নির্বাচন ভবন। ফাইল ছবি
অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে তৃতীয় দফা সংলাপে দ্রুত রাষ্ট্র সংস্কার করে নির্বাচন কমিশন (ইসি) পুনর্গঠন এবং নির্বাচনী রোডম্যাপ ঘোষণাকেই প্রাধান্য দিয়েছে দেশের অন্যতম প্রধান দল বিএনপি ও রাজনৈতিক অন্য দলগুলো। জবাবে অন্তবর্তী সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, নির্বাচনের প্রস্তুতি, নির্বাচন কমিশন গঠন ও সংস্কার একসঙ্গে এগিয়ে নেওয়া হবে, যাতে দ্রুত একটি নির্বাচন করা যায়। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যের ওপর নির্ভর করবে নির্বাচনের সময়। কারণ কতটুকু রিফর্ম লাগবে সেটা দেখার বিষয়।
তবে তৃতীয় দফা সংলাপেও নির্বাচন প্রশ্নে দুই যুগের জোটসঙ্গী বিএনপি ও জামায়াতের ‘দুই ধরণের অবস্থান’ ফুটে উঠেছে। বিএনপি দ্রুত নির্বাচন কমিশন গঠন করে নির্বাচনী রোডম্যাপ দাবি করলেও জামায়াত বলেছে, তারা সংস্কার ও নির্বাচনের দুটি রোডম্যাপ চান। কারণ সংস্কার ও নির্বাচন দুটিই গুরুত্বপূর্ণ।
নবগঠিত সংস্কার কমিশন ও দেশের সার্বিক পরিস্থিতি সামনে রেখে শনিবার দিনভর বিভিন্ন রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে আলোচনা করেছেন অন্তবর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা। বিএনপি, জামায়াত ছাড়াও সংলাপে অংশ নেওয়া অন্যান্য রাজনৈতিক দলগুলোর প্রস্তাবে সংস্কার ও নির্বাচনকেই প্রাধান্য দেওয়া হয়েছে। বৈঠকে অন্তবর্তী সরকারের পক্ষ থেকে রাজনৈতিক দলগুলোকে জানানো হয়েছে, সংস্কারের বিষয়ে রাজনৈতিক দলগুলো একটা ন্যুনতম ঐকমত্যে আসবে। ঐকমত্যের ওপর নির্ভর করবে টাইমলাইন (নির্বাচনের সময়)।
বিএনপিকে দিয়ে আলোচনা শুরু হয়।
এরপর একে একে জামায়াতে ইসলামী, গণতন্ত্র মঞ্চ, হেফাজতে ইসলাম, বাম গণতান্ত্রিক জোট, ইসলামী আন্দোলন, এবি পার্টি ও গণ অধিকার পরিষদের সঙ্গে সংলাপ হয়। সব মিলিয়ে পাঁচটি দল ও তিনটি জোটের সঙ্গে প্রথম দিনের আলোচনা অনুষ্ঠিত হয়। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ ও তার জোটসঙ্গীদের এই সংলাপের বাইরে রাখা হয়েছে। জাতীয় পার্টিকে এখন পর্যন্ত আমন্ত্রণ জানানো হয়নি। আগামী শনিবার আরও কয়েকটি দলকে সংলাপে ডাকা হতে পারে বলে জানা গেছে।
শনিবারের সংলাপে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে উপস্থিত ছিলেন উপদেষ্টা হাসান আরিফ, আদিলুর রহমান খান ও প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারি মাহফুজ আলম। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে প্রথম দিনের সংলাপ শেষে প্রধান উপদেষ্টার পক্ষে সংবাদ সম্মেলন করেন তাঁর প্রেস সচিব শফিকুল ইসলাম ও বিশেষ সহকারি মাহফুজ আলম। শফিকুল আলম বলেন, প্রধান উপদেষ্টা সংস্কারকাজের পাশাপাশি নির্বাচনের কার্যক্রম এগিয়ে নেবেন বলে দলগুলোর নেতাদের জানিয়েছেন।
নির্বাচনী রোডম্যাপ নিয়ে রাজনৈতিক দলগুলোর আলোচনার বিষয়ে এক প্রশ্নের জবাবে প্রধান উপদেষ্টার প্রেস সচিব বলেন, সংস্কারের জন্য গঠিত ছয়টি কমিশন রাজনৈতিক দল এবং বিভিন্ন অংশীজনের সঙ্গে কথা বলবেন। তিন মাসের মধ্যে তারা প্রতিবেদন দেবে। এরপর ওই প্রতিবেদন নিয়ে আবার অন্তবর্তী সরকার রাজনৈতিক দল ও সমাজের বিভিন্ন স্তরের লোকজনের সঙ্গে আলোচনা করবেন। রাজনৈতিক দলগুলোর সঙ্গে সংস্কারের বিষয়ে ঐকমত্যের ওপর নির্ভর করবে নির্বাচনের সময়। কারণ কতটুকু রিফর্ম লাগবে সেটা দেখার বিষয়।
