ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১

‘জাতীয় জলবায়ু অর্থায়নে ঝুঁকিভিত্তিক আঞ্চলিক ন্যায্যতা বিবেচিত হয়নি’

প্রকাশিত: ২০:১৬, ৫ অক্টোবর ২০২৪

‘জাতীয় জলবায়ু অর্থায়নে ঝুঁকিভিত্তিক আঞ্চলিক ন্যায্যতা বিবেচিত হয়নি’

স্টাডি শেয়ারিং সেমিনার।

দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে জলবায়ু অর্থ বরাদ্দকরণের ক্ষেত্রে পরিষ্কার অন্যায্যতা ও বৈষম্য বিদ্যমান বলে দাবি করেছে সেন্টার ফর পাটিসিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট (সিপিআরডি)। 

এক গবেষণার প্রেক্ষিতে সংস্থাটি বলছে, খরা প্রবণ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ট্রাস্ট ফান্ড থেকে মোট ১৪৩টি প্রকল্পবরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অথচ দেশের দুটি উপকূলীয় বিভাগ চট্টগ্রাম এবং বরিশাল বিভাগে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৮১টি প্রকল্প। অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাতীয় জলবায়ু বাজেট থেকে মাত্র ৬৩টি প্রকল্প চলমান আছে খরা প্রবণ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে। পাশাপাশি, গবেষণাটিতে দেখা গেছে যে বাংলাদেশের জলবায়ু বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে অবকাঠামো উন্নয়ন ও আকস্মিক দুর্যোগজনিত জলবায়ু ঝুঁকির উপর অধিকতর গুরুত্বারোপিত হয়েছে, অথচ ধীরলয়ের দুর্যোগ (বিশেষ করে খরা) এর ফলে সৃষ্ট ঝুঁকি মোকাবেলায় অর্থায়নের গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে কম প্রতিফলিত হয়েছে।  

শনিবার (৫ অক্টোবর) রাজধানীর একটি হোটেলে সেন্টার ফর পার্টি সিপেটরি রিসার্চ অ্যান্ড ডেভেলপমেন্ট-সিপিআরডি ‘স্টাডি শেয়ারিং সেমিনার’ এ এসব তথ্য তুলে ধরা হয়। এতে বলা হয়, দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে বসবাস করা প্রান্তিক মানুষ, আদিবাসী জনগোষ্ঠী ও জলবায়ু বিপদাপন্ন মানুষের উপর জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাতের স্বরূপ উন্মোচন, জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ড ও জাতীয় জলবায়ু বাজেট থেকে বরাদ্দকরণ পদ্ধতি, ন্যায্যতা, উপযুক্ততা, কার্যকারিতা নিরুপণের জন্য এই গবেষণা কার্যক্রমটি বাস্তবায়ন করা হয়। 

হেক্স/ইপিইআর- এর সহযোগিতায় পরিচালিত এ গবেষণাটির ‘মাঠপর্যবেক্ষণ’ অংশটি পরিচালনা করা হয় দেশের খরা প্রবণ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলের দিনাজপুর, ঠাকুরগাঁও, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, নওগাঁ, এবং কুড়িগ্রাম জেলায়। এছাড়া, জাতীয় জলবায়ু অর্থায়নের প্রকৃতি উন্মোচনের জন্য জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট ফান্ডের প্রতিষ্ঠালগ্ন থেকে শুরু করে ২০২২-২৩ অর্থবছর পর্যন্ত বাস্তবায়িত ও অনুমোদিত ৭৯০টি প্রকল্প এবং ২০২২-২৩ অর্থবছরের জাতীয় জলবায়ু বাজেট বিশ্লেষণ করে ২৬২টি জলবায়ু ও পরিবেশ সংশ্লিষ্ট প্রকল্প চিহ্নিত করা হয় এবং এ দুটি জাতীয় জলবায়ু অর্থায়ন কাঠামোর প্রকল্পগুলোকে বিশ্লেষণ করা হয়।

সিপিআরডি ও হেক্স/ইপিইআর কর্তৃক পরিচালিত গবেষণাটিতে দেখা যায়, দেশের উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে জলবায়ু অর্থ বরাদ্দকরণের ক্ষেত্রে পরিষ্কার অন্যায্যতা ও বৈষম্য বিদ্যমান। দেখা যায়, খরা প্রবণ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিমাঞ্চলে ট্রাস্ট ফান্ড থেকে মোট ১৪৩টি প্রকল্পবরাদ্দ দেওয়া হয়েছে। অথচ দেশের দুটি উপকূলীয় বিভাগ চট্টগ্রাম এবং বরিশাল বিভাগে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে ২৮১টি প্রকল্প। অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরে জাতীয় জলবায়ু বাজেট থেকে মাত্র ৬৩টি প্রকল্প চলমান আছে খরা প্রবণ উত্তর ও উত্তর-পশ্চিম অঞ্চলে। পাশাপাশি, গবেষণাটিতে দেখা গেছে যে বাংলাদেশের জলবায়ু বাজেট বরাদ্দের ক্ষেত্রে অবকাঠামো উন্নয়ন ও আকস্মিক দুর্যোগজনিত জলবায়ু ঝুঁকির উপর অধিকতর গুরুত্বারোপিত হয়েছে, অথচ ধীরলয়ের দুর্যোগ (বিশেষ করে খরা) এর ফলে সৃষ্ট ঝুঁকি মোকাবেলায় অর্থায়নের গুরুত্ব তুলনামূলকভাবে কম প্রতিফলিত হয়েছে।  

