ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ০৫ অক্টোবর ২০২৪, ২০ আশ্বিন ১৪৩১

ট্রাইব্যুনালে চেয়ারম্যানসহ শীঘ্রই অন্য বিচারক নিয়োগ করা হবে 

বিকাশ দত্ত 

প্রকাশিত: ১৮:১৯, ৫ অক্টোবর ২০২৪

ট্রাইব্যুনালে চেয়ারম্যানসহ শীঘ্রই অন্য বিচারক নিয়োগ করা হবে 

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠনের অপেক্ষায়। ট্রাইব্যুনাল পুনর্গঠন হলেই এখানে জুলাই আগষ্ট গণহত্যাকারীদের বিচার শুরু হবে। ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর তাজুল ইসলামসহ ৫ জনকে  প্রসিকিউশন সংস্থায় এবং পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত এডিশনাল ডিআইজি মো. মাজহারুল হকসহ ১০ জনকে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এখনও বিচারক নিয়োগ করা হয়নি। তবে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে শীঘ্রই ট্রাইব্যুনালে চেয়ারম্যান সহ অন্য বিচারক নিয়োগ করা হবে। 

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলন চলাকালে গত ৫ জুলাই থেকে ৫ আগস্ট পর্যন্ত সারাদেশে হত্যাকান্ডের ঘটনায় পলাতক সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মোট ৫৩টি পৃথক অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর (প্রশাসন) গাজী মোনাওয়ার হুসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, ‘আশা করছি আগামী সপ্তাহেই ট্রাইব্যুনাল পুণর্গঠন হতে পারে। অ্যাটর্নি জেনারেল বিদেশে অবস্থান করছেন। তিনি আসলেই ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান ও সদস্য নিয়োগ দেয়া হবে।’

তিনি বলেন, ‘এখন পর্যন্ত সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে মোট ৫৩টি পৃথক অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে। এর মধ্যে তদন্ত সংস্থায় ১৬টি আর প্রসিকিউশনে ৩৭টি অভিযোগ দায়ের করা হয়েছে।’ 

অন্যদিকে তদন্ত সংস্থার উপপরিচালক আতাউর রহমান জনকণ্ঠকে বলেছেন, ‘তদন্ত সংস্থার কাছে যে সমস্ত অভিযোগ এসেছে তা তদন্ত শুরু হয়েছে। অভিযোগ যাচাই বাছাই করে অভিযোগ প্রসিকিউশন শাখায় দাখিল করা হবে। ২০০৯ সাল থেকে ২০১৪ সালের মধ্যে গুম এবং ২০২৪ সালের গণহত্যায় জাড়িতদের ট্রাইব্যুনালের বিচারের মুখোমুখি করা হবে।’

এদিকে, আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইন সংশোধনের খসড়ায় দল নিষিদ্ধসহ ৮ প্রস্তাব করা হয়েছে। এতে বলা হয়েছে কোন রাজনৈতিক দল যদি এই আইনের অধীনে কোনো অপরাধ করে তা হলে সে দলকে ১০ বছর পর্যন্ত নিষিদ্ধ করার প্রস্তাব করা হয়েছে। এটিসহ আইনের পাঁচটি ধারা উপধারা সংযোজন এবং তিনটি ধারা সংশোধনের খসড়া প্রস্তাব উপস্থাপন করা হয়। গত ২৩ সেপ্টেম্বর আইন মন্ত্রনালয় এই মতবিনিময় সভার আয়োজন করে।  

২০১০ সালের ২৫ মার্চ পুরাতন হাইকোর্ট ভবনে স্থাপন করা হয় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল। মামলার কথা বিবেচনা করে ২০১২ সালে আন্তর্জাতিক  অপরাধ ট্রাইব্যুনাল-২ নামে আরও একটি ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হয়। পরবর্তীতে আসামিদের মামলার সংখ্যা কমে আসায় আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল -১ গঠন করা হয়। ২০১০ সাল থেকে বিচার শুরু হওয়ার পর এখনো ২৯টি মামলা বিচার প্রক্রিয়াধীন রয়েছে। এখন ট্রাইব্যুনালে নতুন যে সমস্ত অভিযোগ এসেছে তার বিচার হবে। সে জন্য দ্রুত  বিচারক নিয়োগের প্রয়োজন। 