জানা গেছে, বিএনপি দ্রুত নির্বাচন কমিশন গঠন করে নির্বাচনের রোডম্যাপ দাবি করলেও জামায়াতে ইসলামী বলেছে, ‘নির্বাচনের চেয়ে বেশি গুরুত্বপূর্ণ সংস্কার। সংলাপ শেষে বিএনপির প্রতিনিধি দলের নেতা ও মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর সাংবাদিকদেরকে বলেন, নির্বাচন কমিশন নিয়োগ স্থগিত করে প্রধান রাজনৈতিক দলের ঐক্যমতের ভিত্তিতে অনতিবিলম্বে নির্বাচন কমিশন গঠন করতে হবে। আমরা একটা রোডম্যাপ দিতে বলেছি। নির্বাচন কমিশন কবে নির্বাচন করবে সে ব্যাপারে একটা রোডম্যাপ দিতে বলেছি। জবাবে প্রধান উপদেষ্টা আমাদের বলেছেন, নির্বাচন অনুষ্ঠান তাঁদের এক নম্বর প্রায়োরিটি (অগ্রাধিকার)।
অন্যদিকে, আলোচনা শেষে জামায়াতে ইসলামীর অবস্থান তুলে ধরে দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, এই সরকার দেশ শাসনের জন্য আসেনি, দেশ শাসনের সুষ্ঠু পথ বিনির্মানের জন্য তারা এসেছে। তাদের কাজ হচ্ছে, গত তিন নির্বাচনে জাতি যা ‘বঞ্চিত হয়েছে একটা গ্রহণযোগ্য, সুষ্ঠু ও শান্তিপূর্ণ নির্বাচন উপহার দেওয়ার পরিবেশ তৈরি করা। এজন্য কিছু মৌলিক বিষয়ে তাদের সংস্কার করতেই হবে। কী কী বিষয়ে তারা সংস্কার করবেন আমরা সেই বিষয়ে কথা বলেছি।
খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, সংলাপে আগামী জাতীয় নির্বাচন, নির্বাচনকেন্দ্রিক সংস্কারসহ বেশ কয়েকটি সুনির্দিষ্ট বিষয়ে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে কথা বলেছে বিএনপি। তবে দলটির মূল চাওয়া ছিল কবে নাগাদ আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন হবে, তার একটা রোডম্যাপ। একই সঙ্গে বিএনপি নির্বাচনব্যবস্থা সংস্কার করে অনতিবিলম্বে নির্বাচন কমিশন গঠনের দাবি জানিয়েছে। দলটির নেতারা রাষ্ট্র সংস্কারের লক্ষ্যে তাঁদের ঘোষিত ৩১ দফা সংস্কারের আলোকে বলেছেন, ভোটে নির্বাচিত হলে তাঁরা এই সংস্কারগুলো করবেন।
বিএনপির প্রতিনিধি দল এক ঘন্টারও বেশি সময় ধরে প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনা করেন। সংলাপ শেষে বাইরে অপেক্ষমান সাংবাদিকদের কাছে আলোচনার মূল বিষয়বস্তু তুলে ধরে বলেন, আলোচনার প্রধান বিষয় হচ্ছে নির্বাচন সম্পর্কিত। কবে নির্বাচন হবে, সে বিষয়ে একটা রোডম্যাপ দিতে বলেছি। নির্বাচনের রোডম্যাপ ও সময়সীমা সম্পর্কিত এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘আমি মাস, দিন, কাল নিয়ে কথা বলব না। উনি (প্রধান উপদেষ্টা) আমাদের বলেছেন নির্বাচন অনুষ্ঠান তাঁদের এক নম্বর প্রায়োরিটি (অগ্রাধিকার)। বিষয়গুলো অত্যন্ত সহযোগিতার সঙ্গে তাঁরা দেখছেন। তাঁরা মনে করেন, আমাদের দাবিগুলো হচ্ছে জনগণের দাবি, আমাদের দাবিগুলো তাঁদেরও দাবি।’
