নির্বাচনী রোডম্যাপের ওপর জোর দিয়েছে দেশের বাম দল ও তাদের জোটগুলো
নির্বাচনী রোডম্যাপের ওপর জোর দিয়েছে দেশের বাম দল ও তাদের জোটগুলো। বামদলগুলো সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনের তারিখ চায়। অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বাধীন অন্তর্বর্তী সরকার যে সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছে তাকে ইতিবাচক হিসেবে দেখছে বামপন্থি রাজনৈতিক দল ও জোটগুলো। জোট নেতৃবৃন্দ এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য ও কিছু ঘটনায় উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সভাপতি শাহ আলম জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের মূল দাবি হলো নির্বাচনী রোড ম্যাপ ঘোষণা। নেতৃবৃন্দের কথা সরকার সংস্কার করুক। কিন্তু সংস্কারের পাশাপাশি সংবিধানে হাত দেওয়া যাবে না। পাশাপাশি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা করা অত্যন্ত জরুরি।
নানাকারণে বামদলগুলো দ্বিধাবিভক্ত। একটি অংশ ১৪ দলে রয়েছে। আরেক অংশ গণতন্ত্র মঞ্চের সঙ্গে। অন্যদিকে বড় অংশটি বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) নেতৃত্বাধীন বামগণতান্ত্রিক জোটে রয়েছে। বামপন্থি নেতারা আরও জানান, নির্বাচন কমিশন ও নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কারের মধ্য দিয়ে একটি অবাধ সুষ্ঠু নিরপেক্ষ নির্বাচন সম্ভব। এর বাইরে বাকি যে পাঁচটি বিষয়ে সংস্কারের কথা বলা হচ্ছে সেগুলোর প্রস্তাব আগে থেকেই তৈরি করে রাখতে হবে যেটা নির্বাচিত সরকার এসে বাস্তবায়ন করবে।
কারণ সংস্কার এবং সেটি বাস্তবায়ন একটি চলমান প্রক্রিয়া। আর এই সংস্কার কার্যক্রমগুলো সফল করতে হলে রাজনৈতিক দলগুলোকে আস্থায় আনতে হবে। যত দ্রুত সম্ভব সংস্কার কার্যক্রম শেষ করে নির্বাচনের ব্যবস্থা করতে হবে এর জন্য এখনই নির্বাচনের রোডম্যাপ দেওয়া প্রয়োজন বলে ওই নেতারা জানান।
বাংলাদের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সভাপতি শাহ আলম জনকণ্ঠকে বলেন, আমাদের মূল দাবি হলো নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণা। এখন সরকার দ্রব্যমূল্যই নিয়ন্ত্রণে আনতে পারছে না সরকার। সিন্ডিকেট বহাল আছে। দ্রব্যমূল্য মানুষের আওতায় নেই। সরকার সংস্কার করুক, সংস্কার হোক। সরকার আর্থিক খাতে হস্তক্ষেপ করেছে। আমরা বেশকিছু দাবি দাওয়া তুলে ধরেছি। সিপিবিসহ বাম গণতান্ত্রিক জোট যে দাবিগুলো তুলে ধরেছে তা হলো, আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি ও দ্রব্যমূল্যের ঊর্ধ্বগতি নিয়ন্ত্রণ করতে না পারার ঘটনা জনগণের মধ্যে উদ্বেগ বাড়ছে।
দ্রব্যমূল্য সহনীয় রাখতে বাজার ও সিন্ডিকেট নিয়ন্ত্রণ করা দরকার। স্বল্প মজুরি, বকেয়া মজুরি, বন্ধ কারখানা নিয়ে অনিশ্চয়তা- শিল্পাঞ্চলে শ্রমিক অসন্তোষের অন্যতম কারণ। শ্রমিকের সমস্যা সমাধানে আলোচনাকে প্রাধান্য দিয়ে কার্যক্রম শুরু করতে হবে। শিল্পাঞ্চলে নানা ধরনের ব্যবসার দখল, পাল্টা দখল নিয়ে যারা সংকট সৃষ্টি করতে চায়, তাদের বিষয়ে সতর্ক পদক্ষেপ নেওয়া প্রয়োজন। সমতল ও পাহাড়ের জাতিগত ও ধর্মীয় সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের ওপর আক্রমণ দেশে উদ্বেগ ও বিদেশে দেশের ভাবমূর্তি বিনষ্ট করছে।
বাউলদের ওপর আক্রমণ, মাজারে হামলা- দেশের ধর্মীয় সম্প্রীতিকে বিনষ্ট করার শামিল। এক্ষেত্রে সাম্প্রদায়িক শক্তির অশুভ তৎপরতা জনগণকে উদ্বিগ্ন করছে। সনাতন ধর্মাবলম্বীসহ সংখ্যালঘুদের উৎসব যাতে শান্তি ও স্বস্তির সঙ্গে পালিত হতে পারে সেজন্য আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে নাগরিকদের যুক্ত করার উদ্যোগ গ্রহণ করুন। একটি সম্প্রীতির আবহাওয়া গড়ে তুলতে পদক্ষেপ নিতে হবে।