এছাড়া, ২০০৯-২০১০ অর্থবছর থেকে ২০২২-২৩ অর্থবছরের মোট বরাদ্দকৃত প্রকল্পের ৫০ শতাংশের বেশি বরাদ্দ করা হয়েছে অবকাঠামো উন্নয়নখাতে, যেগুলোর আর্থিক মূল্য ২০৯৫.৪১ কোটি টাকা। এছাড়া বরাদ্দকৃত প্রকল্পের যথাযথ মনিটরিং ও মাননিয়ন্ত্রণ করা হয়নি, ফলে এ প্রকল্প থেকে নির্মিত অবকাঠামো ঝুঁকি হ্রাসের পরিবর্তে নতুন ঝুঁকি তৈরি করছে। অন্যদিকে সমন্বিত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা থিমে বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে মাত্র ৭টি প্রকল্প, যার আর্থিক মূল্য মাত্র ৩২.২৪ কোটি টাকা। গবেষণাটিতে দেখা গেছে স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয় ট্রাস্ট ফান্ডের ৪৭৯টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে যার আর্থিক মূল্য ১৩৯৭.৬১ কোটি টাকা। এ প্রকল্পগুলোর বেশিরভাগই পৌরসভা, সিটি কর্পোরেশন ও জেলা পরিষদের মাধ্যমে পয়ঃনিষ্কাশন উন্নয়নে ব্যয় করা হয়েছে, যার  ঙ্গে জলবায়ু পরিবর্তনের ঝুঁকি মোকাবেলার সম্পর্ক দূরতম। অপরদিকে সবচেয়ে বেশি জলবায়ু ঝুঁকি মোকাবিলা করা কৃষি মন্ত্রণালয় এবং দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় যথাক্রমে পেয়েছে ২৩টি এবং ৯টি প্রকল্প। অন্যদিকে ২০২২-২৩ অর্থবছরেও জাতীয় জলবায়ু বাজেটের ৪২.২৮ শতাংশ প্রকল্প গেছে খাদ্য নিরাপত্তা, স্বাস্থ্য এবং সামাজিক নিরাপত্তা থিমে।

সেমিনারে গবেষণা ফলাফলের ব্যাখ্যা এবং প্রয়োজনীয় সংস্কার প্রস্তাবনা উপস্থাপন করেন সিপিআরডি’র প্রধান নির্বাহী মো: শামছুদ্দোহা। তিনি বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তন ট্রাস্ট আইন-২০১০-এর পদ্ধতিগত সংস্কার এবং জাতীয় জলবায়ু বাজেট থেকে প্রকল্প বরাদ্দকরণে এবং প্রকল্প নির্বাচনের ক্ষেত্রে ফলাফল-কেন্দ্রিক মানদ- নির্ধারণ করতে হবে। তিনি জলবায়ু বাজেট বরাদ্দ বৃদ্ধি এবং প্রয়োজনভিত্তিক ও ন্যায়সঙ্গত বরাদ্দ নিশ্চিত করার দাবি করেন। সমতল ভূমির আদিবাসী সম্প্রদায়ের জন্য একটি পৃথক/স্বতন্ত্র অভিযোজন পরিকল্পনা তৈরি এবং এটিকে এনএপি-এ অন্তর্ভুক্ত করার দাবি করেন। এছাড়া তিনি প্রতিটি জলবায়ু বিপন্ন এলাকার জন্য আলাদাভাবে বিপদাপন্নতা নিরূপণ সমীক্ষার দাবি করেন। সব লিঙ্গ-পরিচয়ের জন্য অন্তর্ভুক্তিমূলক জলবায়ু-লাগসই জীবিকা নিশ্চিত করার তাগিদ দেন। এছাড়া স্থানীয় সরকার কর্তৃপক্ষের সক্ষমতা বৃদ্ধি এবং এনডিসি বাস্তবায়নে বিভিন্ন কার্বণ নির্গমন সংকোচন পদ্ধতি উন্মোচনের উপর জোর দেন।

সেমিনারের ‘গেস্ট অব অনার’ হিসেবে সুইজারল্যান্ড দূতাবাসের ডেপুটি হেড অব মিশন/হেড অব কো-অপারেশন করিন হেনচোজ পিগনানি বলেন, অবকাঠামো উন্নয়ন অবশ্যই গুরুত্বপূর্ণ কিন্তু জলবায়ু পরিবর্তন মোকাবিলায় মানব কল্যাণ সবচেয়ে জরুরি বিষয়। 

