ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২৯ অক্টোবর ২০২৪, ১৩ কার্তিক ১৪৩১

লগি-বৈঠার নৃশংসতার প্রতিবাদে আলোচনা সভায় জামায়াত আমির ডা. শফিকুর

কোনো অপশক্তির কাছে মাথানত করব না

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২২:২৮, ২৮ অক্টোবর ২০২৪

কোনো অপশক্তির কাছে মাথানত করব না

রাজধানীর ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবরে নিহতদের স্মরণে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতের আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন দলের আমির ডা. শফিকুর র

জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, অন্যের মত ও মানবতাকে যারা শ্রদ্ধা করবে, তারাই বাংলাদেশে রাজনীতি করবে। কিন্তু ফ্যাসিজমের মাধ্যমে যারা রাজনীতি করবে, তাদের জায়গা বাংলাদেশ নয়। আমরা কোনো অপশক্তির কাছে মাথানত করব না। কোনো অন্যায়ের কাছে আপোস করব না। কোনো লুটের মালে ভাগ বসাব না। আল্লাহ যদি দেশ খেদমতে কবুল করেন, তাহলে ইনশাআল্লাহ সেবক হব, দেশের মালিক হব না। মানুষের জানমাল আবরু রক্ষায় জামায়াতে ইসলামী হবে চৌকিদার, পাহারাদার।
সোমবার সকালে রাজধানীর রমনায় ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউশনে আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি এসব কথা বলেন। ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর আওয়ামী ফ্যাসিস্টদের লগি-বৈঠার নৃশংসতার প্রতিবাদে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ জামায়াতে ইসলামী এ সভার আয়োজন করে। 
জামায়াত আমির বলেন, দৃশ্যত স্বৈরাচারী শেখ হাসিনাসহ ফ্যাসিস্টের দোসররা তাদের কর্মের উপহার পেয়েছেন গত ৫ আগস্ট। তিনি দেশ থেকে পালিয়ে গেছেন। তার সঙ্গীরা পালানোর চেষ্টা করেছেন। কেউ চুরি করে পালিয়েছেন, কেউ বা ধরা পড়েছেন। যারা পালিয়েছেন বা ধরা পড়েছেন মানুষ হিসেবে তাদের এর চেয়ে মৃত্যুই ছিল শ্রেয়। কারণ কোনো রাজনীতিবিদের জন্য পালানো মানায় না। রাজনীতি করবেন রাজকীয় মন নিয়ে, রাজনীতি করবেন পুরো জাতির জন্য। যদি সেটাই করেন, তাহলে পালাতে হবে কেন? জেনেশুনে যারা অন্যায় করে তা অপরাধ উল্লেখ করে তিনি বলেন, কে পালায়, চোর পালায়, ডাকাত পালায়, লুটেরা, গুমকারী, ধর্ষক পালায়। কোনো ভালো মানুষ পালায় না। বিচারের রায় তো তারাই পালিয়ে দিয়েছেন। এখন বিচারিক প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে। এই অন্তর্বর্তীকালীন সরকার হয়তো বিচার শেষ করতে পারবেন না। কিন্তু শুরুটা করতে হবে। আর এই বিচারের প্রক্রিয়া শুরু করতে হবে ২০০৬ সালের ২৮ অক্টোবর থেকে। যেদিন লগি-বৈঠার তা-বে দেশ, রাজনীতি, সমাজ তার পথ হারিয়েছিল। মানবতার মৃত্যু হয়েছিল। ২৮ অক্টোবর থেকে শুরু করে ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট পর্যন্ত যাদের হত্যা করা হয়েছে, প্রত্যেকটি ঘটনার বিচার করতে হবে।
