পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান।
সুন্দরবনে গত ছয় বছরে ১১ টি বাঘ বেড়েছে। দেশে এখন বাঘের সংখ্যা ১২৫। যা আগের জরিপে ছিল ১১৪। বাংলাদেশে বাঘের একমাত্র আশ্রয়স্থল সুন্দরবনে জরিপ চালিয়ে এই সংখ্যা প্রকাশ করেছে বন বিভাগ। পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রলয়ের উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান আনুষ্ঠানিকভাবে এ তথ্য প্রকাশ করেন।
মঙ্গলবার সকালে পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রলয়ে বাঘ জরিপের এ ফলাফল প্রকাশের সময় আরও উপস্থিত ছিলেন, সচিব ড. ফারহিনা আহমেদ, অতিরিক্ত সচিব ইকবাল আব্দুল্লাহ হারুন, প্রধান বন সংরক্ষক মোঃ আমীর হোসাইন চৌধুরী, জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর এমএ আজিজ, খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো, সংশ্লিষ্ট প্রকল্প পরিচালক ড. আবু নাসের মোহসিন হোসেনসহ সুন্দরবন বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পসহ পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয় এবং বন অধিদপ্তরের অন্যান্য কর্মকর্তাবৃন্দ।
উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, ২০১৮ সালের তুলনায় ২০২৪ সালে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ৯ দশমিক ৬৫ শতাংশ বৃদ্ধি পেয়েছে। ক্যামেরা ট্রাপিং এর মাধ্যমে বাঘ জরীপে ২০১৫ সালের তুলনায় ২০১৮ সাল এবং ২০২৪ সালে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বৃদ্ধি নিঃসন্দেহে দেশের সকলের জন্য আনন্দদায়ক ও তাৎপর্যপূর্ণ সংবাদ। বাঘ যেহেতু অতি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী এবং বাঘের জন্য এখনো বিভিন্ন চ্যালেঞ্জ বিদ্যমান, সেহেতু বাঘ সংরক্ষণে আমাদের প্রচেষ্টা অব্যাহত রাখতে হবে।’ এক্ষেত্রে সরকারের পাশাপাশি বেসরকারি ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান, স্থানীয় জনগণ, ছাত্র-ছাত্রী, যুবসমাজ, সংবাদিকসহ সামাজের বিভিন্ন স্তরের সকলের আন্তরিকভাবে সহযোগিতা তিনি কামনা করেন।
বন বিভাগের প্রতিবেদন অনুযায়ী গত বছরের জানুয়ারি, এপ্রিল, নভেম্বর এবং ২০২৪ সালের মার্চে সুন্দরবনে ওই জরিপ করা হয়। বনের ২ হাজার ২৪০ বর্গকিলোমিটার এলাকাজুড়ে ওই জরিপ চালানো হয়। সেখানে স্থাপন করা হয় মোট ৬৫৭টি ক্যামেরা ফাঁদ। বাঘ পাশ দিয়ে যাওয়ার সময় স্বয়ংক্রিয়ভাবে ওই ক্যামেরায় ছবি ওঠে। ক্যামেরায় ওঠা মোট ৩১ হাজার ৪৮২টি ছবির মধ্যে বাঘের ছবি ছিল ৭ হাজার ২৯৭টি।
ক্যামেরা ছাড়াও সুন্দরবনের ১ হাজার ৩০৬ কিলোমিটার খালপাড়ে সরেজমিন জরিপ করা হয়। এসব খালে বাঘের পায়ের ছাপ গুনে বাঘের সংখ্যা ও ঘনত্ব পরিমাপ করা হয়। জরিপে প্রতি ১০০ বর্গকিলোমিটার এলাকায় ২ দশমিক ৬২টি বাঘের অস্তিত্ব পাওয়া যায়। ক্যামেরায় মোট ৮৪টি বাঘের ছবি পাওয়া গেছে। বাকি ৪১টি বাঘ খাল জরিপের মাধ্যমে পাওয়া যায়।