তিন বিচারপতির সমন্বয়ে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠিত হয়ে থাকে। এর মধ্যে একজন চেয়ারম্যান অন্য দুই জন সদস্য। সংবিধানের ৯৫(১) ধারায় বলা হয়েছে, ‘প্রধান বিচারপতি রাষ্ট্রপতি কর্তৃক নিযুক্ত হইবেন এবং প্রধান বিচারপতির সঙ্গে পরামর্শ করে রাষ্ট্রপতি অন্যান্য বিচারপতিকে নিয়োগদান করবেন।’ ৯৫(২) অনুসারে, ‘কোনো ব্যক্তি বাংলাদেশের নাগরিক না হলে এবং (ক) সুপ্রিমকোর্টে অন্যূন ১০ বছর অ্যাডভোকেট না হয়ে থাকলে, বা (খ) বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় সীমানার মধ্যে অন্যূন ১০ বছর কোনো বিচার বিভাগীয় পদে অধিষ্ঠান না করে থাকলে, অথবা (গ) সুপ্রিমকোর্টের বিচারক পদে নিয়োগলাভের জন্য আইনের দ্বারা নির্ধারিত যোগ্যতা না থাকলে, তিনি বিচারপতি পদে নিয়োগলাভে যোগ্য হবেন না।’

মুক্তিযুদ্ধকালীন সংগঠিত মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের জন্য ২০১০ সালের ২৫ মার্চ আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল গঠন করে তৎকালীন আওয়ামী লীগ সরকার। মুক্তিযুদ্ধকালে মানবতাবিরোধী অপরাধের বিচারের আনুষ্ঠানিক প্রক্রিয়ার পর গত ১৪ বছরে ট্রাইব্যুনাল ৫৫টি মামলার রায় দিয়েছেন। 

১৯৭৩ সালে প্রণীত আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনাল আইনের অধীনেই জুলাই-আগস্ট গণহত্যার বিচারের উদ্যোগ নেয়া হয়েছে। ১৯৭৩ সালে প্রণীত আইনের ৩ (১) ধারায় বলা আছে, আইনের ২নং উপ-ধারায় উল্লিখিত যে কোনো অপরাধের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো ব্যক্তি বা গোষ্ঠী বা সংস্থা বা কোনো সশস্ত্র, প্রতিরক্ষা বা সহায়ক বাহিনীর কোনো সদস্যের জাতীয়তা যাই হোক না কেন, তা যদি এই আইন প্রবর্তনের আগে বা পরে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে সংঘটিত হয়, তবে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে তার বিচার এবং শাস্তি দেয়ার ক্ষমতা থাকবে।

২৩ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের আইন সংশোধনের সেমিনারে আইন ,বিচার ও সংসদ বিষয়ক উপদেষ্টা অধ্যাপক নজরুল ইসলাম বলেন, আমাদের কাজ এখন কোর্টটা রি- কনস্টিটিউট করা। আমাদের সক্ষমতা আছে বিচার করার।  আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রমকে সচল করার লক্ষ্যে ইতোমধ্যে প্রসিকিউশন ও ইনভেস্টিগেশন টিম গঠন করা হয়েছে। এখন আমাদের জন্য গুরুত্বপূর্ণ চ্যালেঞ্জ হচ্ছে বোর্ডকে (ট্রাইব্যুনাল) পুনর্গঠন করা। আমরা এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ (ট্রাইব্যুনাল) আইন, ১৯৭৩ সংস্কারের উদ্যোগ নিয়েছি। আমাদের সংস্কার কার্যক্রম এখানেই থেমে থাকবে না। যারা এ বিষয়ে বিশেষজ্ঞ, তাদের সবার মতামত নিয়ে আইন সংশোধন করা হবে।

প্রসিকিউশন সূত্রে জানা গেছে, জুলাই-আগষ্টের দেশব্যাপী গণহত্যার যে  সব অপরাধ হয়েছে ,সে গুলো মানবতাবিরোধী অপরাধ, সেগুলোর বিচার শুধু আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালেই হবে। বর্তমানে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে কোন বিচারক নেই। শিগগিরই ট্রাইব্যুনালে তিনজন বিচারক নিয়োগ হতে পারে। তিনজনের মধ্যে একজন চেয়ারম্যান, অপর দুজন ট্রাইব্যুনালের সদস্য। এ নিয়োগের পর শুরু হবে আনুষ্ঠানিক বিচার প্রক্রিয়া। ট্রাইব্যুনালের চেয়ারম্যান অবসরে গেলে সেখানে আর কাউকে নিয়োগ দেওয়া হয়নি। সদস্য বিচারপতি কেএম হাফিজুল আলম ট্রাইব্যুনাল থেকে হাইকোর্ট বিভাগে যুক্ত হয়েছেন। অপর সদস্য বিচারক এএইচএম হাবিবুর রহমান ভূঁইয়াকে অব্যাহতি দেওয়ায় ট্রাইব্যুনাল বিচারকশূন্য হয়ে পড়ে। বর্তমানে ট্রাইব্যুনালের  কার্যক্রম বন্ধ রয়েছে। 

