ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২০ অক্টোবর ২০২৪, ৪ কার্তিক ১৪৩১

নিষ্পত্তিতে কমিটি গঠন ক্যাবের

আরইবি-পবিস বিরোধে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্নের শঙ্কা

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২২:২৫, ১৯ অক্টোবর ২০২৪

আরইবি-পবিস বিরোধে বিদ্যুৎ সরবরাহে বিঘ্নের শঙ্কা

পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড

চাকরিচ্যুতদের পুনর্বহাল দাবি সমিতির, আলোচনায় সমাধান ॥ উপদেষ্টা

পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) অধীনে পরিচালিত হলেও এতদিন নিজেদের আয়েই চলছিল পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলো (পবিস)। কিন্তু এইভাবে আর চলতে চাচ্ছেন না এর কর্মীরা। সরাসরি আরইবির কর্মী হিসেবে নিয়োগ চান তারা। কিন্তু বিদ্যুৎ নীতিমালা অনুযায়ী আরইবি সেই প্রস্তাব মানতে সম্মত নয়। ফলে একই প্রতিষ্ঠানের মধ্যে তৈরি হয়েছে বিরোধ। এই বিরোধের জেরে গত কয়েকদিন দেশের বিভিন্ন স্থানে ব্ল্যাকআউটসহ নানা ধরনের কর্মসূচি পালন করেছেন পবিসের কর্মীরা। তাদের দাবি আরইবির কর্মকর্তাদের দুর্নীতি ঢাকতেই পল্লী বিদ্যুতের কর্মীদের বৈষ্যমের শিকার বানানো হয়েছে।

এদিকে অভিন্ন সার্ভিস কোড বাস্তবায়নের পাশাপাশি অনিয়মিতদের নিয়মিতকরণের দাবিতে আন্দোলনকারীদের অনেককেই চাকরিচ্যুতির নির্দেশনা দিয়েছে আরইবি। অনেকে গ্রেপ্তারও হয়েছেন। এমন পরিস্থিতিতে আরইবি এবং পবিসের মধ্যে তৈরি হওয়া বিরোধের কারণে বিদ্যুৎ সরবরাহে বাধা তৈরি হওয়ার আশঙ্কা করছেন সংশ্লিষ্টরা। যদিও প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয় থেকে সরাসরি বিষয়টি পর্যবেক্ষণ করা হচ্ছে। এছাড়া এই বিরোধ নিষ্পত্তিতে একটি কমিটি গঠন করেছে কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব)। 
বিদ্যুৎ বিভাগ সূত্রে জানা যায়, দেশের ৬৪ জেলায় বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের অধীনে ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি রয়েছে। এসব সমিতিতে কর্মরত রয়েছেন প্রায় ৪৫ হাজার কর্মকর্তা-কর্মচারী। দেশের ১৪ কোটি মানুষকে বিদ্যুৎ সরবরাহ করে। দেশের প্রায় ৮০শতাংশ গ্রাহক তাদের আওতায়। গত কিছুদিন যাবত তারা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির চেয়ারম্যানকে অপসারণসহ বেশকিছু দাবিতে সমিতির কর্মীরা আন্দোলন করে আসছিলেন। সেই আন্দোলনকারীদের কয়েকজনের বিরুদ্ধে মামলা এবং চাকরি থেকে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে।

এর প্রতিবাদে সাধারণ কর্মীরা বৃহস্পতিবার ৬১টি সমিতিতে ব্ল্যাক আউট করে। শুধু তাই নয় দাবি আদায় না হলে ঢাকামুখী লং মার্চেরও হুমকি দেন তারা। কিন্তু তাদের দাবি এখনই বাস্তবায়নে নারাজ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। তাদের প্রশ্রয় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন খোদ বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান। আলোচনার মাধ্যমেই সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলেছেন তিনি। 
এেিদক শনিবার এক সংবাদ সম্মেলনে আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে এক জরুরি সংবাদ সম্মেলনে, চাকরিচ্যুত ৩১ কর্মকর্তাকে চাকরিতে পুনর্বহালসহ আরইবির দুর্নীতিবাজ কর্মকর্তাদের আইনের আওতায় নিয়ে আসার দাবি জানানো হয়। 
এ সময় বলা হয়, দেশের পল্লী বিদ্যুতের সেবা মূলত পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড এবং পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি থেকে গ্রাহক পর্যায়ে পৌঁছায়। পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড থেকে সব লাইন নির্মাণ এবং মালামাল ক্রয় ও সরবরাহ করা হয়। আর পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি সবচেয়ে বড় কাজ লাইন রক্ষণাবেক্ষণ, নতুন সংযোগ দেওয়া এবং অভিযোগ সমাধান করে থাকে। কিন্তু অন্যান্য বিতরণ সংস্থার থেকে অতি নি¤œমানের মালামাল দিয়ে লাইন নির্মাণ এবং নি¤œমানের মিটার, ট্রান্সফরমার, তারসহ অন্যান্য যন্ত্রপাতি সরবরাহ করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। যার ফলে আকাশে মেঘ উঠলেই পল্লী বিদ্যুতের লাইন বন্ধ হয়ে যায়। ঝড় বাদলে খুঁটি ভেঙে দিনের পর দিন গ্রাহক বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন থাকে। ভুক্তভোগী হয় সাধারণ গ্রাহক এবং গ্রাহক পর্যায়ে থাকা পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। 
সংবাদ সম্মেলনে বলা হয়, পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের এই দুর্নীতির বিরুদ্ধে কথা বলায়, এই সিস্টেমের সংস্কার দাবি করায়, শহর এবং গ্রামের বিদ্যুৎ বৈষম্য নিরসনের দাবি তোলায় পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির কর্মকর্তা-কর্মচারীদের দেশদ্রোহী আখ্যা দিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করে হয়রানি করা হচ্ছে। রিমান্ডে নিয়ে নির্যাতন করা হচ্ছে। এই অবস্থা চলতে থাকলে  গ্রেপ্তার আতঙ্কে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির সবাই নিরাপত্তার জন্য স্টেশন ত্যাগ করলে তখন বিদ্যুৎ বিপর্যয় ঘটলে এর দায় কে নেবে? 
তারা আরও অভিযোগ করেন, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বোর্ডের চেয়ারম্যান বরাবর শুধুমাত্র স্মারকলিপি পাঠানোর জন্য দুইজন এজিএমকে সাসপেন্ড, এবং কয়েকজনকে স্ট্যান্ড রিলিজ করে পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড। অথচ যশোর-১ এর জিএম ইসাহাক আলীর বিরুদ্ধে দুর্নীতি, নারী কর্মীদের হেনস্তা ও যৌন নিপীড়নের লিখিত অভিযোগ দেয়া সত্ত্বেও তার বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা না নিয়ে ‘প্রাইজ পোস্টিং’ প্রদান করা হয়। গত মে মাসে গ্রাহক সেবা ও বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু রেখে পল্লী বিদ্যুৎ সমিতি ৫ দিন কর্মবিরতি পালন করে।