সংস্কার একটি চলমান প্রক্রিয়া। সংস্কারের লক্ষ্যে গঠিত কমিশনসমূহের কার্যপরিধি এবং রোডম্যাপ সম্পর্কে জানা থাকলে দেশবাসী আশ্বস্ত হবে। কমিশনের প্রধানদের নিয়ে, বিশেষ করে, সংবিধান সংস্কার কমিশন প্রধান নিয়ে বিতর্ক এবং সন্দেহ অনভিপ্রেত। সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের লক্ষ্যে সংবিধান যতটুকু সংশোধন দরকার, ততটুকু সংশোধন করার উদ্যোগটাই যথার্থ হবে বলে আমরা মনে করি। একটি নির্বাচিত সরকার ছাড়া সাংবিধানিক ধারাবাহিকতা রক্ষা করা যাবে না।
তাই নির্বাচন ব্যবস্থা সংস্কার করে নির্বাচনের রোডম্যাপ ঘোষণা করার জন্য প্রধান অংশীজন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা এখনই শুরু করা প্রয়োজন। পাঠ্যক্রম সংশোধন কমিটি নিয়ে যে ধরনের ঘটনা ঘটল তা কোনোভাবেই কাম্য নয়। ইতিহাসের শিক্ষা এই যে, সাম্প্রদায়িক শক্তিকে প্রশ্রয় দিলে দেশের জনগণের মধ্যে সংহতি বিনষ্ট হয়।
সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স জনকণ্ঠকে বলেন, এই মুহূর্তে আমাদের মূল দাবি জিনিসপত্রের দাম কমানো। এবং জনগণের ক্রয় ক্ষমতার মধ্যে নিয়ে আসা। একইসঙ্গে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির উন্নতি এবং আমাদের দেশের যানমালের নিরাপত্তা। আমরা দেখতে পারছি সরকার আছে। এই সরকার হচ্ছে অন্তর্বর্তীকালীন সরকার। তার সামনে একটি প্রধান কাজ হচ্ছে একটি সুষ্ঠু গ্রহণযোগ্য নির্বাচন দেওয়া। সেটার জন্য নির্বাচন ব্যবস্থার আমূল সংস্কার ব্যবস্থা করে নির্বাচনী রোডম্যাপ ও সুনির্দিষ্ট নির্বাচন তারিখ ঘোষণার জায়গায় যাওয়া দরকার।
তিনি আরও বলেন, বামগণতান্ত্রিক জোট কিছু বিষয়ে উদ্বেগ প্রকাশ করেছে। এখন পর্যন্ত আহতদের সম্পূর্ণ তালিকা প্রকাশ, তাদের পুনর্বাসনের ব্যাপারে অগ্রগতি দৃশ্যমান নয়। জুলাই হত্যাকা-ের বিচার প্রক্রিয়া দ্রুত শুরু করা দরকার। বেশকিছু ক্যাম্পাসে ছাত্র রাজনীতি নিষিদ্ধ করা হয়েছে- এটা মতপ্রকাশের অধিকারের ওপর আক্রমণ। মুক্তিযুদ্ধ, স্বাধীনতাকে বিতর্কিত করা, ধর্মীয় আবেগকে ব্যবহার করে গোষ্ঠীর স্বার্থে সাধারণ মানুষকে উত্তেজিত করে তোলা, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইবুন্যালসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ পদে বিতর্কিত ব্যক্তিকে নিয়োগ প্রদান করার মাধ্যমেও গণঅভ্যুত্থানের চেতনাকে প্রশ্নবিদ্ধ হচ্ছে। একটি সুষ্ঠু, অবাধ ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের মাধ্যমে নির্বাচিত সরকার গড়ে তোলার জন্য কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ এজন্য গণতান্ত্রিক দল ও ব্যক্তিদের মতামতের ভিত্তিতে জনগণের প্রত্যাশা পূরণের আহ্বান।
এদিকে গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি জনকণ্ঠকে বলেন, আমরা বাম দল নই। আমাদের জোটের নাম গণতান্ত্রিক মঞ্চ। আমরা প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে অংশগ্রহণ করেছি। আমাদের বক্তব্য সেখানে তুলে ধরেছি। আমরা সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনী রোডম্যাপও চাই। শুধু বাম গণতান্ত্রিক জোট নয়, গণতন্ত্র মঞ্চের নেতৃবৃন্দও সংস্কারের পাশাপাশি নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণার ওপর গুরুত্বারোপ করেছে। শনিবার সংলাপ শেষে গণতন্ত্র মঞ্চের শীর্ষ নেতা ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না বলেন, সংস্কারের জন্য প্রয়োজনে সব ধরনের সহযোগিতা আমরা করব। প্রশাসনের কিছু দুর্বলতা দেখছি, ব্যর্থতা দেখছি, সীমাবদ্ধতা দেখছি।
