ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ২২ অক্টোবর ২০২৪, ৭ কার্তিক ১৪৩১

বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি ছাড়া যানজট নিরসন হবে না

রাজধানীর সড়কই নিরাপদ নয়

ইবরাহীম মাহমুদ আকাশ

প্রকাশিত: ২২:৩৫, ২১ অক্টোবর ২০২৪

রাজধানীর সড়কই নিরাপদ নয়

.

আজ মঙ্গলবার নিরাপদ সড়ক দিবস। এ বছর দিবসটির প্রতিপাদ্য হলো-‘ছাত্র জনতার অঙ্গীকার, নিরাপদ সড়ক হোক সবার।’ সারাদেশের সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা নিরাপদ করার জন্য প্রতি বছর ২২ অক্টোবর জাতীয়ভাবে পালন করা হয় এই দিবসটি। ২০১৭ সালে মন্ত্রিসভার বৈঠকে জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস হিসেবে পালনের সিদ্ধান্ত গ্রহণ ও অনুমোদন করা হয়। গত সাত বছর যাবত জাতীয়ভাবে এই দিবসটি পালন করা হয়। এর আগে বেসরকারি সংগঠন চিত্রনায়ক ইলিয়াস কাঞ্চনের নেতৃত্বে গঠিত ‘নিরাপদ সড়ক চাই’ (নিসচা) ১৯৯৩ সালে থেকে এই দিবসটি পালন করে আসছে।
দিবসটি এলে সরকারিভাবে বিভিন্ন কর্মসূচি গ্রহণ করে সড়ক ও মহাসড়ক বিভাগ। এ বছর জাতীয় নিরাপদ সড়ক দিবস উপলক্ষে কেন্দ্রীয়ভাবে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে এক আলোচনা সভার আয়োজন করা হয়েছে। অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন সড়ক পরিবহন ও সেতু মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান। বিশেষ অতিথি হিসেবে উপস্থিত থাকবেন যুব ও ক্রীড়া উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভূঁইয়া ও স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের সিনিয়র সচিব ড. মোহাম্মদ আবদুল মোমেন। পাশাপাশি বেসরকারিভাবে বিভিন্ন সংগঠন নানা কর্মসূচির মাধ্যমে পালন করবে নিরাপদ সড়ক দিবস।
কিন্তু সারাদেশে অনিরাপদ সড়কের কারণে ঘটছে দুর্ঘটনা। গত সাড়ে ৫ বছরে ২০১৯ সাল হতে ২০২৪ সালের জুন মাস পর্যন্ত ৩২ হাজার ৭৩৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ৩৫ হাজার ৩৮৪ জন নিহত হয়েছেন এবং ৫৩ হাজার ১৯৬ জন আহত হয়েছেন।  নিহতের মধ্যে নারী ৫১০৩ জন ও শিশু ৪৭৮৫ জন। এছাড়া ১১ হাজার ৬৬৯টি মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ১১,৫৯৩ জন। দুর্ঘটনায় ৮৩৫৮ জন পথচারী নিহত হয়েছেন। যানবাহনের চালক ও সহকারী নিহত হয়েছেন ৫২৬১ জন বলে জানিয়েছে বেসরকারি বিভিন্ন সংগঠন।
রাজধানীর সড়কই নিরাপদ নয়॥ খোদ রাজধানীর সড়কই নিরাপদ নয়। গত সাড়ে ৫ বছরে রাজধানীতে ১ হাজার ২২৩টি সড়ক দুর্ঘটনায় ১ হাজার ৬১ জন নিহত এবং ১ হাজার ৪৬৩ জন আহত হয়েছেন। বেশিরভাগ নিহত হয়েছেন পথচারী। ৪৫১ জন পথচারী সড়ক দুর্ঘটনায় নিহত হয়েছেন ঢাকায়। পাশাপাশি মোটরসাইকেল আরোহী নিহত হয়েছেন চারশ’ জনের অধিক। এছাড়া ১৯৭ জন বাস, ট্রাক, সিএনজি, রিক্সাসহ বিভিন্ন যানবাহনের চালক ও আরোহী নিহত হয়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংগঠন।
রাজধানীর সড়ক নিরাপদ না হওয়ার অন্যতম কারণ যানজট। পাশাপাশি মোটরসাইকেলসহ ছোট যানবাহনের সংখ্যা বৃদ্ধির কারণে নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে রাজধানীর ঢাকা। তাই ঢাকা মহানগরী সড়ক নিরাপদ করার জন্য মোটরসাইকেল ও প্রাইভেটকারসহ ছোট যানবাহন নিয়ন্ত্রণ করা এবং যানজট নিরসনে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি পদ্ধতি চালুর পরামর্শ বিশেষজ্ঞদের।
