ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ১৯ অক্টোবর ২০২৪, ৩ কার্তিক ১৪৩১

১৮৪ জনের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা ॥ ২৭ জন গ্রেপ্তার

অনুপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে

শংকর কুমার দে

প্রকাশিত: ২২:৫৫, ১৮ অক্টোবর ২০২৪

অনুপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে

অনুপস্থিত পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে গুলি করে হত্যার অভিযোগে হত্যা মামলা দায়ের করা হয়েছে পুলিশ বাহিনীর সাবেক তিন আইজিপিসহ ১৮৪ পুলিশ কর্মকর্তার বিরুদ্ধে। এর মধ্যে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) কর্মকর্তা ৯৯ জন। পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের ১৮৭ পুলিশ সদস্যসহ দাপুটে দোর্দ- প্রতাপশালী এক ডজন পুলিশ কর্মকর্তার হদিস মিলছে না। এর মধ্যে আছেন, মনির, হাবিব, হারুন, বিপ্লব, প্রলয়ের মতো দোর্দ- প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তা।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের নির্দেশনা অনুযায়ী তারা কর্মস্থলে যোগদান না করে অনুপস্থিত থাকার পর তাদের কাজে যোগদানে নিষেধাজ্ঞাসহ আইনানুগ ব্যবস্থা গ্রহণ করা হচ্ছে। এ পর্যন্ত পুলিশ বাহিনীর সাবেক তিন আইজিপিসহ ২৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। তবে দাপুটে পুলিশ কর্মকর্তা জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনে নির্বিচারে গুলি চালানোর অভিযোগ আনা হয়েছে দায়ী পুলিশ কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে এ খবর জানা গেছে।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, বাংলাদেশের একমাত্র আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী সংস্থা বাংলাদেশ পুলিশ বাহিনী বিগত সরকারের পেটোয়া বাহিনীতে পরিণত হয়ে পেশাদারিত্ব হারিয়ে জুলাই-আগস্টে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গুলি চালিয়ে হতাহত করে বিক্ষোভের মুখে পড়েছে। বাংলাদেশের পুলিশ বাহিনীকে রাজনৈতিক প্রভাবমুক্ত করে পেশাদারিত্ব ফিরিয়ে এনে জনগণের বন্ধু হিসাবে জনবান্ধব বাহিনী গড়ে তোলার জন্য পুলিশ বাহিনীর সংস্কার করার জন্য কমিটি গঠিত হয়েছে।

পুলিশ বাহিনী রাষ্ট্রের এক অপরিহার্য বাহিনী যা রাষ্ট্র পুলিশ বাহিনী ছাড়া চলতে পারে না। পুলিশ বাহিনীর বর্তমান যে অবস্থা, তার জন্য তার জন্য একদিকে বিগত আওয়ামী লীগ সরকার যেমন দায়ী তেমনি পুলিশ বাহিনীর মুষ্টিমেয় উচ্চাভিলাসী কর্মকর্তাও দায়ি। বিগত আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতা কুক্ষিগত করার জন্য পুলিশকে ব্যবহার করেছে আর পুলিশও তার পেশাদারত্বের বাইরে গিয়ে ব্যবহৃত হয়ে বিনিময়ে নানা সুবিধাও বাগিয়ে নিয়েছে। বিগত সরকারের আমলে পুলিশের অনেকেই বিশাল সম্পদের মালিক হয়েছে। এ কারণেই পুলিশ বাহিনীর সদস্যদের বিরুদ্ধে হত্যা মামলা দায়ের করাসহ বিভিন্ন অভিযোগে অনেক দাপুটে সুবিধাভোগী পুলিশ কর্মকর্তা পালিয়ে গেছেন।
স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও পুলিশ সদর দপ্তরের সূত্র বলেছে, পুলিশের সাবেক অন্তত ২৬ ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাকে গ্রেপ্তারের অনুমতি নিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। তাদের মধ্যে পুলিশের মহাপরিদর্শক (আইজিপি) থেকে শুরু করে পরিদর্শক পদের কর্মকর্তারা রয়েছেন। তাদের বেশিরভাগই ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে প্রভাবশালী কর্মকর্তা হিসেবে পরিচিত ছিলেন। পুলিশ সদর দপ্তরের কনফিডেনশিয়াল শাখা থেকে সাবেক-বর্তমান এই ২৬ জনকে গ্রেপ্তারের জন্য মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগের পুলিশ শাখা-১ থেকে তিন ধাপে অনুমতি নেওয়া হয়েছে।