সিভিল পুলিশসহ প্রশাসনে এমনকিছু দেখছি যা উদ্বেগ প্রকাশ করার মতো। এ বিষয়গুলো তাদের বলেছি। প্রধান উপদেষ্টাসহ উপদেষ্টা পরিষদের সম্মান সফল নির্বাচনের ওপর নির্ভর করছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, মানুষের যদি মনে হয় আপনাদের (অন্তর্বর্তী সরকার) লিপ্সা আছে, অর্থের দ্বান্দ্বা, দুর্নীতি বেড়ে যায় তবে তা আপনাদের ওপর বর্তাবে। আপনারা বলবেন যে, জানিনি, বুঝিনি সেটা হবে না। প্রয়োজনে আমাদের সঙ্গে কথা বলেন। আমরা মনে করি, সম্মিলিত প্রচেষ্টায় এই পুরো সংকট কাটিয়ে ওঠা সম্ভব।
গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি বলেন, গণতান্ত্রিক নির্বাচন নিয়ে রাজনৈতিক দল, শিক্ষার্থী, বিভিন্ন শ্রেণিপেশার মানুষের সঙ্গে আলাপ-আলোচনা করার কথা বলেছি। সাম্প্রদায়িক হামলা, মাজারে হামলা, নারীর ওপর হামলা হচ্ছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, এগুলোকে কেন্দ্র করে বাংলাদেশ সম্পর্কে যে প্রচারণা চলছে, সেক্ষেত্রে সরকার ও রাজনৈতিক দলগুলোর সামগ্রিক ভূমিকা নিয়ে ইতিবাচক আলোচনা হয়েছে।
সামনে কার্যকর পদক্ষেপ দেখতে পাব। আমরা মনেকরি গণতান্ত্রিক নির্বাচন, দেশে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত, প্রতিষ্ঠান, আইন সংস্কার-এগুলো গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সংস্কার ছাড়া নির্বাচনকে প্রতিপক্ষ হিসেবে দাঁড় করানোর কিছুই নেই। এই দেশে নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সংস্কার ও নতুন নির্বাচন একে-অপরের পরিপূরক। গণতান্ত্রিক উত্তরণের জন্য জরুরি।
শনিবার রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন যমুনায় বাম দল ও জোটের বৈঠকে নেতৃবৃন্দ এ বিষয়গুলো তুলে ধরেন।
এদিন সিপিবির নেতৃত্বাধীন বাম গণতান্ত্রিক জোটের ৯ জনের প্রতিনিধি দলে ছিলেন বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সভাপতি মো. শাহ আলম, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি) সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স, সাধারণ সম্পাদক, বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টি (সিপিবি), সাবেক সভাপতি মুজাহিদুল ইসলাম সেলিম, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) সহকারী সাধারণ সম্পাদক, রাজেকুজ্জামান রতন, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল (বাসদ) প্রধান উপদেষ্টা, খালেকুজ্জামান, ইকবাল কবির জাহিদ, সাধারণ সম্পাদক, বিপ্লবী কমিউনিস্ট লীগ, মাসুদ রানা, সমন্বয়ক, বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক দল-বাসদ (মার্কসবাদী) ও সমন্বয়ক, বাম গণতান্ত্রিক জোট, মোশরেফা মিশু, সাধারণ সম্পাদক গণতান্ত্রিক বিপ্লবী পার্টি, আব্দুল আলী, নির্বাহী সভাপতি বাংলাদেশের সমাজতান্ত্রিক পার্টি।
অন্যদিকে এ দিন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপ করে গণতন্ত্র মঞ্চের ১২ সদস্যের প্রতিনিধি দল। প্রতিনিধি দলে ছিলেন গণতন্ত্র মঞ্চের সমন্বয়ক ও নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না, বাংলাদেশের বিপ্লবী ওয়ার্কার্স পার্টির সাধারণ সম্পাদক সাইফুল হক, গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি, ভাসানী অনুসারী পরিষদের আহ্বায়ক শেখ রফিকুল ইসলাম বাবলু, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়ক হাসনাত কাইয়ুম, জেএসডির সাধারণ সম্পাদক শহিদ উদ্দিন মাহমুদ স্বপন, নাগরিক ঐক্যের সাধারণ সম্পাদক শহীদুল্লাহ কায়সার, গণসংহতি আন্দোলনের নির্বাহী সমন্বয়কারী আবুল হাসান রুবেল, ভাসানী অনুসারী পরিষদের যুগ্ম-আহ্বায়ক ড. আবু ইউসুফ সেলিম, রাষ্ট্র সংস্কার আন্দোলনের সাংগঠনিক সমন্বয়ক ইমরান ইমন।