এর মধ্যে খুলনা রেঞ্জে বাঘের সংখ্যা সবচেয়ে বেশি বেড়েছে। সাতক্ষীরায় কমেছে। চোরা শিকারিদের প্রভাব ও বাঘের খাবার (হরিণ) কমে যাওয়ায় সুন্দরবনের ওই এলাকায় বাঘের সংখ্যা কমেছে বলে জরিপকারী দলটি ধারণা করছেন।
তবে বাঘ জরিপের ফলাফল সম্পর্কে প্রধান বন সংরক্ষক আমীর হোসেন চৌধুরী বলেন, ‘বাংলাদেশের সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা বেড়েছে। ওই সংখ্যা আরও বাড়ানোর ব্যাপারে আমরা চেষ্টা করছি। সবার সহযোগিতার মাধ্যমে তা সম্ভব বলে মনে করি।’ এবারের জরিপে অত্যন্ত ইতিবাচক দিক হল, ২১টি শিশু বাঘ পাওয়া গেছে। আগের দুটি জরিপে (২০১৮ ও ২০১৫) যা ছিল মাত্র ৫টি। এটা ভবিষ্যতে আরও বাঘ বাড়ার আশা জাগাচ্ছে বলে তিনি মনে করেন।
এবারের ক্যামেরা জরিপে সুন্দরবনের খুলনা অংশে বাঘের নারী–পুরুষের সংখ্যার ক্ষেত্রে বেশ পার্থক্য দেখা গেছে। এখানে পাওয়া ৮৪টি বাঘের মধ্যে ২১টি নারী ও ৬২টি পুরুষ বাঘ। আর একটি বাঘ নারী না পুরুষ, তা নির্ধারণ করা যায়নি। সামগ্রিকভাবে বাঘের নারী ও পুরুষের ওই সংখ্যার ভারসাম্য ঠিক আছে বলে মনে করছেন বন্য প্রাণী বিশেষজ্ঞরা।
এদিকে জরিপে খুলনা রেঞ্জে বাঘের নারী ও পুরুষের ক্ষেত্রে বেশ ভারসাম্যহীনতা দেখা গেছে। ওই এলাকায় একটি পুরুষ বাঘের বিপরীতে ১২টি নারী বাঘ দেখা গেছে। অর্থাৎ ওই এলাকায় একটি পুরুষ বাঘ মারা গেলে পুরো এলাকা পুরুষ বাঘশূন্য হওয়ার ঝুঁকি রয়েছে। ফলে দীর্ঘ মেয়াদে সেখানে বাঘের সংখ্যা দ্রুত কমে যেতে পারে। এ অবস্থায় এই এলাকায় পুরুষ বাঘের সংখ্যা বাড়ানোর ব্যাপারে প্রতিবেদনে জোর দেওয়া হয়েছে।
এবার বাঘ জরিপের জন্য সুন্দরবনে গাছের সঙ্গে মাটি থেকে ৫০ সেন্টিমিটার ওপরে ক্যামেরা স্থাপন করা হয়। ক্যামেরার সামনে দিয়ে কোনো বাঘ বা অন্য যেকোনো প্রাণী গেলে ক্যামেরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে সেটির ছবি ও ১০ সেকেন্ডের ভিডিও ধারণ করে রাখে। এরপর ক্যামেরা ট্র্যাপিংয়ে পাওয়া ছবি বন অধিদপ্তরের রিসোর্স ইনফরমেশন ম্যানেজমেন্ট সিস্টেম ইউনিটে বিশ্লেষণ করে বাঘের সংখ্যা নির্ধারণ করা হয়। এ ছাড়া সুন্দরবনের খালে সাধারণত সব বাঘ পানি খেতে আসে। এতে খালের পাড়ে বাঘের পায়ের ছাপ পড়ে। বাঘের ধরন অনুযায়ী ওই ছাপ ভিন্ন হয়। এভাবে পায়ের ছাপ দেখেও বাঘের সংখ্যা গননা করা হয়।
একই রকম দেখতে বাঘগুলো কীভাবে পৃথক শনাক্ত করা হয় এমন প্রশ্নের জবাবে বাঘ সংরক্ষণ প্রকল্পের পরিচালক আবু নাসের মহসিন হোসেন বলেন, একজন মানুষের আঙুলের ছাপের সঙ্গে আরেকজনের ছাপের যেমন মিল নেই, তেমনি একটি বাঘের ডোরাকাটার সঙ্গে আরেকটি বাঘেরও মিল থাকে না। ক্যামেরায় একেকটি বাঘের শতাধিক ছবিও ওঠে। সেসব ছবি সংগ্রহের পর কম্পিউটারের সফটওয়্যারে প্রতিটি বাঘের আলাদা করে তথ্য-উপাত্ত বিশ্লেষণ করেই জানা যায়, সুন্দরবনে ঠিক কতগুলো বাঘ আছে।’