অন্যদিকে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে আলোচনায় যৌক্তিক সময়ের মধ্যে সংস্কার চেয়ে নির্বাচনের পথে যাওয়ার পরামর্শ দিয়েছে জামায়াতে ইসলামী। এ জন্য জামায়াত অন্তবর্তী সরকারের কাছে সংস্কার ও নির্বাচন প্রশ্নে দুটি রোডম্যাপ চেয়েছে। দলটি মনে করে, একটা অবাধ, সুষ্ঠু ও গ্রহণযোগ্য নির্বাচনের জন্য সংস্কার খুবই গুরুত্বপূর্ণ। জামায়াত আগামী ৯ অক্টোবর সংস্কারের ব্যাপারে দলটি প্রস্তাব প্রকাশ করবে। দলটির আমির ডা. শফিকুর রহমান সাংবাদিকদের বলেন, অন্তবর্তী সরকারের কাছে দুটি রোডম্যাপ চেয়েছি। একটা সংস্কারের ও অন্যটি নির্বাচনের। সংস্কার ও নির্বাচন দুটিই গুরুত্বপূর্ণ।
জানা গেছে, বিএনপি ও জামায়াত ছাড়াও প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে সংলাপে রাজনৈতিক দল ও ছাত্র প্রতিনিধিদের নিয়ে জাতীয় রাজনৈতিক কাউন্সিল গঠনের প্রস্তাব করেছে গণতন্ত্র মঞ্চ। ছয়টি দলের এই জোটের অন্যতম নেতা
এবং নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না সংলাপ শেষে সাংবাদিকদের বলেন, সংস্কারের বিষয়ে সরকারের পক্ষ থেকে জানতে চাওয়া হয়। আমরা স্পষ্ট করে আমাদের মতামত দিয়েছি। আমরা বলেছি, সংস্কার আমাদের (রাজনৈতিক দল)। আমরা একটা সরকার বদলানোর আন্দোলন করছি না, নির্বাচনের জন্য আন্দোলন করছি না, সামগ্রিকভাবে আন্দোলন করছি, যাতে নির্বাচন ব্যবস্থা ও সংবিধান সংস্কারের প্রক্রিয়ায় একটা গণতান্ত্রিক রাষ্ট্র করা যায়। আবার যাতে ফ্যাসিবাদ ফিরে না আসে, সে কারণে সংস্কার প্রয়োজন।
অন্যদিকে, সংলাপে অংশ নেওয়া বাংলাদেশের কমিউনিস্ট পার্টিসহ বাম গণতান্ত্রিক জোট সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচনের লক্ষ্যে সংবিধান যতটুকু সংশোধন প্রয়োজন, ততটুকু সংশোধন করার উদ্যোগই যথার্থ বলে মনে করে। এ ব্যাপারে সংলাপ শেষে সিপিবির সাধারণ সম্পাদক রুহিন হোসেন প্রিন্স বলেন, সব সংস্কারের দায়িত্ব এই সরকারের না। বিভিন্ন সংস্কারে ছয়টি যে কমিশন করেছে তার জন্য ধন্যবাদ জানিয়ে বলেছি এর মধ্যে প্রধান হবে নির্বাচন ব্যবস্থার সংস্কার। সেটা আজ থেকে, রাজনৈতিক দলসহ বিভিন্ন ব্যক্তিবর্গের সঙ্গে কথা বলে পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করে নির্বাচন কবে হবে সেটার রোডম্যাপ ঘোষণা করতে হবে। তিনি বলেন, এ সরকারের এমন কোনো কাজ করা উচিত হবে না যা মানুষের মধ্যে তাকে প্রশ্নবিদ্ধ করে।
জানা গেছে, প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে ইসলামী আন্দোলন ছয় সংস্কার কমিশনের সঙ্গে আরও নয়টি কমিশন করার প্রস্তাব দিয়েছে। এগুলো হলো- আইন বিষয়ক সংস্কার কমিশন, নাগরিক সেবাবিষয়ক, শিক্ষাবিষয়ক, পররাষ্টবিষয়ক, স্বাস্থ্যবিষয়ক, বাকস্বাধীনতাবিষয়ক, শ্রমজীবীবিষয়ক, সংখ্যালঘু ও নৃগোষ্ঠীবিষয়ক এবং মহিলা ও শিশু বিষয়ক। অন্যদিকে, সংলাপে হেফাজতে ইসলাম মূলত সংগঠনের নেতাকর্মীদের বিরুদ্ধে বিভিন্ন সময়ে করা মামলা দ্রত প্রত্যাহারের কথা বলেছে।
কথা বলে জানা গেছে, তৃতীয় দফা সংলাপ শেষে রাজনৈতিক দলগুলোর দৃষ্টি এখন সংস্কার প্রশ্নে গঠিত ছয়টি সংস্কার কমিশনের দিকে। আগামী তিন মাসের মধ্যে কমিশনগুলো কী কী সংস্কার আনেন, সেগুলো আগামীতে রাজনৈতিকভাবে কার লাভ বা ক্ষতির সন্মুখীন হবে- এ নিয়েও বড় দলগুলোর মধ্যে আলোচনার কমতি নেই। ছয় কমিশনের সংস্কার প্রস্তাবগুলো বিশ্লেষণ করেই রাজনৈতিক দলগুলো পরবর্তী সিদ্ধান্ত নেবে- কথা বলে এমনটাই স্পষ্ট হয়েছে।
উত্তম/টুম্পা