এ বিষয়ে গণপরিবহন বিশেষজ্ঞ ও বুয়েটের অধ্যাপক ড. সামছুল  হক জনকণ্ঠকে বলেন, ‘গণপরিবহন শৃঙ্খলা ও ঢাকার যানজটমুক্ত করতে হলে এখনই উপযুক্ত সময়। এজন্য ঢাকা থেকে মোটরসাইকেল ও ব্যক্তিগত গাড়িসহ ছোট গাড়ির সংখ্যা কমাতে হবে। আধুনিক বাসের ব্যবস্থা করতে হবে। যাতে সবাই এক সঙ্গে যাতায়াত করতে পারবে। এর ফলে জ¦ালানি খরচ ও সরকারি ব্যয়ও অনেক কমে আসবে। এজন্য বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি পদ্ধতি চালু ছাড়া অন্য কোনো বিকল্প নাই।’
বিগত সরকার আমলে তিনটি সেক্টরের বাধার কারণে এটা সম্ভব হয়নি উল্লেখ করে ড. সামছুল হক বলেন, ‘পুলিশ, সরকারি আমলা ও পরিবহন মালিক-শ্রমিকদের বাধার কারণে বাস রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি পদ্ধতি বাস্তবায়িত হচ্ছে না। কারণ ফুটপাত হকারমুক্ত হলে পুলিশের ইনকাম কমে যাবে, প্রাইভেটকার বা ব্যক্তিগত গাড়ির সংখ্যা কমার পক্ষে থাকে না সচিবরা, গণপরিবহনে শৃঙ্খলা বা রুট ফ্র্যাঞ্চাইজি পদ্ধতি হলে বাস মালিকদের সংখ্যা কমে যাবে। ইচ্ছে করলেই কেউ রাস্তায় গাড়ি নামাতে পারবে না। তাই বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের মাধ্যমে এখন যে সরকার ক্ষমতায় এসেছে তারাই পারবে গণপরিবহনে একটি মেরুদ- দিয়ে যেতে।’ তা না হলে কেউ ঢাকার গণপরিবহন ব্যবস্থা পরিবহন করতে পারবে না বলে জানান তিনি।
ঢাকার যানজটের ১০ কারণ ॥ রাজধানীর ঢাকায় যানজটের ১০ কারণ। এর মধ্যে প্রধান কারণ হলো ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা। যানজটের কারণগুলো হলো- ১. উল্টো পথে গাড়ি ও এক লেনে ধীরগতির রিক্সা চলাচল; ২. রাধানীর বিভিন্ন স্থানে ভাঙা-চোরা ও খানা-খন্দ সড়ক দ্রুত মেরামত না করা; ৩. ঢাকা প্রবেশ পথে এলোমেলো গাড়ি চলাচল; ৪. ফুটপাত ও রাস্তা দখল করে দোকানপাট; ৫. সড়ক দখল করে অবৈধ গাড়ি পার্কিং; ৬. মূল সড়কে যত্রতত্র যাত্রী ওঠা-নামা; ৭. রাজধানীর সড়কে বৈধ-অবৈধ রেলক্রসিং; ৮. সড়ক দখল করে মিছিল, মিটিং ও সমাবেশ; ৯. ভিআইপি চলাচলের সময় যানবাহন বন্ধ রাখা; ১০. ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা।
চারপাশে নদী দ্বারা বেষ্টিত ঢাকা শহরকে প্রথম রাজধানী করা হয় ১৬১০ সালে। চারশত বছরের আগের শহর ঢাকা দিনদিন তার ঐতিহ্য হারিয়ে যাচ্ছে। বসবাসের অযোগ্য হয়ে পড়ছে। অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও ট্রাফিক অবস্থাপনার কারণে যোগ্যতা হারাচ্ছে মেগা সিটি এই ঢাকা। এই দশটি কারণের মূল কারণ ট্রাফিক অব্যবস্থাপনা। ঢাকায় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ঠিক না থাকায় বাকি নয়টি সমস্যা তৈরি হচ্ছে। তাই এই দশটি কারণ সমাধান না করে যত মেগা প্রকল্প বাস্তবায়ন হোক না কেন, ঢাকা যানজট নিরসন করা সম্ভব নয় বলে জানিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা।
