.
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পতন হওয়া আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সাবেক মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। আওয়ামী লীগ সরকারের সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম মন্ত্রী হওয়ার পর যেন আলাদিনের চেরাগ পেয়েছিলেন। হাজার কোটি টাকার বেশি ধন-সম্পদ, অর্থবিত্তের মালিক বনেছেন তিনি। ক্ষমতার দম্ভ আর অহঙ্কারের চূড়ান্ত দেখিয়েছেন তিনি। তার নির্বাচনী এলাকার (কুমিল্লা-৯, লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ) লোকজন তাকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধন না করলে ‘মাইন্ড’ করতেন। সাবেক মন্ত্রী তাজুল, তার স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলাম ও স্বজন শাহ আলম মুকুল মিলে বান্দরবানের লামার সরইতে নিয়মবহির্ভূতভাবে দলিলে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে জোর করে দখলে নিয়েছেন প্রায় কয়েকশ’ কোটি টাকার জমি। কেবলমাত্র দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা অনুযায়ী, গত ১০ বছরে ১০০ কোটি টাকার সম্পদ গড়েছেন। নির্বাচনী হলফনামার বাইরে তাজুল ইসলাম ক্ষমতায় থাকাকালীন তার স্বজনরাও দুর্নীতির মাধ্যমে গড়ে তুলেছেন সম্পদের পাহাড়। দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) এই বিষয়ে তদন্ত শুরু করেছে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, দুদক সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায়মন্ত্রী (এলজিআরডি) মো. তাজুল ইসলামের সম্পদের তথ্য চেয়ে চিঠি দিয়েছে। দুদকের পাঠানো ওই চিঠিতে তাজুল ইসলাম, তার স্ত্রী-সন্তান ও তার ওপর নির্ভরশীলদের তথ্য ৩০ সেপ্টেম্বরের মধ্যে পাঠাতে বলা হয়। কিন্তু নির্দিষ্ট তারিখের মধ্যে দুদকের দপ্তরে কোনো তথ্য পাঠাননি সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী।
দুদকের অভিযোগ থেকে জানা যায়, আওয়ামী লীগ সরকারের ক্ষমতার অপব্যবহার করে সাবেক এলজিআরডিমন্ত্রী তাজুল ইসলাম শত শত কোটি টাকার মালিক হয়েছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে হলফনামায় তিনি যে সম্পদ থাকার ঘোষণা দেন, তাতে দেখা যায় ২০০৮ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত তার সম্পদ বেড়েছ ২৪২ গুণ। এর আগে তাজুল ইসলাম ও তার স্ত্রী-সন্তানের ব্যাংক হিসাব তলব করে আর্থিক গোয়েন্দা সংস্থা বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। একই সঙ্গে তার পরিবারের স্বার্থসংশ্লিষ্ট প্রতিষ্ঠানের নামে ব্যাংকে পরিচালিত হিসাব ও অন্যান্য তথ্যও পাঠাতে নির্দেশ দেয়। এর পর বিএফআইইউ থেকে ২ সেপ্টেম্বর বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠানে তাজুলের ব্যাংক হিসাব অবরোধের নির্দেশ দেয়।
