ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

ভুল তথ্যে পদোন্নতি-পদায়ন ॥ প্রশাসনে ক্ষোভ, অস্থিরতা ॥ যোগ্য অনেক কর্মকর্তা পদোন্নতি পাননি

‘বঞ্চিত’ দুর্নীতিগ্রস্তরাও!

তপন বিশ্বাস

প্রকাশিত: ২২:৫৭, ১২ অক্টোবর ২০২৪

‘বঞ্চিত’ দুর্নীতিগ্রস্তরাও!

অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে প্রশাসনে সংস্কার

অন্তর্র্বর্তী সরকার দায়িত্ব নেওয়ার পর থেকেই শুরু হয়েছে প্রশাসনে সংস্কার। গুরুত্বপূর্ণ পদগুলোতে চলছে রদবদল। চাকরি থেকে অনেককে অব্যাহতি দেওয়া হয়েছে। অনেককেই করা হয়েছে বিশেষ ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওএসডি)। একইসঙ্গে বিগত সরকারের সময়ে বঞ্চিত কর্মকর্তাদের পদোন্নতি ও গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন করা হচ্ছে। এসব কাজ করতে গিয়ে নানা আলোচনার জন্ম দিয়েছে অন্তর্র্বর্তী সরকার।

সিদ্ধান্ত গ্রহণের মারপ্যাঁচে পড়ে অনেক যোগ্য ও বঞ্চিত কর্মকর্তা পদোন্নতি কিংবা গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন পাননি বলে অভিযোগ তুলে প্রতিবাদও করেছেন। কর্মকর্তারা নজিরবিহীনভাবে জানিয়েছেন তাদের ক্ষোভ। এটি প্রশাসনে বিশৃঙ্খলার জন্ম দিয়েছে। যদিও পরে সিদ্ধান্ত সংশোধনের চেষ্টাও ছিল সংশ্লিষ্ট দপ্তরগুলোর। 
একইসঙ্গে প্রশাসনে স্থিতিশীলতা আনতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নেওয়ার ক্ষেত্রে ঘাটতি দেখা গেছে অন্তর্র্বর্তী সরকারের। বিলম্ব সিদ্ধান্তে অস্থিরতায় টালমাটাল প্রশাসন। কোনো কোনো ক্ষেত্রে কাজ-কর্মে নেমেছে স্থবিরতা। তবে সংশ্লিষ্ট শীর্ষ কর্মকর্তারা বলছেন, তারাও দায়িত্বে নতন। পদোন্নতি-পদায়নের ক্ষেত্রে তাদের ভুল তথ্য দেওয়া হচ্ছে। ভুল ও মিথ্যা তথ্যের ভিত্তিতে দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে গিয়ে কোনো কোনো ক্ষেত্রে সমস্যায় পড়ছেন তারা। তবে ত্রুটি ধরা পড়লেও যতটা সম্ভব সংশোধন করেও নেওয়া হচ্ছে বলে জানান তারা।
গত ১১ সেপ্টেম্বর জাতির উদ্দেশে ভাষণে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ২৮তম বিসিএস থেকে ৪২তম বিসিএস পর্যন্ত বিপিএসসি (বাংলাদেশ সরকারি কর্মকমিশন) সুপারিশ করলেও অনেকে নিয়োগবঞ্চিত হয়েছেন। ৮ আগস্ট থেকে এ পর্যন্ত তাদের ২৫৯ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। তিনি বলেন, গত এক মাসে বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগ ১৯৮টি অতিগুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে সিদ্ধান্ত নিয়েছে। জনপ্রশাসনে ১৩৫ জনকে অতিরিক্ত সচিব, ২২৭ জনকে যুগ্ম সচিব ও ১২০ জনকে উপসচিব পদে পদোন্নতি দেওয়া হয়েছে। ৬৭ জন কর্মকর্তার চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। ওএসডি করা হয়েছে ১০ জন যুগ্ম সচিব, আটজন অতিরিক্ত সচিব ও ছয়জন সচিবকে।
পুলিশের ৮০ জন ডিআইজি, ৩০ জন পুলিশ সুপারসহ ১১০ জনকে পদোন্নতি, একজন ডিআইজি, একজন অতিরিক্ত ডিআইজি, চারজন পুলিশ সুপারকে চাকরিতে পুনর্বহাল করা হয়েছে। এ ছাড়া আইজিপিসহ ১০ জন অতিরিক্ত আইজি, ৮৮ জন ডিআইজি, ২১ জন অতিরিক্ত ডিআইজি, ১৭৭ জন পুলিশ সুপারসহ মোট ২৯৭ জন কর্মকর্তাকে বদলি করা হয়েছে। সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, অন্তর্র্বর্তী সরকার যুগ্ম সচিব থেকে অতিরিক্ত সচিব, উপসচিব থেকে যুগ্ম সচিব ও সিনিয়র সহকারী সচিব থেকে উপসচিব পদে মোট ৪৮২ জন কর্মকর্তাকে পদোন্নতি দেয়।