অনুমতি চেয়ে করা আবেদনে গ্রেপ্তারের কারণও ব্যাখ্যা করা হয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার নেতৃত্বাধীন আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর পুলিশের সাবেক-বর্তমান এই ২৬ কর্মকর্তার বিরুদ্ধেই হত্যার অভিযোগে মামলা হয়েছে। ছাত্র-জনতার ওপর নির্বিচার গুলি চালিয়েছেন অথবা তার নির্দেশ দেওয়ার জন্য অভিযুক্ত। তাদের মধ্যে সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল-মামুনসহ সাতজন ইতিমধ্যে  গ্রেপ্তারও হয়েছেন।

বাকি কর্মকর্তারা আত্মগোপনে রয়েছেন।  কেউ কেউ বিদেশে চলে গেছেন বলেও শোনা যাচ্ছে। বিভিন্ন মামলায় আসামি হিসেবে নাম থাকা বিগত সময়ের প্রভাবশালী পুলিশ কর্মকর্তাদের গ্রেপ্তারের সিদ্ধান্ত রয়েছে। খুঁজে না পাওয়ায় অনেককে গ্রেপ্তার করা যাচ্ছে না। 
গোয়েন্দা সংস্থার প্রতিবেদন ও পুলিশের দেওয়া তথ্য মতে, পতিত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ে অত্যন্ত দাপুটে ও প্রভাবশালী অন্তত এক ডজন পুলিশ কর্মকর্তা ভারতে পালিয়ে গেছেন নয় তো দেশের ভেতরে আত্মগোপন করে আছেন। অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার প্রলয় কুমার জোয়ারদার ও পুলিশের বিশেষ শাখার সাবেক প্রধান মনিরুল ইসলামসহ আরও অন্তত চারজনসহ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা রংপুরের লালমনিরহাট সীমান্ত দিয়ে দেশত্যাগ করেছেন বলে তথ্য মিলেছে।

ট্যুরিস্ট পুলিশের সাবেক প্রধান অতিরিক্ত পুলিশ মহাপরিদর্শক রেজাউল আলমের দেশত্যাগ সম্পর্কে নিশ্চিতভাবে জানা গেছে। গত ১৮ সেপ্টেম্বর ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর দিয়ে রাত সাড়ে ১০টার দিকে মালয়েশিয়াগামী এমএইচ-ওয়ান-জিরো-থ্রি ফ্লাইটে সিডনির উদ্দেশে ঢাকা ছাড়েন তিনি। তিনি ৫ আগস্টের পর হওয়া একটি হত্যা মামলায় অভিযুক্ত। 
ডিএমপির সাবেক কমিশনার হাবিবুর রহমানও এর মধ্যে দেশের পূর্বাঞ্চলের একটি সীমান্ত দিয়ে ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। কেন্দ্রীয় যুবলীগের একজন নেতা তাকে ভারতের একটি হোটেলে দেখেছেন বলে গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন। আগস্টের মাঝামাঝিতে দেশের পূর্বাঞ্চলের আরেকটি জেলার সীমান্ত দিয়ে দেশ ছাড়েন ঢাকা মহানগর পুলিশের কাউন্টার টেররিজম অ্যান্ড ট্রান্সন্যাশনাল ক্রাইম (সিটিটিসি) ইউনিটের অতিরিক্ত কমিশনার মো. আসাদুজ্জামান।