তাদের পাঠানো চিঠিতে বলা হয়েছে, উল্লিখিত ব্যক্তি ও তাদের ব্যক্তি মালিকানাধীন প্রতিষ্ঠানের নামে কোনো হিসাব পরিচালিত হয়ে থাকলে সেই হিসাবের লেনদেন মানিলন্ডারিং প্রতিরোধ আইন, ২০১২-এর ২৩ (১) (গ) ধারার আওতায় ৩০ দিনের জন্য স্থগিত থাকবে। সরকারের সাবেক মন্ত্রী, এমপিদের জ্ঞাত আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন ও তাদের বহুগুণ সম্পদ বেড়ে যাওয়ার তথ্য সংবলিত একটি অভিযোগ দুদক চেয়ারম্যানের কাছে দেন সুপ্রিম কোর্টের একজন আইনজীবী। তার আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে গত ১৯ আগস্ট সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী তাজুলসহ ১৮ মন্ত্রী, প্রতিমন্ত্রীসহ ৪১ জনের দুর্নীতি অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেয় দুদক।
সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী এম সারওয়ার হোসেন বলেছেন, ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) গবেষণার ওপর ভিত্তি করে সংবাদ মাধ্যমে প্রকাশিত প্রতিবেদন অনুযায়ী তিনি ৪১ জনের অবৈধ সম্পদ অর্জনের অভিযোগের তদন্ত চেয়েছেন। অভিযোগপত্রে তিনি যেসব তথ্য সংযুক্ত করেছেন, যেখানে স্পষ্টতই দেখা যাচ্ছে যে কীভাবে তাদের সম্পদ কয়েক বছর ধরে বেড়েছে। দুর্নীতি ছাড়া সম্পদের এত বৃদ্ধি সম্ভব নয়।
দুদক সচিব খুরশিদা ইয়াসমিন সাংবাদিকদের জানিয়েছেন, ৪১ জনের বিরুদ্ধে কমিশনে অভিযোগ করা হয়েছে। কমিশন নিয়ম অনুযায়ী সেগুলো খতিয়ে দেখবে।
বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে পতন হওয়া আওয়ামী লীগের প্রভাবশালী সাবেক এলজিআরডিমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম। সাবেক এলজিআরডিমন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের সম্পদের তথ্য চেয়েছে দুদক। দুদক এই প্রভাবশালী মন্ত্রীর বিরুদ্ধে তদন্ত করছে।
দুদকের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের হলফনামা অনুযায়ী ১০ বছর আগে তাজুল ইসলামের মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৬ কোটি টাকার কিছু বেশি। বর্তমানে তা ১১৮ কোটি ছাড়িয়ে গেছে। দুর্নীতি দমন কমিশনের আমলে নেওয়া অভিযোগ তদন্তাধীন। এলজিআরডি মন্ত্রী থাকাকালীন জনস্বাস্থ্য প্রকৌশল অধিদপ্তর, স্থানীয় সরকার বিভাগ, জেলা পরিষদ, উপজেলা ও পৌরসভায় উন্নয়নের নামে দেওয়া বরাদ্দ থেকে কমিশন বাণিজ্যের মাধ্যমে হাজার হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছেন তাজুল ইসলাম।
দুদকে যেসব অভিযোগের তদন্ত হচ্ছে, তার মধ্যে জেলা, উপজেলা, পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের উন্নয়ন কাজে যে বরাদ্দ দেওয়া হতো, সেসব বরাদ্দ থেকে নির্দিষ্ট অঙ্কের কমিশন দিতে হতো তাজুল ইসলামকে। তার ব্যক্তিগত আদায়কারী ছিল তার ভাতিজা শাহাদাৎ ও এপিএস জাহিদ। কমিশন বাণিজ্যে তার শ্যালক লাকসাম উপজেলার ভাইস চেয়ারম্যান মহব্বত আলী, ভাতিজা মনোহরগঞ্জ উপজেলা ভাইস চেয়ারম্যান আমিরুল ইসলাম ও তার উন্নয়ন সমন্বয়ক কামাল হোসেন। কমিশন বাণিজ্যের ফলে তারাও এখন একেকজন শত কোটি টাকার মালিক। এ ছাড়া তাজুলের মনোহরগঞ্জের বাড়ি টর্চারসেল হিসেবে ব্যবহার করত তার এক ভাতিজা। তাজুল ইসলাম ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে লাকসামের