অভিযোগ ওঠে, এদের মধ্যে অনেকেই বিতর্কিত কর্মকর্তা। তাদের কেউ কেউ অতীতে দুর্নীতি-অনিয়মের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। বিভাগীয় মামলায় পেয়েছিলেন শাস্তি। কেউ কেউ ছিলেন পতন হওয়া বিগত সরকারের নানা অপকর্মের সহযোগী। এখন মওকা বুঝে ‘বঞ্চিত’ সেজে অনেক দুর্নীতিগ্রস্ত কর্মকর্তা সুবিধা নিচ্ছেন বলে অভিযোগ।
গত ২০ আগস্ট একযোগে ২৫ জেলার জেলা প্রশাসককে (ডিসি) প্রত্যাহার করা হয়। কিন্তু মাঠ প্রশাসনের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ পদ থেকে কর্মকর্তাদের সরানোর সিদ্ধান্ত হয় নতুন ফিটলিস্ট না করেই। এমনিতেই সরকার পতনের পর কোনো কোনো জেলা থেকে ডিসিরা স্বেচ্ছায় চলে এসেছিলেন। প্রত্যাহারের আদেশ জারির পর যারা কাজ করছিলেন তারাও আগ্রহ হারিয়ে ফেলেন। কোনো কোনো জেলায় কাজ-কর্মে নামে স্থবিরতা। বন্যাকবলিত জেলায় ত্রাণ বিতরণ কার্যক্রম ব্যাহত হয় বলেও অভিযোগ ওঠে। পরে ডিসি ফিটলিস্ট করে ২০ দিন পর ১৯ সেপ্টেম্বর এসব জেলায় ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়।
গত ১০ সেপ্টেম্বর ৩৪ জেলায় নতুন ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়। এর আগের দিন নিয়োগ দেওয়া হয় ২৫ জেলায়। দুদিনে ৫৯ জেলায় নতুন জেলা প্রশাসক নিয়োগ দেওয়াকে কেন্দ্র করে ‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তাদের মধ্যে চরম অসন্তোষ দেখা দেয়।
ডিসি পদে নিয়োগপ্রত্যাশী উপসচিব পদমর্যাদার ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা ১০ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ে গিয়ে ক্ষোভ প্রকাশ করেন। নিজেদের মধ্যে প্রায় হাতাহাতি ও ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তাদের সঙ্গে বাগবিতণ্ডায় জড়িয়ে পড়েন। এ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের এমন ক্ষোভ প্রকাশ, হট্টগোল এর আগে দেখা যায়নি বলে জানিয়েছেন প্রত্যক্ষদর্শী কর্মকর্তারা।
‘বঞ্চিত’ কর্মকর্তাদের দাবি, যাদের ডিসি নিয়োগ দেওয়া হয়েছে, তারা প্রায় সবাই বিগত সরকারের সুবিধাভোগী। গত সরকারের অনুগত থাকায় তারা ভালো জায়গায় চাকরি করেছেন। অনেকের বিরুদ্ধে রয়েছে দুর্নীতির অভিযোগ।

