ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ২৪ অক্টোবর ২০২৪, ৮ কার্তিক ১৪৩১

রাষ্ট্রপতি ইস্যুতে দিনভর আলোচনা

কোন পথে সমাধান

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২২:১১, ২৩ অক্টোবর ২০২৪

কোন পথে সমাধান

সবার দৃষ্টি এখন বঙ্গভবনে

সবার দৃষ্টি এখন বঙ্গভবনে! রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিনকে অপসারণে চাপ বাড়লেও সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলো সতর্ক অবস্থায় এগুচ্ছে। রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন নিজে পদত্যাগ করবেন, নাকি সরকার এ বিষয়ে উদ্যোগ নেবে, রাষ্ট্রপতি পদত্যাগ করলে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হবে কি না- এসব বিষয় নিয়েই সর্বত্র চলছে জোর আলোচনা। শেষ পর্যন্ত রাষ্ট্রপতিকে যদি অপসারণের পক্ষেই অবস্থান নেওয়া হয়, তবে অপসারণের পদ্ধতি কী হবে, তা আগামী দু’তিন দিনের মধ্যে তা স্পষ্ট হতে পারে।
বুধবার প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে অনুষ্ঠিত বৈঠকে বিএনপির পক্ষ থেকে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে বলে সতর্ক করা হয়েছে। দলটি আশঙ্কা ব্যক্ত করে বলেছে, এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে সাংবিধানিক সংকট  তৈরি হবে, পাশাপাশি গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ বিলম্বিত হতে পারে। অবশ্য প্রধান উপদেষ্টার পক্ষ থেকে তার প্রেস সচিব সাংবাদিকদের প্রশ্নের জবাবে স্পষ্ট জানিয়েছেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের ব্যাপারে এখনো কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে পরিদর্শনে গিয়ে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়ে সাংবাদিকদের কোনো প্রশ্নের জবাব দিতে রাজি হননি আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল। 
বুধবার সচিবালয়ের নিজ অফিস কক্ষে তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা মো. নাহিদ ইসলাম সাংবাদিকদের এ ইস্যুতে বলেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয়টি রাজনৈতিক সিদ্ধান্তের বিষয়। এটা আইনি সিদ্ধান্তের বিষয় নয়। যৌক্তিক সময়ের মধ্যে রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের বিষয় সিদ্ধান্ত হবে। তাই বঙ্গভবন বা অন্য কোথাও কোনো ধরনের বিক্ষোভ বা আন্দোলনের প্রয়োজন নেই। জনগণের বার্তা আমরা পেয়েছি এবং আমরা সে বিষয়ে আলোচনা করেছি। আলোচনার মাধ্যমে এ বিষয়ে সিদ্ধান্তে যেতে হবে। 
রাষ্ট্রপতির অপসারণ সংক্রান্ত বিষয়ে উদ্ভূত পরিস্থিতিতে মঙ্গলবার প্রধান বিচারপতি ড. সৈয়দ রেফাত আহমেদের সঙ্গে বৈঠক করেন অন্তর্বর্তী সরকারের আইন উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. আসিফ নজরুল এবং তথ্য ও সম্প্রচার উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম। এছাড়া রাত দেড়টা পর্যন্ত বঙ্গভবনের সামনে বিক্ষোভ করেছে আন্দোলনকারীরা, তারা ব্যারিকেড ভাঙারও চেষ্টা করে। গভীর রাতে কয়েক উপদেষ্টার মধ্যস্থতায় রাত পৌনে দুটায় বিক্ষোভকারীরা বঙ্গভবন এলাকা ছেড়ে চলে যান। 
উল্লেখ্য, সম্প্রতি মানবজমিন পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মতিউর রহমান চৌধুরীর সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে রাষ্ট্রপতি মো. সাহাবুদ্দিন বলেন, তিনি শুনেছেন শেখ হাসিনা পদত্যাগ করেছেন, কিন্তু তার কাছে এ সংক্রান্ত কোনো দালিলিক প্রমাণ বা নথিপত্র নেই। রাষ্ট্রপতি এও বলেছেন, ‘(পদত্যাগপত্র সংগ্রহ করা) বহু চেষ্টা করেও আমি ব্যর্থ হয়েছি। তিনি হয়তো সময় পাননি।’ পরে অবশ্য বঙ্গভবনের প্রেস উইং থেকে বিবৃতি দিয়ে বলা হয়, প্রধানমন্ত্রীর পদত্যাগের বিষয়টি একটি মীমাংসিত ইস্যু। 
মূলত রাষ্ট্রপতির এমন বক্তব্য প্রকাশের পর অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টাসহ বিভিন্ন মহলে সমালোচনার ঝড় বয়ে যায়। তার পদত্যাগের দাবি তোলেন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের শিক্ষার্থীসহ বিভিন্ন সংগঠনের নেতৃত্বদানকারীরা। 
সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টি যেন না হয়-বিএনপি ॥ চলমান পরিস্থিতিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে  বৈঠকের পর বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান বলেছেন, এখানে সব রাজনৈতিক দল, শ্রেণি-পেশার সংগঠন, ছাত্র-যুব সংগঠন সবার দৃঢ় ঐক্য গড়ে তোলা দরকার। যাতে কেউ কোনোভাবে দেশে নতুন করে সাংবিধানিক সংকট কিংবা রাজনৈতিক সংকট  তৈরি করতে না পারে, এ ব্যাপারে সবাইকে হুঁশিয়ার থাকতে হবে।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তার বাসভবন যমুনায় বিএনপির প্রতিনিধি দলের  বৈঠকের পর বুধবার এক ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান তিনি। যমুনার সামনে এই ব্রিফিং হয়।
আওয়ামী লীগ ও তাদের সহযোগী দলগুলোর প্রতি ইঙ্গিত করে নজরুল ইসলাম খান বলেন, তাদের দোসররা নানা কৌশলে, নানাভাবে দেশে রাজনৈতিক ও সাংবিধানিক সংকট সৃষ্টির চেষ্টা করছে। আমরা মনে করি, দীর্ঘদিন লড়াই করে বহু রক্তের বিনিময়ে আমরা যে পরিবর্তন অর্জন করেছি এই পরিবর্তন সুরক্ষা এবং গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠার জন্য আমাদের জাতীয় ঐক্য আরও সুদৃঢ় করা দরকার।
তিনি বলেন, তাদের দোসররা যদি কোনো সাংবিধানিক ও রাজনৈতিক সংকট  তৈরির চেষ্টা করে তাহলে গণতন্ত্রকামী ও আন্দোলনরত রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন সংগঠন আমরা ঐক্যবদ্ধভাবে মোকাবিলা করব। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধানের সঙ্গে রাজনৈতিক সংলাপ চালিয়ে আসছি। তারই ধারাবাহিকতায় আজ আমরা আলোচনা করছি।
দেশের বিদ্যমান রাজনৈতিক পরিস্থিতি নিয়ে  বৈঠকে আলোচনা হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে নির্বাচনের ক্ষেত্র প্রস্তুতের জন্য যে সংস্কার চলছে সে কাজ ঐকমত্যের ভিত্তিতে ও দ্রুত সম্পন্ন করে নির্বাচনের মাধ্যমে জনগণের সরকার প্রতিষ্ঠার জন্য আলোচনা করছি। জনগণের দাবি, চলমান সংকটগুলো নিরসন করা, এই আন্দোলনের মূল আকাক্সক্ষা গণতন্ত্র পুনর্প্রতিষ্ঠা করা।
রাষ্ট্রপতি পদত্যাগের বিষয়ে কোনো মতামত জানতে চাওয়া হয়েছে কি না জানতে চাইলে নজরুল ইসলাম খান বলেন, স্পেসিফিক কোনো ব্যাপার না। আমরা বলেছি, দেশে নতুন কোনো সাংবিধানিক বা রাজনৈতিক সংকট সৃষ্টি না হয় সেদিকে সবার খেয়াল রাখতে হবে। যদি কেউ সেটা করতে চায়, সেটাকে আমরা সবাই মিলে মোকাবিলা করব। তিনি বলেন, দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতিতে জনগণ যে কষ্ট পাচ্ছে সেটা দূর করার ব্যাপারে সরকারকে আরও কঠোর ও কার্যকর ভূমিকা পালনের কথা বলেছি।
প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে  বৈঠকে বিএনপি নেতাদের মধ্যে উপস্থিত ছিলেন স্থায়ী কমিটির সদস্য নজরুল ইসলাম খান, আমির খসরু মাহমুদ চৌধুরী ও সালাউদ্দিন আহমেদ। আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলমও  বৈঠকে উপস্থিত ছিলেন।