জামায়াত আমির বলেন, যারাই ফ্যাসিজমের বিরুদ্ধে, অন্যায়ের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিল, তাদেরই খুন ও গুমের শিকার হতে হয়েছে। জামায়াত নেতাদের বিরুদ্ধে মিথ্যা খুন, ধর্ষণ, লুণ্ঠনের মামলা দেওয়া হয়েছে। পাতানো বিচারের নামে বিচারিক হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে। সেই নিকৃষ্ট দলটিকে মানুষ কিন্তু দেখেছে ধর্ষক হিসেবে। ধর্ষণের সেঞ্চুরি কারা করেছিল জাতি জেনেছে। আওয়ামী লীগের লম্পট নেতা-কর্মী মন্ত্রীদের লাম্পট্যের ইতিহাস অল্প হলেও গণমাধ্যমে উঠে এসেছে।
গুম-খুনের সংস্কৃতি আওয়ামী লীগ চালু করেছে দাবি করে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, খুন গুমের সংস্কৃতির উৎকর্ষ দান করেছেন শেখ হাসিনা। জায়গায় জায়গায় আয়নাঘর তৈরি করা হয়েছে। এ রকম আয়নাঘরে আমিও ১৩ দিন ছিলাম। তবে আমাকে আগে আদালতে উপস্থাপন করা হয়েছিল। সেই আয়নাঘরে আমি অনেক আলেম-ওলামাকে দেখেছি, যাদের আদালতে তোলাই হয়নি। অথচ দেশের প্রচলিত আইনে বলা হয়েছে, ২৪ ঘণ্টার মধ্যে আদালতে হাজির করতে হবে। গ্রেপ্তারের পরপরই পরিবারকে জানাতে হবে। আপনজনরা জানতই না, তারা বেঁচে আছে নাকি মারা গেছে।
১৯৯৬ সালে হাতজোড় করে অতীতের দলীয় অপরাধের জন্য মাফ চেয়ে ক্ষমতায় আসা আওয়ামী লীগের বিষয়ে একটা মিথ জারি আছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, ‘তারা যা বলে, তা করে না, যা করে তা বলে না।’ তারা কিন্তু এবার না বলেই ধ্বংসযজ্ঞ চালিয়েছে। জাতির ওপরে জেদ মেটাতে গিয়ে নিরস্ত্র মানুষকে খুন করে পেট্রোল ঢেলে আগুনে ছাই করে দিয়েছে। আবার অনেকে বলে আওয়ামী লীগ নাকি রাজনীতি ও নির্বাচনে অংশ নিতে চায়। যারা গোটা জাতির বিরুদ্ধে যুদ্ধ করেছে, তারা নির্বাচনে ভোট চাইবে কার কাছে? ভোট চাইবার, ভোটের ময়দানে ফিরে আসার মতো নৈতিক অধিকার তাদের নেই। যদি জনগণের ভোটেই তাদের আস্থা বিশ্বাস থাকত, তাহলে গত তিনটি নির্বাচন সুষ্ঠু দিত। তারা তো সেটা চায়নি। তারা চেয়েছে মেরে কুটে যেভাবেই হোক, ক্ষমতায় থাকতে হবে। এজন্য তারা মানুষকে মেরে কেটে পুড়িয়ে শেষ রক্ষার চেষ্টা করেছে। অথচ আল্লাহ যাকে ইচ্ছে ক্ষমতা দেন আবার যাকে ইচ্ছে ক্ষমতা কেড়ে নেন। তারা হয়তো সেটা কল্পনা করেনি, আমরাও করিনি।
তিনি বলেন, গণমাধ্যমকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। জামায়াতের সাদাকে সাদা, কালোকে কালো বলে তুলে ধরুন। আমার মধ্যে কালিমা থাকলে আমাকেও ছাড় দেবেন না। জাতির বিবেক দর্পণ হিসেবে সব ক্ষেত্রে সাদাকে সাদা কালোকে কালো বলার আহ্বান জানান তিনি। বাংলাদেশকে যারা গড়তে চান, তাদের জন-আকাক্সক্ষাকে সম্মান ও অন্তরে ধারণ করে রাজনীতি করার আহ্বান জানিয়ে ডা. শফিকুর রহমান বলেন, ফ্যাসিবাদবিরোধী জনগণ কী চায় সেটা বুঝতে হবে, রাজনীতি করতে হবে। সেটা পারলে আমরা পাব জনগণের দোয়া সহযোগিতা। আবার যদি আমরাও ভুল করি তাহলে যে জনগণ ফুঁসে উঠতে পেরেছিল চব্বিশে তারা আবার যে কোনো সময় ফুঁসে উঠতে পারে। সুতরাং সাবধান হতে হবে। জাতীয় জীবনে কোনো সংকট আমরা চাই না। মৌলিক স্বার্থে জাতিকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে।