এ বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান জনকণ্ঠকে বলেন, ‘রাজধানীতে যানবাহনের তুলনায় অপ্রতুল সড়ক, একই সড়কে যান্ত্রিক-অযান্ত্রিক, স্বল্প ও দ্রুতগতির যানবাহনের চলাচল, ফুটপাত হকারের দখলে থাকা, ফুটওভার ব্রিজ যথাস্থানে নির্মাণ না হওয়া ও ব্যবহার উপযোগী না থাকা এবং সড়ক ব্যবহারকারীদের মধ্যে অসচেতনতার কারণে অতিমাত্রায় দুর্ঘটনা ও প্রাণহানি ঘটছে। তাই অনিরাপদ হয়ে পড়ছে ঢাকা মহানগরীর সড়ক। রাজধানীতে দুর্ঘটনাসমূহ রাতে এবং সকালে বেশি ঘটেছে। বাইপাস রোড না থাকার কারণে রাত ১০টা থেকে ভোর পর্যন্ত রাজধানীতে মালবাহী ভারি যানবাহন বেপরোয়া গতিতে চলাচল করে। ফলে রাস্তা পারাপারে পথচারীরা বেশি নিহত হচ্ছেন। এছাড়া দীর্ঘ সময় যানজটের কারণে যানবাহন চালকদের আচরণে অসহিষ্ণুতা ও ধৈযহানি ঘটছে, যা সড়ক দুর্ঘটনার কারণ হিসেবে কাজ করছে।’ তাই ঢাকায় ট্রাফিক ব্যবস্থাপনা ঠিক না থাকায় এই সমস্যা তৈরি হচ্ছে বলে জানান তিনি।   
বাড়ছে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ॥ গত সাড়ে ৫ বছরে মোটরসাইকেল দুর্ঘটনা ঘটেছে ১১,৬৬৯টি, নিহত হয়েছেন ১১,৫৯৩ জন এবং আহত ১০১১৪ জন। নিহতদের মধ্যে বেশিরভাগের বয়স ১৪ থেকে ৪৫ বছর। দেশে মোট মোটরযানের ৭১ শতাংশ মোটরসাইকেল। মোটরসাইকেল চালকদের বিরাট অংশ কিশোর ও যুবক। এদের মধ্যে ট্রাফিক আইন না জানা এবং না মানার প্রবণতা প্রবল। কিশোর-যুবকরা বেপরোয়া মোটরসাইকেল চালিয়ে দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হচ্ছে। সড়কে মোটরসাইকেল সবচেয়ে বেশি দুর্ঘটনার শিকার হয় ভারি যানবাহনের ধাক্কায় ও নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে।
গত সাড়ে ৫ বছরে অন্য যানবাহনের সঙ্গে মোটরসাইকেলের মুখোমুখি সংঘর্ষ ঘটেছে ২২ দশমিক ০৭ শতাংশ, মোটরসাইকেল নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে দুর্ঘটনা ঘটেছে ৩৫ দশমিক ৪৬ শতাংশ এবং ভারি যানবাহনের ধাক্কায় ৪০ দশমিক ৩৯ শতাংশ মোটরসাইকেল দুর্ঘটনায় আক্রান্ত হয়েছে বলে জানিয়েছে বেসরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।
এ বিষয়ে রোড সেফটি ফাউন্ডেশনের নির্বাহী পরিচালক সাইদুর রহমান জানান, মোটরসাইকেল দুর্ঘটনার একটি ব্যাপক অংশ ঘটছে ট্রাক, কাভার্ডভ্যান, পিকআপ ও বাসের ধাক্কা, চাপা এবং মুখোমুখি সংঘর্ষে। এসব দ্রুত গতির যানবাহন চালকদের অধিকাংশই অসুস্থ ও অদক্ষ। এদের বেপরোয়াভাবে যানবাহন চালানোর কারণে যারা সতর্কভাবে মোটরসাইকেল চালান তারাও দুর্ঘটনার শিকার হচ্ছেন। মোটরসাইকেল ৪ চাকার যানবাহনের তুলনায় ৩০ গুণ বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। কিন্তু দেশে গণপরিবহন ব্যবস্থা উন্নত ও সহজলভ্য না হওয়া এবং যানজটের কারণে মানুষ মোটরসাইকেল ব্যবহারে উৎসাহিত হচ্ছে এবং দুর্ঘটনা বাড়ছে।
সড়কে বাড়ছে পথচারী নিহতের সংখ্যা ॥ সাড়ে ৫ বছরে ৮৬৩১টি দুর্ঘটনায় ৮৩৫৮ জন পথচারী নিহত হয়েছে, যা মোট নিহতের ২৩ দশমিক ৬২ শতাংশ। এর মধ্যে দুর্ঘটনা ঘটেছে যানবাহনের বেপরোয়া গতির কারণে এবং ৪৩ শতাংশ দুর্ঘটনা ঘটেছে পথচারীদের অসতর্কতার কারণে। পথচারী নিহত হয়েছে মহাসড়কে ২২১৩ জন, আঞ্চলিক সড়কে ২৯৩৭ জন, গ্রামীণ সড়কে ১৬৭৪ জন, শহরের সড়কে ১৪৮৫ জন এবং অন্যান্য স্থানে ৪৯ জন।
যানবাহনের অতিরিক্ত গতি, সড়কের সাইন-মার্কিং-জেব্রা ক্রসিং সম্পর্কে চালক এবং পথচারীদের অজ্ঞতা ও না মানার প্রবণতা, যথাস্থানে সঠিকভাবে ফুটওভার ব্রিজ নির্মাণ না করা এবং ব্যবহার উপযোগী না থাকা, রাস্তায় হাঁটা ও পারাপারের সময় মোবাইল ফোনে কথা বলা, হেডফোনে গান শোনা, চ্যাটিং করা এবং সড়ক ঘেঁষে বসতবাড়ি নির্মাণ ও সড়কের উপরে হাট-বাজার গড়ে ওঠা ইত্যাদি কারণে পথচারী নিহতের ঘটনা বাড়ছে বলে জানিয়েছে সরকারি সংগঠন রোড সেফটি ফাউন্ডেশন।


    

 

×