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে-সালাহউদ্দিন ॥ রাষ্ট্রপতির পদত্যাগে সাংবিধানিক শূন্যতা সৃষ্টি হতে পারে বলে সতর্ক করেছেন বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য সালাহউদ্দিন আহমেদ।
বুধবার বিএনপি চেয়ারপারসনের রাজনৈতিক কার্যালয় গুলশানে সাংবাদিকদের সঙ্গে আলাপকালে তিনি এ মন্তব্য করেন।
তিনি বলেন, রাষ্ট্রপতির পদত্যাগ ইস্যুতে ফ্যাসিবাদের দোসররা যেনো সুযোগ নিতে না পারে, সে বিষয়ে সজাগ থাকতে হবে। এই মুহূর্তে রাষ্ট্রপতির পদ শূন্য হলে সাংবিধানিক সংকট  তৈরি হবে, পাশাপাশি গণতন্ত্রে উত্তরণের পথ বিলম্বিত হতে পারে।
রাষ্ট্রপতির পদত্যাগের ব্যাপারে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি- প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব ॥ রাষ্ট্রপতিকে অপসারণের দাবিতে নতুন কিছু ঘটলে তা জানানো হবে বলে মন্তব্য করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব শফিকুল আলম। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তার বাসভবন যমুনায় বিএনপির প্রতিনিধি দলের  বৈঠকের পর বুধবার যমুনার সামনে এক ব্রিফিংয়ে এ কথা জানান তিনি।
রাষ্ট্রপতিকে নিয়ে আইন উপদেষ্টার বক্তব্য এবং সরকারের একমত পোষণের পরবর্তী ধাপে সরকার কী পদক্ষেপ নিচ্ছেÑ এমন প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, এখন পর্যন্ত এই বিষয়ে আমাদের কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। রাষ্ট্রপতি পদত্যাগের বিষয়ে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি এটা কি আমরা লিখতে পারি? এই প্রশ্নের জবাবে প্রেস সচিব শফিকুল আলম বলেন, এটা লিখতে পারেন। 
শফিকুল আলম বলেন, বিএনপি নেতাদের সঙ্গে বেলা ১১টার দিকে প্রধান উপদেষ্টার  বৈঠক হয়েছে। এ সময় আইন উপদেষ্টা ড. আসিফ নজরুল ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজ আলম উপস্থিত ছিলেন। বিএনপির সঙ্গে এ  বৈঠক রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে চলমান সংলাপের অংশ বলেও উল্লেখ করেন তিনি।
রাষ্ট্রপতির অপসারণের দাবিতে আন্দোলন চলছে, আল্টিমেটাম দেওয়া হয়েছে। এ বিষয় নিয়ে বিএনপির সঙ্গে আলোচনা হয়েছে কিনা-জানতে চাইলে শফিকুল আলম বলেন, রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আমাদের প্রচুর কথা হচ্ছে। এটার অংশ হিসেবে বুধবার বিএনপির সঙ্গে কথা হয়েছে। কোনো ডেভেলপমেন্ট হলে আপনারা জানবেন।
রাষ্ট্রপতি অপসারণের বিষয়ে সরকারের অবস্থান কী-জানতে চাইলে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, আমাদের অবস্থান তো আপনারা দেখছেন। যারা বিক্ষোভ করেছে, তাদের বলেছি তারা যেন বঙ্গভবনের পাশ থেকে সরে যান? মঙ্গলবার থেকে বঙ্গভবনের আশপাশে নিরাপত্তা বাড়িয়েছি।
মঙ্গলবার রাতে প্রধান উপদেষ্টার অসুস্থতা নিয়ে ছড়িয়ে পড়া গুজব নিয়ে শফিকুল আলম বলেন, আমরা প্রচুর কল পেয়েছি। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের স্বাস্থ্য নিয়ে অনেকে অনুসন্ধান করেছেন। আমরা জানাতে চাই, তিনি সম্পূর্ণ সুস্থ এবং ভালো আছেন। প্রতিদিনই তিনি মিটিং করেন, তার ছবি দিচ্ছে। মঙ্গলবারও অনেক মিটিং করেছেন। বুধবারও তিনি বিএনপির সঙ্গে মিটিংয়ে ছিলেন।
ব্রিফিংকালে প্রধান উপদেষ্টার উপ-প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার ও অপূর্ব জাহাঙ্গীর উপস্থিত ছিলেন।

×