খুলনা অঞ্চলের বন সংরক্ষক মিহির কুমার দো জনকণ্ঠকে বলেন, বাঘকে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক পাহারাদার বলা হয়ে থাকে। সুন্দরবনে বাঘ আছে বলেই দেশের অন্যান্য বনাঞ্চলের তুলনায় সুন্দরবন এখনো অনেক সুরক্ষিত। তাই বাঘ সংরক্ষণে সরকার বেশ কিছু গুরুত্বপূর্ণ কার্যক্রম গ্রহণ ও বাস্তবায়ন করছে।
এরমধ্যে অন্যতম হলো: বাঘসহ সুন্দরবনের অন্যান্য বন্যপ্রাণীর অবাধ বিচরণ ও প্রজননের উদ্দ্যেশে বনের ৫৩.৫২% এলাকাকে রক্ষিত এলাকা ঘোষণা করে সেখান থেকে সকল ধরণের বনজ সম্পদ আহরণ নিষিদ্ধ করা হয়েছে।
বাঘ মানুষের দ্বন্ধ হ্রাসে লোকালয় সংলগ্ন এলাকায় ৬০ কিলোমিটার দীর্ঘ নাইলনের ফেন্সিং তৈরি করা হচ্ছে। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের সময় বাঘ ও অন্যান্য বন্যপ্রাণীর আশ্রয়ের জন্য বনের ভিতরে ১২টি মাটির উচু কিল্লা/ডিবি নির্মাণ করা হয়েছে।
বাঘের আক্রমণে নিহত ব্যক্তির পরিবারকে ৩ লক্ষ টাকা এবং গুরুতর আহত ব্যক্তিকে ১ লক্ষ টাকা ক্ষতিপূরণ বাবদ প্রদান করা হচ্ছে। বাঘ সংক্রান্ত অপরাধ উদঘাটনে তথ্য প্রদানকারীকে সর্বোচ্চ ৫০ হাজার টাকা সম্মানি প্রদান করা হচ্ছে। লোকালয়ে চলে আসা বাঘকে পুনরায় বনে ফিরিয়ে দেবার জন্য স্থানীয় জনগণকে সম্পৃক্ত করে ৪৯টি ভিলেজ টাইগার রেসপন্স টিম গঠন করা হয়েছে এবং টিমের সদস্যদেরকে প্রশিক্ষণ প্রদান করা হয়েছে। বাঘ সংরক্ষণে সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে প্রতি বছর বিশ্ব বাঘ দিবস পালনসহ বিভিন্ন গণসচেতনতামূলক কার্যক্রম গ্রহণ অব্যহত রয়েছে বলে তিনি উল্লেখ করেন।
বন বিভাগ সূত্র মতে, ২০০৪ সালের জরিপে সুন্দরবনে বাঘের সংখ্যা ছিল ৪৪০টি। এর আগে ১৯৯৬-৯৭ সালের জরিপে বাঘের সংখ্যা উল্লেখ করা হয় ৩৫০টি থেকে ৪০০টি। ওই দুটি জরিপে বাঘের পায়ের ছাপ গুনে বাঘের সংখ্যা গণনা করা হয়েছিল। কিন্তু ওই পদ্ধতির গ্রহণযোগ্যতা নিয়ে বিভিন্ন মহলে প্রশ্ন ওঠে। ২০১৫ সালের জরিপ ছিল সর্বাধুনিক ও বিজ্ঞানসম্মত। ওই জরিপে সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘের সংখ্যা পাওয়া যায় ১০৬টি। এই সংখ্যাটিকেই নির্ভরযোগ্য ধরে পরে বাঘের সংখ্যা বাড়ানোর পদক্ষেপ নেওয়া হয়। ২০১৮ সালের সর্বশেষ বাঘ জরিপে সুন্দরবনে ১০৬ থেকে বেড়ে বাঘের সংখ্যা ১১৪টিতে দাঁড়ায়। যা এবারের জরিপে ১২৫ টি হল।
প্রসঙ্গত: বাঘ বাংলাদেশের জাতীয় প্রাণী এবং সুন্দরবন বাংলাদেশে বাঘের শেষ আবাস্থল। আইইউসিএন কর্তৃক বাঘকে বাংলাদেশে অতি বিপন্ন প্রজাতির প্রাণী হিসেবে তালিকাভুক্ত করা হয়েছে। ২০১০ সালে ১৩টি টাইগার রেঞ্জ কান্ট্রির মধ্যে বর্তমানে ১০ টি দেশে অর্থাৎ বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল, ভূটান, রাশিয়া, চীন থাইল্যান্ড, মিয়ানমার, মালেশিয়া ও ইন্দোনেশিয়ায় বাঘ রয়েছে। অবশিষ্ট ৩টি দেশ অর্থাৎ ভিয়েতনাম, কম্বোডিয়া ও লাওসের বনাঞ্চল হতে বাঘ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। বিশ্বব্যাপী বর্তমানে বাঘের সংখ্যা মাত্র ৩৮৪০টি।
এম হাসান