সমবায় ব্যাংকের কয়েক কোটি টাকার জায়গা নামমাত্র মূল্যে কিনে নেন। তাজুল ইসলাম লাকসাম-মনোহরগঞ্জের অনেকের জায়গা-জমি অবৈধভাবে দখল করে নেন। কেউ বাধা দিলে মামলা-হামলা করে এলাকা ছাড়া করা হতো তাকে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, মো. তাজুল ইসলাম ব্যবসায়ী থেকে রাজনীতিতে আসার কয়েক মাসের মধ্যেই ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো কুমিল্লা-৯ আসন থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯৬ সালের পর যত জাতীয় সংসদ নির্বাচন হয়েছে, তার প্রতিটিতেই এ আসনে নৌকার প্রার্থী ছিলেন তিনি। ২০০১ সালের নির্বাচনে পরাজিত হলেও ২০০৮ সাল থেকে টানা চার মেয়াদে কুমিল্লা-৯ আসনের এমপি নির্বাচিত হয়েছেন তাজুল। লাকসামের আওয়ামী লীগ নেতা আইনজীবী ইউনুস ভূঁইয়ার হাত ধরে রাজনীতিতে আসা তাজুল প্রথমবার এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর থেকেই নিজের ভোল পাল্টাতে শুরু করেন। সেই সময় থেকেই নিজেকে ‘স্যার’ ডাকতে বাধ্য করেন দলের নেতাকর্মীসহ সাধারণ মানুষকে। একটা পর্যায়ে এসে তাকে স্যার বলে সম্বোধন না করলে ‘মাইন্ড’ করতেন তিনি। যদিও তাজুলের আগে ওই আসনে কোনো রাজনীতিবিদকে ‘স্যার’ বলে সম্বোধনের প্রচলন দেখা যায়নি।
এমপির পদে বসেই আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের কোণঠাসা করে তাজুল বিস্তার করতে থাকেন নিজের সাম্রাজ্য। গড়ে তোলেন নিজস্ব সন্ত্রাসী বাহিনী। ২০০৮ সালে দ্বিতীয়বারের মতো এমপি নির্বাচিত হয়ে আরো বেপরোয়া হয়ে ওঠেন তাজুল। নিজেকে ভাবতে শুরু করেন লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলার একক অধিপতি।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানায়, রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ দলগুলোর পাশাপাশি আওয়ামী লীগের ত্যাগী নেতাদের কোণঠাসা করে দাবিয়ে রাখার কূটকৌশল নেন সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম। দিন যত গেছে, তাজুলের নিজ আত্মীয়-স্বজন ও পছন্দের হাইব্রিড নেতাদের দিয়ে দল পরিচালনার পরিধি ততই বেড়েছে। ২০১৮ সালের বিতর্কিত নির্বাচনে এমপি নির্বাচিত হওয়ার পর এলজিআরডিমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব পান তাজুল। তখনই অহঙ্কার ও দম্ভের চূড়ান্ত পর্যায়ে পৌঁছান তিনি। মন্ত্রিত্ব পেয়েই আর পেছনে ফিরে তাকাতে হয়নি। নিজ নির্বাচনী এলাকার সাধারণ মানুষ তো বটেই, দলের নেতাকর্মীদেরও আর প্রয়োজন বলে মনে করেননি। তিনি বনে যান লাকসাম-মনোহরগঞ্জের অঘোষিত ‘স¤্রাট’।
দশম, একাদশ ও দ্বাদশ সংসদ নির্বাচনে প্রার্থী হিসেবে তাজুল ইসলামের দাখিল করা হলফনামা বিশ্লেষণ করে জানা গেছে, সাবেক এই মন্ত্রী বছরে আয় করেছেন চার কোটি ১৭ লাখ টাকা। মন্ত্রিত্ব পাওয়ার পর তাজুল লুটপাট আর অবৈধ সম্পদ অর্জনে বেপরোয়া হয়ে ওঠেন। দেশে ও বিদেশে বিপুল সম্পদের পাহাড় গড়েছেন বলে জানা গেছে। ১০ বছর আগে ২০১৪ সালের নির্বাচনে হলফনামায় দেওয়া তথ্যে তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ১৬ কোটি টাকার কিছু বেশি। আর গত ৭ জানুয়ারির নির্বাচনে দেওয়া হলফনামা বিশ্লেষণ করলে দেখা যায়, তাজুলের সেই সম্পদ ১১৮ কোটি টাকা ছাড়িয়েছে। আর মন্ত্রী হওয়ার আগে ২০১৮ সালে তার মোট সম্পদের পরিমাণ ছিল ৪৭ কোটি ৪৬ লাখ টাকা। চার বছরের ব্যবধানে সেই সম্পদ দ্বিগুণের বেশি হয়েছে। তাজুল কুমিল্লা দক্ষিণ জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতির পদে রয়েছেন। দ্বাদশ জাতীয় সংসদের বিতর্কিত নির্বাচনে বিজয়ী হলে দ্বিতীয় মেয়াদে একই মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রিত্ব পান।
তাজুল ইসলাম ১৯৯৬ সালে প্রথমবারের মতো আওয়ামী লীগ থেকে এমপি হওয়ার পর এখানে ‘তাজুলীগ’ প্রতিষ্ঠায় তৎপর হয়ে ওঠেন। ধীরে ধীরে সেটি প্রতিষ্ঠিতও হয়। ‘তাজুলীগ’ ছাড়া তার কাছে আর কারো মূল্য ছিল না। দানবীয় প্রকৃতির তাজুল ইসলাম দ্বিতীয়বার এমপি হওয়ার পর তার রাক্ষুসে ভাব স্বরূপে আবির্ভূত হয়। নজর পড়ে লাকসামের কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের ওপর। ২০১০ সালে কূটকৌশলের আশ্রয় নিয়ে লাকসাম সমবায় ব্যাংকের গ্রাহকদের সঞ্চিত টাকায় কেনা স্থাবর-অস্থাবর শত কোটি টাকার সম্পদ দখল করে নেন তাজুল ইসলাম।
দুর্নীতি দমন কমিশনে অভিযোগ করা হয়েছে, লাকসাম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংকের বিরুদ্ধে মানি ডিক্রিজারি মামলা দায়ের করে বাংলাদেশ সমবায় ব্যাংক লিমিটেড। এরপর ওই ব্যাংকের স্থাবর সম্পত্তির নিলাম বিজ্ঞপ্তি প্রচার করা হয়। ওই নিলাম বিজ্ঞপ্তির বিরুদ্ধে তৎকালীন লাকসাম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যান নিলাম কার্যক্রম বন্ধ রাখার জন্য সমবায় ব্যাংকের সহযোগিতা চেয়ে একটি চিঠি দেন। কিন্তু ওই চিঠির গুরুত্ব না দিয়ে লাকসাম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক নিলামে বিক্রির সিদ্ধান্তে অটল থাকে। স্থানীয়দের দাবি, তৎকালীন এমপি তাজুল ইসলামের সমবায় ব্যাংকের সম্পত্তি দখলের স্বপ্ন বাস্তবায়নের জন্যই লাকসাম কেন্দ্রীয় সমবায় ব্যাংক লিমিটেডের চেয়ারম্যানের চিঠির গুরুত্ব দেয়নি। লাকসাম কেন্দ্রীয় ব্যাংক নিলামে বিক্রি হয়। নিলামে তাজুল ইসলাম সন্ত্রাসী বাহিনীদের দিয়ে মহড়া করে অন্য কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠানকে ওই নিলামে অংশগ্রহণ করতে দেয়নি।
কূটকৌশলে পাকা খেলোয়াড়, তাজুল ইসলাম তার স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলামকে দিয়ে চট্টগ্রামের বান্দরবানের পাহাড়ের শত শত একর জমি জবরদখল করে নেন।
তদন্তে পাওয়া তথ্যে প্রকাশ, মন্ত্রী তাজুল ইসলামের ক্ষমতার দাপটে তার স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলামও অবৈধ দখল উৎসবে মেতে ওঠেন। স্বামীর দানবীয় ক্ষমতার শক্তিতে পিছিয়ে ছিলেন না মন্ত্রীপতœী ফৌজিয়া ইসলামও। সম্পদ অর্জনে ক্ষমতাধর স্বামীর সঙ্গে প্রতিযোগিতায় নেমে পড়েন ফৌজিয়া। তাজুল রাস্তাঘাট, পুল, কালভার্ট থেকে যখন অবৈধ কমিশনের হাজার হাজার কোটি টাকার হিসাব কষেন, তখন স্ত্রী ফৌজিয়া খামারের