তিনি আরো বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনের অভিঘাত মোকাবিলায় কোনো একক এবং সর্বব্যাপী সমাধান নেই। কাজেই আমাদের জীবনের ব্যবহারিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে পরিবর্তন আনতে হবে, একই সঙ্গে স্থানীয় বিভিন্ন সমাধান পরিকল্পনাকে গুরুত্বের সঙ্গে বিবেচনায় নিতে হবে। কেবলমাত্র ক্ষতিগ্রস্ত জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন পরিকল্পনায় অর্থবহ সম্পৃক্ততার মধ্য দিয়ে জলবায়ু ন্যায্যতা অর্জন করা সম্ভব, এবংস্থানীয় অভিযোজন পরিকল্পনার মাধ্যমে জলবায়ু-ঝুঁকিপূর্ণ অঞ্চলগুলো ঝুঁকিমুক্ত হতে পারে।’

এসময় পিকেএসএফ এর উপ-ব্যবস্থাপনা পরিচালক ড. ফজলে রাব্বি সাদেক আহমেদ বলেন, ‘জলবায়ু পরিবর্তনজনিত সংকট মোকাবেলা করতে হলে স্থানীয় প্রয়োজনীয়তার ভিত্তিতে বিদ্যমান সম্পদের সদ্ব্যবহার নিশ্চিত করতে হবে। এছাড়াও তিনি বলেন, আর্থসামাজিক অবস্থাগত বৈশিষ্ট্যের ভিত্তিতে জলবায়ু অভিযোজন পরিকল্পনা প্রণয়ন করতে হবে, যেটি জলবায়ু ঝুঁকিগ্রস্ত এলাকাগুলোতে ন্যায্যতার ভিত্তিতে বাস্তবায়িত হবে। একইসঙ্গে তিনি জলবায়ু অর্থায়নের কাক্সিক্ষত ফল নিশ্চিত করতে অর্থায়নকে সংশ্লিষ্ট সকল সেক্টরের সঙ্গে সমন্বিতকরণের উপর গুরুত্ব দেন।’

সাবেক সংসদ সদস্য রানা মোহাম্মদ সোহেল বলেন, ‘জলবায়ু অর্থায়নের ক্ষেত্রে প্রতিটি এলাকার সুনির্দিষ্ট কিছু প্রয়োজনীয়তাকে গুরুত্ব দিতে বলেন। জলবায়ু বাজেটের অধীনে প্রকল্প অনুমোদন নিশ্চিত করতে মাঠপর্যায়ে মানসম্মত প্রকল্প তৈরি করার জন্য স্থানীয় সরকার ও স্থানীয় প্রতিষ্ঠানগুলোর দক্ষতা উন্নয়নের গুরুত্ব অপরিসীম। প্রকল্প তৈরিতে তিনি সমন্বিত ও সমষ্টিগত পদ্ধতি অনুসরণের উপর গুরুত্বারোপ করেন। এছাড়াও তিনি জলবায়ু পরিবর্তনের গতিধারা, বিপদাপন্নতা, মানবগোষ্ঠীর সংশ্লিষ্টতা ও রাজনৈতিক অর্থব্যবস্থার মধ্যকার পারস্পরিক সংযুক্ততাকে যথাযথভাবে বিবেচনায় নিয়ে প্রকল্প নির্বাচনের মানদণ্ড সংবলিত ম্যাট্রিক্সকে সংশোধন ও পরিমার্জনের উপর বিশেষ গুরুত্ব দেন।’

সমাপনী বক্তব্যে এইচইকেএস/ইপিইআর এর কান্ট্রি ডিরেক্টর ডোরা চৌধুরী বলেন, ‘বিভিন্ন ক্ষেত্রে বাংলাদেশের শক্তিশালী ও সুন্দরনীতি কাঠামো আছে, কিন্তু প্রচ- কেন্দ্রীভূত ব্যবস্থা এবং টপ-ডাউন পরিকল্পনা পদ্ধতির কারণে এখনো জলবায়ু স্থিতিস্থাপকতা অর্জন অধরা থেকে গেছে। তিনি জাতীয় জলবায়ু বাজেট বরাদ্দ করণের ক্ষেত্রে প্রান্তিক এবং আদিবাসী সম্প্রদায়ের মানুষের প্রয়োজনীয়তার বিষয়গুলো আরও বেশি বিবেচনায় নেওয়া এবং ন্যায়সঙ্গত বরাদ্দের দাবি জানিয়েছেন।’

সেমিনারে সাবেক সংসদ সদস্য ব্যারিস্টার শামীম হায়দার পাটোয়ারী, পরিবেশ, বন ও জলবায়ু পরিবর্তন মন্ত্রণালয়ের অতিরিক্ত সচিব ইকবাল আব্দুল্লাহ হারুন, পরিবেশ অধিদপ্তরের এয়ার কোয়ালিটি ম্যানেজন্টের পরিচালক মো. জিয়াউল হকসহ আরো অনেকে বক্তব্য রাখেন।

 

স্বাপ্না//এম হাসান

×