ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৮ অক্টোবর ২০২৪, ২ কার্তিক ১৪৩১

সাক্ষাৎকারে উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান

দরপত্র ছাড়া বিদ্যুৎ-জ্বালানির কাজ পাবে না কেউ

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২২:১১, ১৭ অক্টোবর ২০২৪

দরপত্র ছাড়া বিদ্যুৎ-জ্বালানির কাজ পাবে না কেউ

উপদেষ্টা ফাওজুল কবির খান

ক্রমবর্ধমান শিল্পায়নের সঙ্গে দেশে প্রতিদিনই বাড়ছে জ্বালানির চাহিদা। গ্যাস, বিদ্যুতের ঊর্ধ্বমুখী চাহিদার জোগান দিতে নানামুখী পদক্ষেপ নিয়েছে অন্তবর্তী সরকার। এর মধ্যে অন্যতম দেশজুড়ে নতুন কূপ খনন প্রকল্প। একইসঙ্গে সাগরে তেল, গ্যাস অনুসন্ধানের প্রক্রিয়াও চলছে জোর কদমে। এখন পর্যন্ত বিশ্বসেরা ৭টি কোম্পানি দরপত্র জমা দিয়েছে অনুসন্ধান কার্যক্রম পরিচালনার জন্য।

শুধু তাই নয়, জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানি থেকে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্যও নেওয়া হয়েছে ব্যাপক পরিকল্পনা। তবে সবক্ষেত্রেই কাজ পেতে হলে প্রতিযোগিতা করতে হবে। প্রতিযোগিতামূলক দরপত্রের মাধ্যমেই বিদ্যুৎ ও জ্বালানির যেকোনো কাজ পাবে কোম্পানিগুলো। এক্ষেত্রে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না বলে জানিয়েছেন বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।

বুধবার জনকণ্ঠকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, সাম্প্রতিক সময়ে চাহিদা ক্রমবর্ধমান থাকায় এখনই আমদানি বন্ধ না করতে পারলেও দেশের অভ্যন্তরে থাকা কূপগুলো খনন ও অনুসন্ধানে ব্যপক পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। ২০২৫ সাল থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত সময়ে দেশে অন্তত : ১০০ টি কূপ অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভারের বড় পরিকল্পনা করেছি আমরা। এ ছাড়াও আগামী ৩ বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬৯টি কূপের অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে।

একইসঙ্গে ৩১টি কূপের ওয়ার্কওভার সম্পন্ন হবে। এর মধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন এন্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) দশটি, সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল) দুটি ও বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়িত করবে। এর বাইরেও বাপেক্সের নিজস্ব রিগ দিয়ে ২৮টি, বিজিএফসিএলের রিগ দিয়ে দুটি, এসজিএফএলের রিগ দিয়ে ৩টি মোট ৩৩টি কূপ খনন হবে।

আর বাপেক্সের মাধ্যমে রিগ ভাড়া করে ১০টি কূপে চলবে খনন কাজ। আর আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে বাপেক্স ১৪ টি, বিজিএফসিএল ৭টি, এসজিএফএল ৫টি কূপ খনন করবে। সব মিলিয়ে ৬৯টি কূপের খনন হবে। কূপগুলো ওয়ার্কওভার কার্যক্রমে বাপেক্সের রিগ দিয়ে হবে ১৬টি, বিজিএফসিএলের রিগ দিয়ে ১২ টি, এসজিএফএল দিয়ে ৩টিসহ মোট ৩১টি কূপের ওয়ার্কওভার হবে। 
এসব কাজ কোন প্রক্রিয়ায় কোম্পানীগুলো পাবে জানতে চাইলে তিনি বলেন, সব ক্ষেত্রে প্রতিযোগিতার মাধ্যমে কাজ দেওয়া হবে। এই সরকার কোনো নির্দিষ্ট ব্যক্তি বা গ্রুপকে প্রোমোট (সুবিধা দেওয়া) করবে না। এখন থেকে সবার জন্য প্রতিযোগিতা উন্মুক্ত থাকবে। এখন থেকে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা ছাড়া কোনো প্রকল্প গ্রহণ করা হবে না এবং টেন্ডার দেওয়া হবে না। এসব ক্ষেত্রে বিশেষজ্ঞ কমিটির পরামর্শ নেওয়া হবে। কোনো অনিয়ম করতে  দেওয়া হবে না।
কবে নাগাদ দরপত্র আহ্বান করা হতে পারে জানতে চাইলে তিনি বলেন, কাগজপত্র এখনো তৈরি হয়নি। এটি তৈরিতে যিনি আমাদের সহযোগিতা করছেন তিনি দেশের বাইরে গিয়েছেন। সাবেক সচিব ফারুক হোসেন কাজটি করছেন। তিনি দুই একদিনের মধ্যে চলে আসবে। তিনি এটি চূড়ান্ত করবেন। আশা করছি এই মাসের মধ্যেই এটির সব প্রক্রিয়া সম্পন্ন হবে। 
তিনি বলেন, স্থলভাগের পাশাপাশি জলভাগেও তেল গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রম আমরা এগিয়ে নিচ্ছি। এরই মধ্যে বিশ্বের অন্তত ৭টি দেশের বড় বড় কোম্পানি আমাদের কাছে আগ্রহ প্রকাশ করেছে। সব ঠিকঠাকভাবে চললে চলতি বছরের ডিসেম্বরের মধ্যেই শেষ হবে দরপত্র আবেদন গ্রহণের প্রক্রিয়া। এসব আবেদন মূল্যায়ন চলবে পুরো ২০২৫ সাল পর্যন্ত। ২০২৬ সালে চূড়ান্ত হতে পারে অনুসন্ধানকারী কোম্পানি।

