর আমাকে সেখানে গুম করে রাখা হয়েছে। এই দীর্ঘ সময়ে আমি কোনো প্রাকৃতিক আলো-বাতাসের ছোঁয়া পাইনি।’
টুম্পা