ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ১৩ কার্তিক ১৪৩১

কাজ পেতে মরিয়া এক্সিলারেট ও সামিট

নতুন ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে জানুয়ারিতে দরপত্র

​​​​​​​স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:২৭, ২৮ অক্টোবর ২০২৪

নতুন ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল  নির্মাণে জানুয়ারিতে দরপত্র

.

বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের করা বিদ্যুৎ জ্বালানি খাতের বিশেষ বিধান আইনের অধীনে কোনো চুক্তি নবায়ন না করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে সরকার। এর প্রেক্ষিতেই আমদানি করা তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস (এলএনজি) রূপান্তর করে সরবরাহের জন্য বর্তমানে উৎপাদনে থাকা দুই কোম্পানির সঙ্গে দ্বিতীয় টার্মিনাল নির্মাণের চুক্তি বাতিল করেছে অন্তর্বর্তী সরকার। এর বদলে উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে নতুন করে ভাসমান টার্মিনালের পাশাপাশি স্থায়ী টার্মিনাল নির্মাণের পরিকল্পনাও করা হয়েছে। তবে ব্যয়সাপেক্ষ এই প্রকল্পের জন্য যে সময় প্রয়োজন, তা এই সরকার না পেলেও ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল তৈরিতে নতুন চুক্তি করতে আগামী জানুয়ারিতেই দরপত্র আহ্বান করা হবে। যদিও বর্তমানে উৎপাদনে থাকা দুই কোম্পানি সামিট এবং এক্সিলারেট পুনরায় কাজ পেতে মরিয়া। কিন্তু উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমেই নতুন কোম্পানি নির্ধারণ করা হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজসম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবীর খান।

দেশের জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিত রাখতে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার বিদ্যুৎ জ্বালানির দ্রুত সরবরাহ আইনের (বিশেষ বিধান) অধীন আরও ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের সিদ্ধান্ত নিয়েছিল। এরই প্রেক্ষিতে বর্তমানে উৎপাদনে থাকা প্রতিষ্ঠান সামিট এবং মার্কিন প্রতিষ্ঠান এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে চুক্তি করার আনুষ্ঠানিকতা শুরু করে। এর মধ্যে গত ৩০ মার্চ সামিট এলএনজির সঙ্গে সরকারের চুক্তিও হয়। যা গত অক্টোবর বাতিল করে অন্তর্বর্তী সরকার। কিন্তু টার্মিনাল পুনর্নির্মাণে মরিয়া এই কোম্পানিটি। দেশের রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে সশরীরে তদ্বির করার সুযোগ না থাকলেও চুক্তি বাতিল সিদ্ধান্তের প্রেক্ষিতে আপিল করেছে কোম্পানিটি। একই রকমভাবে টার্মিনাল পুনর্নির্মাণে মরিয়া এক্সিলারেটও। আইনি কোনো জটিলতা না থাকায় অন্তর্বর্তী সরকারের বিভিন্ন দপ্তরে সশরীরেই তদবির চালাচ্ছেন প্রতিষ্ঠানটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। মার্কিন এই কোম্পানিটি বর্তমানে কক্সবাজারের মহেশখালীতে একটি এলএনজি টার্মিনাল পরিচালনা করছে। বিগত সরকার একই কোম্পানিকে পায়রাতে আরও একটি এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণের কার্যাদেশ দিতে যাচ্ছিল। অন্তর্বর্তী সরকারবিদ্যুৎ-জ্বালানি দ্রুত সরবরাহ বৃদ্ধি বিশেষ বিধান ২০১০বাতিল করায় আগের সরকারের সেই উদ্যোগটি বাদ পড়েছে। কিন্তু মার্কিন কোম্পানিটি চাইছে, বর্তমান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক উন্নয়ন করে সেই ক্ষতি পুষিয়ে নিতে।

বাংলাদেশ তেল, গ্যাস খনিজ সম্পদ করপোরেশনের (পেট্রোবাংলা) তথ্যমতে, গত নভেম্বরে এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে বিগত সরকার একটি টার্মশিট সই করে। মূলত চুক্তিতে কী কী বিষয় অন্তর্ভুক্ত থাকবে, তা ওই টার্মশিটে উল্লেখ ছিল। কিন্তু বিশেষ ক্ষমতা আইন বাতিল করাতে গত সপ্তাহে চুক্তি বাতিলের বিষয়টি এক্সিলারেট এনার্জিকে আনুষ্ঠানিকভাবে জানিয়েছে পেট্রোবাংলা। এরপরই কাজটি পেতে মরিয়া হয়ে ওঠে মার্কিন  কোম্পানিটি। বর্তমান সরকারের সঙ্গে সম্পর্ক চালু রাখতে সাবেক মার্কিন রাষ্ট্রদূত পিটার হাসকে তাদের উপদেষ্টাও নিয়োগ করে। এরই ধারাবাহিকতায় গত ১৫ অক্টোবর প্রধান উপদেষ্টা . মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গেও দেখা করেন কোম্পানিটির ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। ওই সাক্ষাতে কোম্পানিটির প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তা (সিইও) স্টিভেন কোবোস অধ্যাপক . ইউনূসকে বলেন, বাংলাদেশের জ্বালানি খাতে কার্বন নিঃসরণ প্রক্রিয়ায় আরও বিনিয়োগের পরিকল্পনা, এলএনজি সরবরাহ বৃদ্ধি এবং তা নির্বিঘœ রাখতে তার কোম্পানি বিনিয়োগ বাড়াতে চায়। একইসঙ্গে তিনি . মুহাম্মদ ইউনূসকে বলেন, তার নেতৃত্বের সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর মার্কিন কোম্পানিগুলোর বাংলাদেশের প্রতি আগ্রহ বেড়েছে। মার্কিন কোম্পানি এক্সিলারেট এনার্জির সঙ্গে চুক্তি বাতিলের পর স্টিভেন কোবোস বাংলাদেশ সফরে আসেন। এই সফরে তিনি বুধবার পেট্রোবাংলা চেয়ারম্যানের সঙ্গেও দেখা করেন। সেখানে তার কোম্পানির উপদেষ্টা পিটার হাসও উপস্থিত ছিলেন।