শখ পূরণ করতে মেতে ওঠেন বান্দরবানে পাহাড় অবৈধ দখলের উৎসবে। মন্ত্রীর ক্ষমতার দাপট দেখিয়ে এক হাত কিনে ১০ হাত দখল করে নেন। অসহায় পাহাড়ি পরিবারের শতশত একর জমি বেহাত হয়ে যায়। এ নিয়ে পাহাড়ি জমির মালিকরা মামলা করলেও কোনো লাভ হয়নি, উল্টো তাদেরই এলাকা ছাড়া করেন ফৌজিয়া ইসলাম। মন্ত্রী তাজুল ও তার স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলামের বিচারের দাবিতে মানববন্ধন ও সমাবেশ করেছেন বান্দরবানের ক্ষতিগ্রস্ত পাহাড়িরা। মানববন্ধনে বান্দরবানের সাবেক স্থানীয় সরকার মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলাম ও তার স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলাম কর্তৃক অসহায় পরিবারের জায়গা, চলাচলের রাস্তা জোরপূর্বক দখলের প্রতিবাদে এবং দখলীয় জায়গা পুনরুদ্ধার করে দোষী ব্যক্তির বিরুদ্ধে শাস্তির দাবি জানিয়েছেন সেখানকার ভুক্তভোগীরা। বান্দরবান প্রেস ক্লাবের সামনে দেরাজ মিয়াপাড়া, ফুইট্টা ঝিরি, টংগঝিরি, পুর্গা খোলা, প্রিয়শরীর শতাধিক পাহাড়ি বাঙালি নারী-পুরুষ এ মানববন্ধন করেন।
মানববন্ধনে তারা বলেন, বহিরাগত সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম ও তার স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলাম বর্তমানে আত্মগোপনে থেকে তাদের স্বজন শাহ আলম মুকুলের মাধ্যমে স্থানীয় সন্ত্রাসী মহাকাত আলী, শাহাব উদ্দিন, বাবুল, বেদু, দেলুয়ার, লিয়াকত, সোহরাব, রায়হান, শাহেব মিয়াসহ কয়েকজনকে দিয়ে আমাদের জায়গায় থাকা ঘরবাড়ি ভাঙচুর করে এবং জায়গা থেকে সরে না গেলে প্রতিনিয়ত হত্যার হুমকি দিয়ে যাচ্ছে। বিভিন্ন সময় মামলা দেওয়ার পরও এসব সন্ত্রাসী প্রকাশ্যে অস্ত্রহাতে ঘুরে বেড়ালেও পুলিশ তাদের গ্রেপ্তার করছে না। এ সময় তারা সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলাম ও তার স্বজন শাহ আলম মুকুলসহ সব সন্ত্রাসীকে গ্রেপ্তারের দাবি জানান। তাদের দাবি, সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, তার স্ত্রী ও স্বজন শাহ আলম মুকুল লামার সরইয়ের দেরাজ মিয়াপাড়ায় ভুয়া কাগজ তৈরির মাধ্যমে এসব অসহায় পরিবারের পাঁচশ’ একরের বেশি জমি বেদখল করেছেন। তাই অতিসত্বর এসব জায়গা উদ্ধার করে অসহায় পরিবারকে ফিরিয়ে দিয়ে দোষীদের শাস্তির দাবি জানাচ্ছি। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশ ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার পর আত্মগোপনে চলে যান তাজুল ইসলামও।
দুদকে অভিযোগ করা হয়েছে, বান্দরবানের লামার সরই ইউনিয়নের আন্দারীর ফুইট্টার ঝিরি এলাকায় পাহাড়ি-বাঙালিসহ প্রায় ১০০ পরিবারকে ‘সন্ত্রাসী বাহিনী’ দিয়ে নিজ জমিতে কাজ করতে বাধা দেওয়ার অভিযোগ উঠেছে সাবেক স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রী তাজুল ইসলামের বিরুদ্ধে। ফুইট্টা ঝিরি এলাকার বাসিন্দারা এ অভিযোগ করেন। অভিযোগে ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, পাড়াবাসীরা ফুইট্টার ঝিরি এলাকায় নিজ জমিতে কাজ করতে গেলে হঠাৎ সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামের ম্যানেজারসহ একদল লোক দা ও লাঠি নিয়ে হামলা চালাতে আসে। এ সময় তাদের ভয়ে পাড়াবাসীরা নিজেদের জায়গা থেকে পালিয়ে যায়। সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম লামার সরইতে নিয়মবহির্ভূতভাবে দলিলে জালিয়াতির আশ্রয় নিয়ে জোর করে দখলে নিয়েছেন প্রায় কয়েকশ’ কোটি টাকার জমি। জমিগুলোও সরকারিভাবে জব্দ করার দাবি জানান তারা।
দুদকে স্থানীয় বাসিন্দারা অভিযোগ করেছেন, বান্দরবানের স্থানীয় বাসিন্দা না হলে কেউ জায়গা কিনতে পারেন না। তাহলে মন্ত্রী কীভাবে জায়গা কিনলেন? আমরা বান্দরবানে থেকে লিজ পাই না। বাইরে থেকে এসে মন্ত্রী লিজ নেন কীভাবে? সরকার পতনের পর তাজুল ইসলাম পালিয়ে গেলেও তার সন্ত্রাসী বাহিনী স্থানীয়দের ওপর হামলা চালিয়ে জমি দখলের চেষ্টা চালাচ্ছে।
ভুক্তভোগী মতিলাল ত্রিপুরা অভিযোগ করেছেন, আমাদের দীর্ঘ ৫০ বছরের বেশি সময় ধরে জুম চাষের জমিগুলো সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলাম, তার স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলাম ও স্বজন শাহ আলম মুকুল মিলে দখল করছে। আমরা আমাদের নিজ জমিতে কাজ করতে গেলে সন্ত্রাসী বাহিনী দিয়ে হুমকি দেয়। এখন আমরা জীবনের নিরাপত্তা নিয়ে ভয়ে আছি।
উল্লেখ্য, বান্দরবানের লামার সরইতে সাবেক মন্ত্রী তাজুল ইসলামের স্ত্রী ফৌজিয়া ইসলামসহ তার স্বজনদের ৫০০ একরের বেশি জমি দখলে রয়েছে।
গত ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার গণআন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনার পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করার পর লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলায়ও মুক্তিকামী ছাত্র-জনতা রাস্তায় নেমে আসে। বিক্ষুব্ধ জনতা মনোহরগঞ্জের পোমগাঁও গ্রামে অবস্থিত তাজুলের আলিশান বাড়িতে ব্যাপক ভাঙচুর চালায়। এরপর অগ্নিসংযোগ করা হয় পুরো বাড়িতে। লুটপাট করে নেওয়া হয় বাড়ির সব মালামাল।
একই সময়ে ভাঙচুর, লুটপাট ও অগ্নিসংযোগ করা হয়েছে লাকসামের পাইকপাড়ায় অবস্থিত তাজুলের আরেকটি বাড়িতেও। এ সময় বিক্ষুব্ধ জনতাসহ সাধারণ মানুষ বলতে থাকে, দীর্ঘ দেড় যুগ পর জালিমের হাত থেকে মুক্ত হয়েছে লাকসাম ও মনোহরগঞ্জ উপজেলা। এতদিন নিজেকে লাকসাম ও মনোহরগঞ্জের প্রভু ভাবতেন তাজুল। সেই সঙ্গে অবসান ঘটে তাজুলের অহঙ্কার ও দম্ভেরও। ছাত্র-জনতার গণ-আন্দোলনের মুখে প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে (৫ আগস্ট) দেশত্যাগ করলেও তাজুল দেশের পরিস্থিতি টের পেয়েছেন আরও আগেই। এ জন্যই ৩ আগস্ট দেশ ছাড়েন তিনি। তবে বর্তমানে তাজুল কোন দেশে রয়েছেন সে তথ্য নিশ্চিত হওয়া যায়নি।
সাবেক এলজিআরডি মন্ত্রী মো. তাজুল ইসলামের বক্তব্য জানতে তার মোবাইল ফোন, হোয়াটস অ্যাপসহ বিভিন্ন মাধ্যমে বারবার চেষ্টা করা হলেও তা সম্ভব হয়নি। আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগেই বিদেশে চলে যাওয়ার পর বর্তমানে বিদেশেই অবস্থান করছেন তাজুল ইসলাম।