সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল টি এম জোবায়ের।ছবি: সংগৃহীত
জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দা অধিদফতরের (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল টি এম জোবায়ের ও তার স্ত্রী ফাহামিনা মাসুদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা দিয়েছেন আদালত। রবিবার ঢাকা মহানগর দায়রা জজ আদালতের ভারপ্রাপ্ত বিচারক ফারজানা ইয়াসমিনের আদালত দুদকের আবেদনের প্রেক্ষিতে এ আদেশ দেন।
জানা যায়, বর্তমানে দুর্নীতি দমন কমিশন জাতীয় নিরাপত্তা গোয়েন্দার (এনএসআই) সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল টি এম জোবায়ের দুর্নীতির বিষয়ে তদন্ত করছে। তার বিরুদ্ধে অভিযোগ তিনি অবৈধ পথে অর্থ উপার্জনের মাধ্যমে দেশে-বিদেশে অঢেল সম্পদ গড়েছেন। ক্ষমতার অপব্যবহার করে লন্ডন, দুবাই, সিঙ্গাপুর ও তুরস্কে হাজার কোটি টাকা পাচার করেছেন টি এম জোবায়ের। সেখানে একাধিক ফ্ল্যাট, প্লট, বাড়ি, ব্যবসা প্রতিষ্ঠানও গড়েছেন। আর রাজধানীর অভিজাত এলাকাসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে কয়েক হাজার কোটি টাকা সম্পদও গড়েছেন। দেশে-বিদেশে বিভিন্ন ব্যাংকের জমা রয়েছে শত কোটি টাকা।
গত ২ সেপ্টেম্বর সাবেক এই সেনা কর্মকর্তার বিরুদ্ধে কমিশন অভিযোগে বিষয়ে প্রকাশ্যে দুদক অনুসন্ধান শুরু করেছে। কমিশন সভায় সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
তারই অংশ হিসাবে দুদকের উপপরিচালক মো. আনোয়ারুল হক রবিবার আদালতে তাদের দেশত্যাগে নিষেধাজ্ঞা চেয়ে আবেদন করেন। দুদকের পাবলিক প্রসিকিউটর মাহমুদ হোসেন জাহাঙ্গীর শুনানি করেন। শুনানি শেষে আদালত এ আদেশ দেন।
আবেদনে বলা হয়েছে, অভিযোগ সংশ্লিষ্ট মেজর জেনারেল টি এম জোবায়েরের বিরুদ্ধে মোটা অঙ্কের ঘুষ গ্রহণপূর্বক বিভিন্ন পদে চাকরি প্রদান ও ক্ষমতার অপব্যবহার করে বিভিন্ন ব্যক্তিকে প্রদর্শনপূর্বক কোটি কোটি টাকা উপার্জন করে নিজ নামে ও পরিবারের সদস্যদের নামে জ্ঞাত-আয়বহির্ভূত সম্পদ অর্জন এবং ২৯ লাখ ৪৫ হাজার পাউন্ডে লন্ডনে বাড়ি ক্রয়সহ বিদেশে অর্থ পাচারের অভিযোগটির অনুসন্ধান চলমান রয়েছে। অভিযোগ সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা দেশ ছেড়ে বিদেশে পলায়ন করতে পারেন বলে বিশ্বস্ত সূত্রে জানা যায়। অভিযোগের সুষ্ঠু অনুসন্ধানের স্বার্থে তাদের বিদেশ গমন রহিত করা একান্ত প্রয়োজন।
এর আগে গত ১১ আগস্ট সাবেক ডিজি জোবায়েরের বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ জমা পড়ে দুর্নীতি দমন কমিশনে (দুদক)। এতে জোবায়েরের বিরুদ্ধে সুনির্দিষ্ট আটটি অভিযোগ রয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে গত ১ সেপ্টেম্বর কমিশন অভিযোগ অনুসন্ধানের সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। পরেরদিন অভিযোগের বিষয়ে প্রকাশ্যে অনুসন্ধান শুরু হয়েছে বলে দুদক সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে।
দুদকের জনসংযোগ কর্মকর্তা উপ-পরিচালক ও জনসংযোগ কর্মকর্তা মোঃ আকতারুল ইসলাম জানান, সাবেক এনএসআই ডিজি টিএম জেবায়ের বিরুদ্ধে ক্ষমতা অপব্যবহারসহ নানা অনিয়মের অভিযোগ অনুসন্ধান শুরু করেছে দুদক। কমিশন সিদ্ধান্ত নেওয়ার পর অনুসন্ধান কর্মকর্তা নিয়োগ দেওয়া হয়েছে।
টিএম জোবায়েরকে ২০১৮ সালের ৩১ জুলাই এনএসআইয়ের মহাপরিচালক হিসেবে প্রেষণে নিয়োগ দেয় সরকার। প্রায় ৬ বছর এ পদে দায়িত্ব পালন শেষে গত ৩১ মার্চের এক আদেশে তাকে মাতৃ সংস্থা সেনাবাহিনীতে ফিরিয়ে নেওয়া হয়। সম্প্রতি তিনি সেনাবাহিনী থেকে অবসরে যান।