তারা ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন বাতিল চান। পরে ওই দিন মন্ত্রিপরিষদ সচিব মো. মাহবুব হোসেনের সঙ্গে  বৈঠক করেন ক্ষুব্ধ কর্মকর্তারা। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেবেন- মন্ত্রিপরিষদ সচিবের এমন আশ্বাসের পরিপ্রেক্ষিতে ফিরে যান তারা। তবে পরদিনও সচিবালয়ে হট্টগোল করেন কর্মকর্তারা।
প্রতিবাদের মুখে ১১ সেপ্টেম্বর ডিসি হিসেবে ৯ কর্মকর্তার নিয়োগ বাতিল করা হয়। ওই দিন লক্ষ্মীপুর, জয়পুরহাট, কুষ্টিয়া, রাজশাহী, সিরাজগঞ্জ, শরীয়তপুর, দিনাজপুর ও রাজবাড়ীর জেলা প্রশাসকের নিয়োগ বাতিল করা হয়। এ ছাড়া জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের উপসচিব পি কে এম এনামুল করিমকে সিলেটের ডিসি হিসেবে নিয়োগও বাতিল করা হয়। যদিও পরে তাকে ওএসডি করা হয়।
ডিসি নিয়োগের প্রজ্ঞাপন জারির পর ফেনীর সাবেক অতিরিক্ত জেলা প্রশাসক (এডিসি) এনামুল করিমের নিয়োগ নিয়ে সমালোচনার সৃষ্টি হয়। এনামুল করিম ২০১৯ সালে ফেনীর নুসরাত হত্যাকাণ্ডে অভিযুক্তদের বাঁচাতে সব ধরনের প্রচেষ্টা চালান বলে অভিযোগ রয়েছে। মৃত্যুর আগে নুসরাত জাহান রাফি ও তার মা শিরিন আক্তার ন্যায়বিচারের আশায় তার কাছে গিয়েছিলেন। এর পর এনামুল করিমের বিরুদ্ধে মামলা ভিন্ন খাতে প্রবাহিত করার অভিযোগ ওঠে। একইসঙ্গে ডিসি নিয়োগ পাওয়া চারজনের জেলাও বদলে দেওয়া হয়।
গত ১৮ আগস্ট স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের পরিচালক অধ্যাপক ডা. রোবেদ আমিনকে সংস্থাটির মহাপরিচালক (ডিজি) নিয়োগ দেয় অন্তর্র্বর্তী সরকার। তবে চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের কর্মচারীদের একাংশের বাধার মুখে তিনি অফিসে ঢুকতে পারেননি।
গত ১৯ আগস্ট তার পদত্যাগের দাবিতে মহাখালীর ডিএনসিসি ডেডিকেটেড কোভিড হাসপাতালে এক সভায় স্বাস্থ্য উপদেষ্টার সামনেই হট্টগোল করেন চিকিৎসক-কর্মচারীরা। পরে বিএনপিপন্থি স্বাস্থ্যকর্মীদের দাবির মুখে রোবেদ আমিনকে ডিজির পদ থেকে সরিয়ে দেওয়া হয়। পরে গত ১২ সেপ্টেম্বর স্বাস্থ্য শিক্ষা অধিদপ্তরের মহাপরিচালক অধ্যাপক ডা. নাজমুল হোসেনকে স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মহাপরিচালকের অতিরিক্ত দায়িত্ব দেওয়া হয়। স্বাস্থ্যসেবার মতো গুরুত্বপূর্ণ খাতের নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থার শীর্ষ পদে নিয়োগ নিয়ে অস্থিরতাসহ নানা সিদ্ধান্ত গ্রহণে বিঘœ সৃষ্টি করেছে বলে জানিয়েছেন সংশ্লিষ্টরা।

×