গত ৭ সেপ্টেম্বর সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলামকে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের চিফ প্রসিকিউটর হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়। তাজুল ইসলাম ছাড়াও ট্রাইব্যুনালে আরও চার আইনজীবীকে প্রসিকিউটর পদে নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। এ সংক্রান্ত  প্রজ্ঞাপনে বলা হয়, অ্যাডভোকেট তাজুল ইসলাম অ্যাটর্নি জেনারেলের পদমর্যাদা, বেতন-ভাতা সুযোগ-সুবিধা ভোগ করবেন। বাকি চার প্রসিকিউটরের মধ্যে মো. মিজানুল ইসলাম অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল, গাজী মোনাওয়ার হুসাইন তামিম ও বিএম সুলতান মাহমুদ ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল এবং আব্দুল্লাহ আল নোমান সহকারী অ্যাটর্নি জেনারেলের সমমর্যাদা পাবেন। 

এরপর গত ১৮ সেপ্টেম্বর আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের তদন্ত সংস্থা পুনর্গঠন করা হয়েছে। তদন্ত সংস্থার কর্মকর্তারা হলেন- পুলিশের অবসরপ্রাপ্ত অ্যাডিশনাল ডিআইজি মো. মাজহারুল হক, অবসরপ্রাপ্ত পুলিশ সুপার মুহম্মদ শহিদুল্যাহ চৌধুরী, অ্যান্টি টেরোরিজম ইউনিট ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. আলমগীর, পিবিআই হেডকোয়ার্টার্স ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মোহা. মনিরুল ইসলাম, পুলিশের স্পেশাল ব্রাঞ্চ ঢাকার অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জানে আলম খান, পুলিশের ট্রাফিক অ্যান্ড ড্রাইভিং স্কুল ঢাকার সহকারী পুলিশ সুপার সৈয়দ আব্দুর রউফ, সিআইডি ঢাকা মেট্রোর পুলিশ পরিদর্শক মো. ইউনুস, চারঘাট মডেল থানা রাজশাহীর পুলিশ পরিদর্শক মো. মাসুদ পারভেজ, আরআরএফ ঢাকার পুলিশ পরিদর্শক মুহাম্মদ আলমগীর সরকার, সিআইডি ঢাকা মেট্রো (উত্তর) পুলিশ পরিদর্শক মো. মশিউর রহমান।

বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে হত্যা-গণহত্যার শিকার ও গুলিতে আহতদের পক্ষে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ দাখিল হচ্ছে। এসব অভিযোগে ছাত্র জনতার গণঅভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে পালিয়ে যাওয়া সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাসহ তার সরকারের বিভিন্ন পর্যায়ের ব্যক্তি ও আন্দোলনকারীদের ওপর হামলায় জড়িত আওয়ামী লীগ নেতা ও ক্যাডারদের আসামি করা হচ্ছে। আসামি উসকানিদাতা সাংবাদিকরাও। এমনকি জুলাই-আগস্টে গণহত্যার সরাসরি হুকুমদাতা হিসেবে আওয়ামী লীগ এবং ১৪ দলের শরিক রাজনৈতিক দলগুলোর নামেও আন্তর্জাতিক  অপরাধ ট্রাইব্যুনালে অভিযোগ করা হয়েছে। 

বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে সংঘটিত অভ্যুত্থানে পদত্যাগ করে গত ৫ আগস্ট দেশ থেকে পালিয়ে যান সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও আওয়ামী লীগ সভাপতি শেখ হাসিনা। এরপর নোবেলজয়ী অর্থনীতিবিদ ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে অন্তবর্তীকালীন  সরকার শপথ গ্রহণ করে।

 

এম হাসান

×