তিনি আরও বলেন, দেশবাসীর স্বপ্নের বৈষম্যমুক্ত দুর্নীতিমুক্ত মানবিক বাংলাদেশ চাই। সেই বাংলাদেশের জন্য আমরা যুব সমাজকে যাচাই করে নিতে চাই। যুব সমাজের ওপরে আমাদের যথেষ্ট আস্থা আছে। যারা দায়িত্ব নিয়ে বুকের রক্ত ঢেলে দিয়ে মুক্তির স্বাদ এনে দিয়েছে, তারা আমাদের আগামীর বাংলাদেশও গড়ে দিতে পারবে। আমরা তারুণ্যনির্ভর, ইনসাফভিত্তিক সমাজ রাষ্ট্র বিনির্মাণে দেশবাসীর সহযোগিতা চাই।
অনুষ্ঠানে বিশেষ অতিথি বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য মির্জা আব্বাস বলেছেন, জামায়াত ইসলামী, বিএনপি ও অন্যান্য দল যদি একসঙ্গে কাজ করতে পারি, তখন দেশটা পুনর্গঠিত হতে পারে। তা না হলে আমাদের নিয়ে প্রতিবেশী দেশ খেলতেই থাকবে। এটা কখনোই হতে দেওয়া যাবে না। ৫ আগস্ট ভারত জেনেছে, বাংলাদেশের স্বার্থে দেশের মানুষ ঐক্যবদ্ধ হয়ে ওঠে। ইস্পাত কঠিন ঐক্য চলে আসে।
তিনি বলেন, বিগত দিনের কষ্ট এখন আমাদের কাছে গল্প। আমরা শুকরিয়া আদায় করি, দীর্ঘদিনের কষ্টের ফসল আমরা ৫ আগস্ট ঘরে তুলেছি। এই ৫ আগস্ট আমাদের একটি চাওয়া পূরণ হয়েছে শেখ হাসিনাবিহীন বাংলাদেশ। এখন আমরা আওয়ামী লীগবিহীন বাংলাদেশ চাই। আওয়ামী লীগ আর ভদ্রলোকের গণতন্ত্র কখনো পাশাপাশি চলতে পারে না। শয়তানের দোসর আওয়ামী লীগ। আমরা খুশি হই যে, তারা চলে গেছে। আসলে খুশি হওয়ার কারণ নেই উল্লেখ করে তিনি বলেন, তাদের চর-অনুচর রাজনীতি, সংস্কৃতি, সচিবালয়, মিলিটারি সব জায়গায় উপস্থিত আছে। এদের রেখে কোনোভাবে বাংলাদেশে গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠা করা যাবে না। এখনো বাংলাদেশে আওয়ামী লীগ নতুন নতুন থিওরি আওড়িয়ে যাচ্ছে। তা আমাদের মুখ দিয়েই বের করানোর চেষ্টা করছেন। আমরা গিনিপিগ না। নতুন করে যাদের জন্ম হয়েছে, তারা আমাদের শ্রমের মর্ম বুঝবে না। তারা বুঝবে না সাঈদী, নিজামীর মতো নেতারা জীবন দিয়ে গেছেন। বিএনপির শত শত কর্মী জীবন দিয়েছেন। এখনো জেলে আছে, মামলা আছে। আমার বিরুদ্ধে এখনো মামলা আছে ১০০ এর ওপরে। তবুও এখন গ্রেপ্তার হবো না, তাই শান্তি আছে।
বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা আবদুস সালাম বলেছেন, কোনোভাবেই ভারতীয় আগ্রাসনের পক্ষের শক্তি ১৪ দলীয় জোট যেন বাংলাদেশের রাজনীতিতে পুনর্বাসন হতে না পারে, সে বিষয়ে আমাদের ঐক্য থাকতে হবে। নিজের ঘরের মধ্যে কিছু যদি থাকে তা আমরা আলোচনা করব। আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করব। কিন্তু শত্রুর হাতে যেন ক্ষমতা না দেই। তারা এখনো মাঝেমধ্যে উঁকিঝুঁকি দেয়।
তিনি আরও বলেন, লগি-বৈঠার মাধ্যমে যে হত্যা করা হয়েছে, তার হুকুমদাতা শেখ হাসিনা। টেলিভিশনের বিভিন্ন রেকর্ড যদি দেখি, তাহলেই তার প্রমাণ পাব। এমন বহুবার আছে তিনি মানুষ মারার নির্দেশ দিয়েছেন। এমন একজন ফ্যাসিস্ট বাংলাদেশে যেন আর ফিরে আসতে না পারে, সেটার জন্য ঐক্য দরকার। পাশাপাশি রাজনীতির বাইরে যে রাষ্ট্রীয় শক্তি রয়েছে তাদেরও ঐক্যবদ্ধ হতে হবে।
নির্বাচন প্রসঙ্গে তিনি বলেন, সবাই নির্বাচন চাই, কেউ হয়তো আগে বা পরে। কিন্তু এটা আমাদের অবস্থান। তারেক রহমান বলেছেন, নির্বাচনে যেই জিতুক, আন্দোলনকারী সব শক্তিকে নিয়েই সরকার গঠন করব। এ সময় তিনি মানবতাবিরোধী অপরাধের মামলায় আটক জামায়াত নেতা এটিএম আজহারের মুক্তি দাবি করেন।
 

×