তবে কোনো ধরনের তদ্বির নয় বরং উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমেই এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণে নতুন চুক্তি হবে বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান।

জনকণ্ঠকে তিনি বলেন, নিরবচ্ছিন্ন জ্বালানি নিশ্চিতে আমরা দেশীয় কূপগুলো পুনরায় খননকাজ শুরু করেছি। আপনারা জানেন সিলেটের একটি কূপে গ্যাস পাওয়া গেছে। বিগত সরকারের আমলে চাহিদা পূরণে অনেকটাই আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ে খাতটি। সাম্প্রতিক সময়ে চাহিদা ক্রমবর্ধমান থাকায় এখনই আমদানি বন্ধ না করতে পারলেও দেশের অভ্যন্তরে থাকা কূপগুলো খনন অনুসন্ধানে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছি আমরা। ২০২৫ সাল থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশে অন্তত ১০০টি কূপ অনুসন্ধান, উন্নয়ন ওয়ার্কওভারের বড় পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হয়েছে। এসব কূপ থেকে গ্যাস পাওয়া সাপেক্ষে আমরা আমদানি করা এলএনজির জন্য স্থায়ী টার্মিনাল নির্মাণের পথে হাঁটব। তবে আগামী বছরের জানুয়ারিতেই ভাসমান এলএনজি টার্মিনাল (এফএসআরইউ) নির্মাণে দরপত্র আহ্বান করা হবে। যারা নির্মাণে আগ্রহী হবে তারা দরপত্র জমা দেবে। যারা সর্বনি¤œ ব্যয়ে নির্মাণ করতে পারবে, তারাই কাজ পাবে। এখানে কোনো ধরনের তদ্বির বা চেহারা দেখে কাজ পাওয়ার আর সুযোগ নেই।

পেট্রোবাংলা সূত্রে জানা যায়, সামিটকে পাঠানো পেট্রোবাংলার চুক্তি বাতিল সংক্রান্ত চিঠিতে বলা হয়, চুক্তির কিছু শর্তভঙ্গের দায়ে এমন ব্যবস্থা নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকারের জ্বালানি খনিজ সম্পদ বিভাগ। এর মধ্যে নির্ধারিত সময়ের মধ্যে পারফরমেন্স গ্যারান্টির টাকা জমা না দেওয়ার বিষয়ও আছে।

কক্সবাজারের মহেশখালীতে সামিটের বর্তমান টার্মিনালটি থেকে এলএনজি সরবরাহ করা হচ্ছে। নতুন আরেকটি টার্মিনাল নির্মাণের চুক্তি হয় গত ৩০ মার্চ। একই দিনে বছরে ১৫ লাখ টন এলএনজি সরবরাহে আরেকটি চুক্তি করে সামিট। চুক্তি অনুযায়ী, ২০২৬ সাল থেকে এলএনজি সরবরাহের কথা। নতুন টার্মিনাল নির্মাণের সঙ্গে এলএনজি সরবরাহের বিষয়টি জড়িত। তাই এলএনজি সরবরাহের চুক্তিটিও বাতিল হতে পারে বলে জানা গেছে।

সব বিষয় নিয়ে পেট্রোবাংলার চেয়ারম্যান জনেন্দ্র নাথ সরকার বলেন, সরকার প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমে এলএনজি টার্মিনাল নির্মাণ করতে আগ্রহী। দরপত্র আহ্বান করা হলে সেখানে যে কেউ অংশ নিতে পারবে। যদিও সরকার ভাসমান টার্মিনাল নির্মাণের চেয়ে স্থায়ী টার্মিনাল নির্মাণের ওপর জোর দিচ্ছে। বঙ্গোপসাগরে মহেশখালী এবং পায়রা দুই জায়গাতেই সাইক্লোনের প্রভাব রয়েছে। একবার ঘূর্ণিঝড়ের আঘাতে পড়লে টার্মিনালগুলো পুনরায় উৎপাদনে আসতে মাঝে মধ্যেই বেগ পেতে হয়। সম্প্রতি সামিটের এলএনজি টার্মিনালটি ঘূর্ণিঝড়ে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ায় অন্তত চার মাস পর ফের উৎপাদনে আসে। কিন্তু আপনারা জানেন ধরনের টার্মিনাল স্থলভাগে নির্মাণ করাতে ব্যয় বেশি এবং সময়সাপেক্ষ। কিন্তু সরকার বিদ্যুৎ জ্বালানি সরবরাহ নিশ্চিতে যে কোনো পদক্ষেপ নিতে প্রস্তুত।

×