সেপ্টেম্বরের মাঝামাঝি সময়ে দেশ ছাড়েন ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার ও সাবেক ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদ ও বিপ্লব কুমার সরকার। তারা ভারতে আশ্রয় নিয়েছেন। কাজে যোগ দেননি ডিএমপির সাবেক যুগ্ম কমিশনার মেহেদী হাসান ও লিটন কুমার দাস। তাদের অবস্থান সম্পর্কে কোনো সূত্র নির্ভরযোগ্য খবর জানাতে পারেনি।
পুলিশ সদর দপ্তরের তথ্য মতে, পুলিশের বিভিন্ন পর্যায়ের বেশ কয়েকজন কর্মকর্তা এখনো কর্মস্থলে অনুপস্থিত রয়েছেন এমন সদস্যের সংখ্যা ১৮৭ জন। অনুপস্থিত কর্মকর্তাদের মধ্যে রয়েছেন অতিরিক্ত ডিআইজি ও ডিআইজি পদমর্যাদার কয়েকজন কর্মকর্তা। যারা দেশত্যাগ করেছেন বলে শোনা যাচ্ছে।  গত ৫ আগস্টে আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর পুলিশ বাহিনী কার্যত অচল হয়ে গেলে সীমান্ত রক্ষী বাহিনীগুলোর আকস্মিক কিংকর্তব্য বিমূঢ় হয়ে পড়ায় পুলিশ কর্মকর্তারা পালিয়ে যেতে সুযোগ পান। 
পুলিশ মহাপরিদর্শক (আইজিপি) মো. ময়নুল ইসলাম গণমাধ্যমে বলেছেন, পুলিশের যেসব সদস্য এখনো কাজে যোগ দেননি তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়েছে। তিনি বলেছেন, যারা বিভিন্ন মামলায় আসামি হয়েছেন, যেসব সদস্যের মধ্যে যাদের সম্পৃক্ততা পেয়েছি এমন ১৭ জনকে গ্রেপ্তার করা হয়েছে। যারা গরহাজির সদস্য তাদের বিরুদ্ধে ইতোমধ্যে ডিপার্টমেন্টের যে অ্যাকশন, তাদের কাছে জানতে চাওয়া হয়েছে, তারা কেন গরহাজির? তাদের হাজিরের জন্য নোটিস করা হয়েছে।

তারা যদি না আসে আমাদের ব্যবস্থা ক্লিয়ার, তাদের চাকরিতে রাখার কোনো সুযোগ নেই। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে যে বিপ্লব সংঘটিত হয়েছে, তারপর যারা আন্দোলনে অতিরিক্ত (দমন-নিপীড়ন) করেছে তারা কিন্তু নেই। এই সংখ্যাটা নিতান্তই অল্প। আমরা ইউনিট অনুযায়ী স্টপ করে রেখেছি, এই সংখ্যাটা মাত্র ১৮৭ জন, যা দুই লক্ষাধিক পুলিশ বাহিনীর সদস্যের মধ্যে নিত্যন্তই কম। 
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নির্বিচারে গুলি ও অতিরিক্ত বল প্রয়োগ করে জনবিক্ষোভের মুখে পড়েছে পুলিশ বাহিনী। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর জনরোষ এতটাই ভয়ংকর হয় রাজধানীসহ দেশের বিভিন্ন এলাকার থানা, ফাঁড়িসহ পুলিশের স্থাপনা জ্বালিয়ে দেওয়া হয়। এর বাইরে ভাঙচুর করা হয় আরও পুলিশ স্থাপনা। বেশ কিছু থানা পরিণত হয় ধ্বংসস্তূপে।

পুলিশ বাহিনীর ভেঙে যাওয়া মনোবল চাঙ্গা করে মাঠে ফিরিয়ে আনার চেষ্টা করা হচ্ছে। এ পরিস্থিতিতে পুলিশ বাহিনীর খোলনলচে বদলে দেওয়ার প্রক্রিয়া শুরু অব্যাহত আছে। বিগত আওয়ামী লীগ সরকারের ১৫ বছরের দুর্নাম ঘুচিয়ে পুলিশ জনআস্থা অর্জন করার লক্ষ্যে পুলিশ বাহিনী সংস্কারে কমিশন গঠন করেছে অন্তর্র্বর্তী সরকার। 
পুলিশ সদর দপ্তরের মিডিয়া অ্যান্ড পাবলিক রিলেশন্স বিভাগের এআইজি ইনামুল হক সাগর বলেছেন, যাদের বিরুদ্ধে মামলা হয়েছে, তাদের অবস্থান জানতে আমরা চেষ্টা চালাচ্ছি। যে ১৮৭ জন পুলিশ সদস্য বিভিন্ন কারণে এখনো অনুপস্থিত তাদের বিরুদ্ধে এরই মধ্যে ব্যবস্থা নেওয়া শুরু হয়ে গেছে।

×