দেশে-বিদেশে যত সম্পদ \ দুদকের সূত্র জানায়, রাজধানীর গুলশান-২ এর ৮৪ নম্বর রোডে বিশাল আয়তনের সরকারি যে বাড়ি ৪৫ বছর ধরে এনএসআই কার্যালয় হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল। সেটি গণপূর্তের মাধ্যমে জালিয়াতি করে এক আত্মীয়ের নামে দলিল করে নেন। এখনও বাড়িটি তাদের দখলেই রয়েছে। গাজীপুরের শ্রীপুর রিসোর্ট ও সদরে বহুতল বাড়ি রয়েছে। ঢাকার উত্তরার ৭ নম্বর সেক্টরে নিজের ও বোনের নামে ফ্ল্যাট ও রাজলক্ষ্মী কমপ্লেক্সে ৩-৪টি দোকান কিনেছেন। নিজ এলাকা মাদারীপুরের কালকিনির রমজানপুরে নির্মাণ করেছেন বিলাসবহুল বাড়িসহ অঢেল সম্পদ গড়েছেন।
অভিযোগে বলা হয়, জোবায়ের রাজধানীর সেগুনবাগিচা ও ধানমন্ডিতে ফ্ল্যাট, সাভার ডিওএইচএসে ১০ তলা বাড়ি করেছেন। এছাড়া পূর্বাচল ও বসুন্ধরা আবাসিক এলাকায় প্লট রয়েছে।
সাবেক এই গোয়েন্দা প্রধান অবৈধ টাকায় রংপুর এবং ভোলায় বিস্তৃত ফসলি জমি, গাজীপুরের শ্রীপুরে রিসোর্ট, সদরে বহুতল বাড়ি, গ্রামের বাড়িতেও রয়েছে আলিশান বাড়ি। অঢেল সম্পদ গড়েছেন শ্বশুরবাড়ি এলাকায়ও।
জানা যায়, দেশের শীর্ষস্থানীয় ওই গোয়েন্দা সংস্থাটি সরাসরি প্রধানমন্ত্রীর তত্ত্বাবধায়নে পরিচালিত হয়। আওয়ামী লীগ আমলে জাতীয় নিরাপত্তার চেয়ে ক্ষমতা পাকাপোক্ত করার কাজেই এই সংস্থাকে বেশি ব্যবহার করা হয়েছে। জাতীয় ও স্থানীয় নির্বাচনে দলীয় মনোনয়ন থেকে শুরু করে দলীয় পদপদবি বণ্টনের ক্ষেত্রেও তথ্য সংগ্রহে এই সংস্থাকে ব্যবহার করা হয়েছে। ফলে তাদের রিপোর্টের ওপর বিভিন্ন পর্যায়ে দলীয় মনোনয়ন নির্ভরশীল ছিল। এ কারণে সংস্থার প্রধান হিসেবে প্রচণ্ড প্রভাবশালী ছিলেন জোবায়ের।
২০১৮ সালের জাতীয় নির্বাচনের সময় গোয়েন্দা প্রতিবেদনের নামে বিভিন্ন আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশীদের কাছ থেকে শত শত কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এ ছাড়া নির্বাচনী তহবিলের নামে বিভিন্ন ব্যবসায়ীর কাছ থেকে চাঁদাবাজি করেন। একই কাজ করেন ২০২৪-এর জাতীয় নির্বাচনের সময়ও। দুটি নির্বাচনের আগে জোবায়ের কয়েক হাজার কোটি টাকা হাতিয়ে নেন। এছাড়াও গোয়েন্দা সংস্থার অফিসের আসবাবপত্র কেনার জন্য প্রতি বছর সরকারের বরাদ্দ কোটি কোটি টাকা লুটপাট করেছেন। সংস্থার প্রধান কার্যালয়ের বহুতল ভবন নির্মাণে ঠিকাদারি প্রতিষ্ঠানের কাছ থেকে নেন মোটা অঙ্কের কমিশন। ২০২১ সালে একটি আবাসন কোম্পানির এমডির কাছ থেকে মোটা অঙ্কের চাঁদা নেন। এছাড়াও নিয়মিত মাসোয়ারা নিয়ে ওয়াসার এমডি তাকসিমসহ দেশের বিভিন্ন সমালোচিত ব্যক্তির গদি টিকিয়ে রাখতে নিয়মিত সুপারিশ করতেন প্রধানমন্ত্রীর দরবারে।
দুদকের তদন্ত সংশ্লিষ্টরা জানান, জুবায়ের দায়িত্বে থাকাকালে সংস্থাটিতে তিনবার জনবল নিয়োগ দেওয়া হয়। ২০২০, ২০২২ ও ২০২৩ সালের সেসব নিয়োগে বিপুল পরিমাণ অর্থ হাতান জোবায়ের। ডিজি থাকাকালে চাচাতো ভাই মোঃ জহির তদবির করে অন্তত ৫০ জনকে এনএসআই কর্মকর্তা পদে নিয়োগ দেন। বিনিময়ে তাদের কাছ থেকে ২০ লাখ টাকা করে নিয়েছেন। জোবায়েরের ভায়রা কাইয়ুম হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে স্বর্ণ চোরাচালান সিন্ডিকেটের সঙ্গে জড়িত ছিলেন বলেও জানা গেছে।
চার দেশে পাচারকৃত অর্থে একাধিক প্লট ও বাড়ি \ দুদক সূত্র জানায়, সাবেক মহাপরিচালক মেজর জেনারেল টি এম জোবায়ের পাচারকৃত অর্থে লন্ডনে একটি আলিশান বাড়ি কিনেছেন। বেক্সলি এলাকার হেথ কর্ফট ওয়াসান্ট সড়কের ৭ নম্বর বাড়িটি টি এম জোবায়ের, স্ত্রী এফ (ফাহমিদা) মাসুদ ও ছেলে মোহাম্মদ এস ইবনে জোবায়েরের নামে নিবন্ধন করা। শুধু লন্ডনের বাড়ির দামই ২৯ লাখ ৪৫ হাজার পাউন্ড (প্রায় ৪৬ কোটি টাকা)। তুরস্ক ও আরব আমিরাতের দুবাইতেও রয়েছে বিলাসবহুল বাড়ি।
নিয়াজ আহমেদ লাবু /টুম্পা