.
নারীরা যেসব ক্যান্সারে আক্রান্ত হন তার মধ্যে অন্যতম মরণঘাতী জরায়ুমুখ ক্যান্সার। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার ২০২২ সালের তথ্য-উপাত্ত অনুযায়ী প্রতি বছর বিশ্বের প্রায় ৬ লাখ ৬০ জন জরায়ুর মুখ ক্যান্সারে আক্রান্ত হন। যার মধ্যে প্রায় ৩ লাখ ৫০ হাজার মারা যান। আর দেশে এই ক্যান্সারে বছরে আক্রান্ত হন ৮ হাজার ২ জন এবং তার মধ্যে মৃত্যু হয় ৪ হাজার ৯ জনের মতো। দেশে ১৫ থেকে ৪৪ বছর বয়সী নারীদের ক্যান্সারজনিত মৃত্যুর ক্ষেত্রে জরায়ুমুখ ক্যান্সার দ্বিতীয় সর্বোচ্চ। ক্ষতিকর হিউম্যান প্যাপিলোমা ভাইরাস (এইচপিভি)’র সংক্রমণ থেকে বাঁচাতে পারে একমাত্র একটি টিকার দুই ডোজ। কারভিক্স নামের টিকাটি তাই দেশের সব অঞ্চলের ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী মেয়েদের দিতে ব্যাপক পরিকল্পনা গ্রহণ করেছে সরকার। বৃহস্পতিবার থেকে ঢাকা ছাড়া দেশের ৭টি বিভাগে একযোগে শুরু হতে যাচ্ছে এই ক্যাম্পেন। এই টিকার আওতায় সব কিশোরীকে নিয়ে আসতে পারলে একটা সময় দেশ জরায়ুমুখ ক্যান্সারমুক্ত দেশ হিসেবে পরিচিতি লাভ করতে পারবে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞরা।
দেশে জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধে কাজ করা পাবলিক হেলথ স্পেশালিস্ট ডা. সামিয়া মাহমুদ বলেন, এইচপিভি একটি যৌনবাহিত ভাইরাস। এটি জননাঙ্গে আঁচিল (ওয়ার্টস) ও জরায়ুমুখ ক্যান্সার সৃষ্টি করে থাকে। এখন পর্যন্ত শনাক্ত হওয়া শতাধিক ধরনের এইচপিভি ভাইরাসের প্রায় ১৩টি সেরোটাইপ ক্যান্সার সৃষ্টি করে থাকে। তার মধ্যে ১৬ এবং ১৮ সেরোটাইপ খুবই মারাত্মক। যা ৭০ শতাংশ জরায়ুমুখ ক্যান্সারের জন্য দায়ী। শতকরা ৯৯ ভাগ জরায়ুমুখ ক্যান্সার এই এইচপিভি ভাইরাস দ্বারা হয়। তারা বলছেন, অনিরাপদ শারীরিক মিলনের মাধ্যমে এই ভাইরাস ছড়িয়ে থাকে। বেশিরভাগ ক্ষেত্রে এইচপিভি ভাইরাস সংক্রমণের লক্ষণ সঙ্গে সঙ্গে বোঝা যায় না।
সাধারণত এই ভাইরাস দ্বারা সংক্রমিত হওয়া থেকে জরায়ুমুখ ক্যান্সারের লক্ষণ প্রকাশ পেতে ১৫-২০ বছর সময় লাগে। তবে স্বল্প রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন নারীদের ক্ষেত্রে ক্যান্সারে রূপ নিতে সময় লাগে মাত্র ৫ থেকে ১০ বছর। আক্রান্ত ব্যক্তির রক্ত এবং দেহরসে এই ভাইরাস পাওয়া যায়। এই রোগকে নীরব ঘাতকও বলা হয়। আক্রান্ত রোগীদের অধিকাংশই প্রায় শেষ পর্যায়ে শনাক্ত হয়। যখন রোগ থেকে সেরে ওঠা খুবই কষ্টসাধ্য হয়ে যায়। বিশেষজ্ঞরা জানান, এটি প্রতিরোধে বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো কিশোরীদের নির্দিষ্ট বয়সে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার সুপারিশ অনুযায়ী দেশের জাতীয় টিকাদান কর্মসূচি সমন্বয়কারী ন্যাশনাল ইমুনাইজেশন টেকনিক্যাল অ্যাডভাইজরি গ্রুপ অব এক্সপার্টস (এনআইটিএজি)’র সিদ্ধান্ত অনুসারে ১ ডোজ এইচপিভি টিকায় এই ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব।
আর তাই ২০২৩ সালে ঢাকা বিভাগের প্রায় ১৫ লাখ কিশোরীকে এই টিকার ১ ডোজ দেওয়া হয়। এরই ধারাবাহিকতায় বৃহস্পতিবার দেশের অন্য ৭ বিভাগে শুরু হতে যাচ্ছে এ কর্মসূচি। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের আওতায় সম্প্রসারিত টিকাদান কর্মসূচি (ইপিআই)’র ডেপুটি ডিরেক্টর শাহরিয়ার সাজ্জাদ সোমবার এক অনুষ্ঠানে জানান, প্রায় ৬২ লাখ ১২ হাজার ৫৩২ জন কিশোরীকে এ টিকার আওতায় নিয়ে আসতে মোট ১৮ দিনের ক্যাম্পেইন পরিচালিত হবে। এর মধ্যে প্রথম ১০ দিন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ও ইপিআই কেন্দ্রগুলোতে টিকাদান কার্যক্রম চলবে। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণির ছাত্রীরা টিকা পাবে। কেউ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে টিকা নিতে অসমর্থ হলে তারা স্থায়ী কেন্দ্রে টিকা নিতে পারবেন। এ ছাড়া স্থায়ী কেন্দ্রে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বহির্ভূত ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীরাও টিকা গ্রহণ করতে পারবেন। পরবর্তী ৮ দিন নিয়মিত ইপিআই স্থায়ী ও অস্থায়ী টিকাদান কেন্দ্রের মাধ্যমে কমিউনিটির ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বহির্ভূত কিশোরীদের টিকা দেওয়া হবে। তবে এক্ষেত্রে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বাদ পড়া পঞ্চম থেকে নবম শ্রেণির ছাত্রীরাও টিকা নিতে পারবেন। এর জন্য www.vaxepi.gov.bd সাইটে ১৭ সংখ্যার জন্ম নিবন্ধনের তথ্য দিয়ে রেজিস্ট্রেশন করতে হবে।
ইপিআইয়ের তথ্যমতে, ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীদের ১ ডোজ এইচপিভি টিকা গ্রহণের মাধ্যমেই জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধ সম্ভব। বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও জরায়ুমুখ ক্যান্সারে আক্রান্তের হার বেড়েই চলেছে। এর চিকিৎসাও ব্যয়বহুল। দক্ষিণ এশিয়ার দেশগুলোর মধ্যে বাংলাদেশে এই ক্যান্সারে সবচেয়ে বেশি নারী প্রাণ হারান। দেশে প্রতি এক লাখ নারীর মধ্যে ১১ জন আক্রান্ত হন এই ক্যান্সারে। মৃত্যু হয় প্রায় ৫ হাজার জনের।
জরায়ুমুখ ক্যান্সারের লক্ষণ ॥ প্রাণঘাতী এই ক্যান্সারের অন্যতম লক্ষণ অতিরিক্ত সাদাস্রাব হওয়া। অতিরিক্ত অথবা অনিয়মিত রক্তস্রাব, মাসিক পুরোপুরি বন্ধ হওয়ার পর পুনরায় রক্তপাত, দুর্গন্ধযুক্ত স্রাব, শারীরিক মিলনের পর রক্তপাত, কোমর/তলপেট/উরুতে ব্যথা।
কারা বেশি ঝুঁকিপূর্ণ ॥ যেসব নারীর বাল্যবিয়ে হয়েছে তারা এই রোগে আক্রান্ত হওয়ার ঝুঁকিতে থাকেন বেশি। এ ছাড়া ঘন ঘন সন্তান প্রসব, অনিরাপদ শারীরিক মিলন, একাধিক যৌনসঙ্গী, ধূমপায়ী, স্বল্প রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতাসম্পন্ন জনগোষ্ঠী যেমন এইডস রোগী, এবং যেসব নারী প্রজনন স্বাস্থ্য এবং পরিচ্ছন্নতা সম্পর্কে সচেতন না। এবং সমস্যার প্রাথমিক পর্যায়ে চিকিৎসকের অথবা স্বাস্থ্য কর্মীর পরামর্শ নেন না তাদের এই ক্যান্সার হওয়ার ঝুঁকি সবচেয়ে বেশি।
প্রতিরোধের উপায় ॥ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ১০ থেকে ১৪ বছর বয়সী কিশোরীদের ১ ডোজ এইচপিভি টিকা প্রদানের মাধ্যমে এই ক্যান্সার প্রতিরোধ করা সম্ভব। এ ছাড়া ৩০ বছরের বেশি বয়স হলেই নিয়মিত জরায়ুমুখ ক্যান্সার নিরূপণ পরীক্ষা করা ও সময়মতো উপযুক্ত চিকিৎসা প্রদান করা হলে এটি থেকে রক্ষা পাওয়া যায়। সবচেয়ে বড় কথা কিশোরীদের শারীরিক ও মানসিক বিকাশের জন্য নিয়মিত স্বাস্থ্যসেবা ও পরামর্শ এই রোগ প্রতিরোধে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখতে পারে।
টিকা পরবর্তী বিরূপ প্রতিক্রিয়া ॥ জরায়ুমুখ ক্যান্সার প্রতিরোধের জন্য এইচপিভি টিকা বিশ্বব্যাপী পরীক্ষিত, নিরাপদ ও কার্যকর। তারপরও কিছু ক্ষেত্রে টিকা পরবর্তী মৃদু বিরূপ প্রতিক্রিয়া যেমন টিকার স্থানে লালচে ভাব, ব্যথা বা ফুলে যাওয়া ইত্যাদি দেখা দিতে পারে। যা এমনিতেই ভালো হয়ে যায়। এ ধরনের কোনো সমস্যা হলে এলাকার স্বাস্থ্যকর্মীর সঙ্গে যোগাযোগ করবেন বা কিশোরীকে নিকটস্থ স্বাস্থ্য কেন্দ্রে অতিসত্বর নিয়ে যাবেন।