বিশ্বের শীর্ষ পর্যায়ের ৫৫টি  কোম্পানিকে আমন্ত্রণ জানানো হয়েছিল দরপত্র জমাদানের জন্য। আমেরিকান কোম্পানি শেভরন বাংলাদেশ ও এক্সোন মবিল, জাপানি প্রতিষ্ঠানসহ অনেকগুলো কোম্পানি আগ্রহ দেখিয়েছে। ৭টি কোম্পানি থেকে দরপত্রের আবেদনপত্র কিনেছে। আরও কয়েকটি কোম্পানি এখনো আগ্রহ দেখাচ্ছে। তাই ডিসেম্বর পর্যন্ত সময় বাড়ানো হয়েছে।
শুধু তাই নয়, বর্তমান সরকার জীবাশ্ম জ্বালানি থেকে বেরিয়ে নবায়নযোগ্য জ্বালানির দিকেও গুরুত্বারোপ করবে জানিয়ে তিনি বলেন, জীবাশ্ম জ্বালানির প্রকল্পগুলোতে যে ট্যাক্স দিতে হয় তার থেকে নবায়নযোগ্য জ্বালানির জন্য কম ট্যাক্স নির্ধারনের জন্য আমরা আমরা জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিয়েছি। তার উত্তরের অপেক্ষা করছি।

আগের সব কাজের রি-টেন্ডার হয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, কাউকে বিশেষ সুবিধা দিতে নয় বরং প্রতিযোগিতামূলক বাজার তৈরি করাই আমাদের লক্ষ্য। আমাদের বিদ্যুতের মূল্য বেশি। এর জন্য আমাদের বেশি দাম আদায় করছে। কিন্তু প্রতিযোগিতা নিশ্চিত করতে পারলে গ্রাহকরা কম দামে বিদ্যুৎ পেতে পারে। 
দেশের প্রায় ৪০ টি জায়গায় বিভিন্ন জায়গায় নবায়নযোগ্য জ্বালানির প্রকল্প নেয়া হচ্ছে জানিয়ে উপদেষ্টা বলেন, এদের মধ্যে ৫০ মেগাওয়াট আছে, ১০০ মেগাওয়াট আছে, ২০০ মেগাওয়াট আছে, ৭০ মেগাওয়াট আছে। এগুলো সব বাস্তবায়ন করবে বেসরকারি খাত। এর বাইরেও আমরা একটা পরিকল্পনা করছি আমরা হয়তো জমি দিয়ে দেবো। জামালপুরে যেমন আমাদের একটা সোলার পার্ক করার ইচ্ছে আছে। এটাতেও দরপত্র হবে। যে সবচেয়ে কম দামে বিদ্যুৎ দিতে পারবে তাকে কাজ দেওয়া হবে।

দেশের সবচেয়ে বড় প্রকল্প হিসেবে বিবেচিত রুপপুর বিদ্যুৎ কেন্দ্র ডিসেম্বরে উৎপাদনে যাওয়ার জন্য প্রস্তুত হলেও এর সঞ্চালন লাইন তৈরিতে দেরি হওয়ায় এর সুফল পেতে দেরি হতে পারে বলে আশংকা করছেন সংশ্লিষ্টরা। বিশেষ করে এর ভারতীয় শ্রমিকরা এখনো কাজে ফিরে নি। এ বিষয়ে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজ সম্পদ উপদেষ্টার কাছে জানতে চাইলে তিনি বলেন, রুপপূর পারমণাবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের সঞ্চালন লাইন তৈরির কাজ সাতটি প্যাকেজের মাধ্যমে চলছে।

এর মধ্যে রূপপুর থেকে বাঘাবাড়ী পর্যন্ত ৬৫ দশমিক ৩১ কিলোমিটার ডাবল সার্কিট সঞ্চালন লাইন নির্মাণকাজের অগ্রগতি শতভাগ। আমিনবাজার থেকে কালিয়াকৈর পর্যন্ত ৫১ কিলোমিটার নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৯০ শতাংশের বেশি। রূপপুর থেকে ঢাকা (আমিনবাজার-কালিয়াকৈর) ১৪৭ কিলোমিটার নির্মাণকাজ হয়েছে শেষ হয়েছে প্রায় ৮০ শতাংশ। এ ছাড়া গোপালগঞ্জ পর্যন্ত ১৪৪ কিলোমিটারের অগ্রগতি ৭০ শতাংশের মতো, ধামরাই পর্যন্ত ১৪৫ কিলোমিটারের অগ্রগতি ৬০ শতাংশের কিছু বেশি, বগুড়া পর্যন্ত ১০২ কিলোমিটারের অগ্রগতি ৬০ শতাংশের মতো এবং ৯টি বে এক্সটেনশন নির্মাণকাজের অগ্রগতি ৩০ শতাংশের ওপরে।

সব মিলিয়ে স্থলভাগের প্রায় ৯৯ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। ভারতীয় দূতাবাসের সঙ্গে কথা হয়েছে। পূজার ছুটি শেষ হলেই সেই দেশের শ্রমিকরা কাজে যোগ দেবে বলে তারা আমাদের জানিয়েছেন। আশা করছি ফেব্রুয়ারি নাগাদ সঞ্চালন লাইন পুরোপুরি প্রস্তুত হয়ে যাবে। 
তিনি বলেন, পরিবর্তিত রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটেও দেশের জ্বালানি খাতের উন্নয়ন কার্যক্রম অব্যাহত রয়েছে। আমাদের উন্নয়ন কাজে কোনো হুমকি বা বাঁধা আমরা পাই নি বা পেলেও এগুলো আমলে নিচ্ছি না। উন্নয়নকাজ একইরকমভাবে চলবে।

×