জুলাই মাসেও গ্রাহক সেবা ও বিদ্যুৎ সরবরাহ চালু রেখে ১০ দিন কর্মবিরতি পালন করে। বিদ্যুৎ বিভাগ থেকে সংস্কার কমিটি গঠন করা হলেও  বোর্ড সেখানে জানায় তারা সংস্কার চায় না। এমন পরিস্থিতিতে হঠাৎ করেই কোনোরকম পূর্ব নোটিস ছাড়াই গত ১৭ অক্টোবর ২৪ কর্মকর্তা-কর্মচারীকে স্থায়ী বরখাস্ত করা হয় এবং ১৮ জনকে মিথ্যা মামলা দিয়ে গ্রেপ্তার করা হয়। যে কারণে তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়ায় কিছু কিছু জায়গায় বিদ্যুৎ সেবা বিঘিœত হয়।
কিন্তু এই বিরোধ নিষ্পত্তি না হলে বিদ্যুৎ সেবা আরও বিঘিœত হওয়ার আশঙ্কা করছেন বিদ্যুৎ ও জ্বালানি খাত সংশ্লিষ্টরা। কনজ্যুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) এর জ্বালানি উপদেষ্টা অধ্যাপক শামসুল আলম জনকণ্ঠকে বলেন, বিদ্যুৎ জরুরি সেবার অন্তর্ভুক্ত। তাই এই খাতটিকে সব ধরনের রাজনীতির ঊর্ধ্বে রাখতে হবে। কারও কোনো দাবি-দাওয়া থাকলে তা আলোচনার মাধ্যমে সমাধান করতে হবে। ভোক্তাদের জিম্মি করে কোনো আন্দোলনই গ্রহণযোগ্য নয়। 
এই বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে একটি কমিটিও গঠন করা হয়েছে ক্যাবের পক্ষ থেকে। শনিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে ক্যাব থেকে জানানো হয়, বাংলাদেশ পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ড (বিআরইবি) ও পল্লী বিদ্যুৎ সমিতিগুলোর (পবিস) মধ্যে বিরাজমান বিরোধের কারণে বিদ্যুৎ ব্যবস্থা ঝুঁকির মধ্যে আছে। পবিসের আন্দোলনরত কর্মকর্তা-কর্মচারীরা গত ১৭ অক্টোবর ৮০টি পল্লী বিদ্যুৎ সমিতির মধ্যে ৬১টি সমিতির বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ করে দেয়। ফলে পল্লী বিদ্যুতের আওতাধীন ভোক্তারা চরম ভোগান্তিতে পড়েন। যেকোনো সময় দেশের বিপুলসংখ্যক বিদ্যুৎ ভোক্তা এর থেকেও চরম বিপর্যস্ত অবস্থার শিকার হতে পারেন বলে জনমনে আশঙ্কা দেখা দিয়েছে। 
এই বিবেচনায় উক্ত বিরোধ নিষ্পত্তির লক্ষ্যে কনজুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (ক্যাব) একটি নাগরিক কমিটি গঠন করেছে।
কমিটিতে রয়েছেন ভোক্তা অভিযোগ নিষ্পত্তি জাতীয় কমিটির সভাপতি এম শামসুল আলম, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক বদরুল ইমাম, ঢাবি অধ্যাপক এম এম আকাশ, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক শরমিন্দ নিলোর্মি ও ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া। এই কমিটি ১০ কার্য দিবসের মধ্যে প্রতিবেদন দাখিল করবে এবং কারণ চিহ্নিত করে বিরোধ নিষ্পত্তির জন্য সুনির্দিষ্ট সুপারিশ প্রকাশ করবে।
এদিকে আন্দোলন করে কোনো সমাধান পাওয়া যাবে না হুঁশিয়ারি দিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খানও। জনকণ্ঠকে তিনি, আন্দোলন করে কেউ দাবি আদায় করতে পারবে না। বিদ্যুৎ একটি জরুরি সেবা। এই সেবা বন্ধ রেখে কোনোভাবেই আন্দোলন গ্রহণযোগ্য নয়। যেসব এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে দ্রুততম সময়ের মধ্যে পুনরায় সংযোগ দেওয়ার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। কেউ নির্দেশনা না মানলে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীকে ব্যবস্থা নেওয়ার কথাও বলা হয়েছে।

×