ঢাকা, বাংলাদেশ   শনিবার ২১ ডিসেম্বর ২০২৪, ৭ পৌষ ১৪৩১

দল ধর্ম গোষ্ঠীর ভিত্তিতে জাতিকে আর বিভক্ত হতে দেব না

স্টাফ রিপোর্টার, গাজীপুর

প্রকাশিত: ২৩:৪৮, ৪ অক্টোবর ২০২৪; আপডেট: ০৯:৪৭, ৫ অক্টোবর ২০২৪

দল ধর্ম গোষ্ঠীর ভিত্তিতে  জাতিকে আর  বিভক্ত হতে  দেব না

গাজীপুরে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শহীদদের পরিবারের সঙ্গে মতবিনিময় ও সুধী সমাবেশে বক্তব্য রাখেন জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান

বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামীর আমির ডা. শফিকুর রহমান বলেছেন, আমরা দল, ধর্ম ও গোষ্ঠীর ভিত্তিতে জাতিকে আর বিভক্ত হতে দেব না। জাতিকে ভাগ করার সুযোগ আর কাউকে দেব না। যত বিভাজন রেখা তৈরি করা হয়েছিল তা আমরা পায়ের নিচে ফেলে দিয়েছি। আমরা বৈষম্যহীন ও শোষণমুক্ত একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে চাই। জনগণের টাকায় কেনা বুলেট জনগণের বুকে ছোড়ার দুঃসাহস করবে এমন সন্ত্রাসী সরকার আমরা আর দেখতে চাই না। এ জন্য ১৮ কোটি মানুষের ৩৬ কোটি হাতকে এক করতে হবে। বিশ্বকে জানান দিতে হবে দেশ ও জাতির স্বার্থে আমাদের মধ্যে কোনো বিভাজন নাই। আমরা মধ্যপ্রাচ্যকে জানিয়ে দিতে চাই, তোমরা অতীতে যা করেছ এ জাতি আর তোমাদের তা করতে দেবে না। আমরা জানিয়ে দেব এখন থেকে বাংলাদেশের মানুষ কালোকে কালো এবং সাদাকে সাদা বলবে। আমরা চাই এমন একটা দেশ হবে, যে দেশে কোনো বৈষম্য থাকবে না।

তিনি বলেন, ক্ষমতায় বসে দেশের মালিক বনে গেলে কি পরিণতি হয় তা আমরা দেখেছি। জাতির সঙ্গে গাদ্দারি করলে যে পরিণতি হয় তা দেখে আমাদের সবাইকে শিক্ষা নিতে হবে। অতীত থেকে যদি শিক্ষা গ্রহণ করি তাহলে আগামীতে আর কোনো স্বৈরাচারের জন্ম হবে না। জাতিকে তারাই ভাগ করে যারা জাতির দুশমন। কে কোন ধর্ম পালন করবে কিংবা কোন দল করবে সেটা তার নিজের পছন্দ। কিন্তু দেশের ও জনগণের স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। দেশে ও বিদেশে জানান দিতে হবে যে, দেশ এবং জাতির স্বার্থে আমাদের মাঝে কোনো বিভাজন নেই। এ রকম একটা ঐক্যবদ্ধ জাতিকে কেউ আর দমিয়ে রাখতে পারবে না।

জামায়াতে আমির আরও বলেন, আমরা আদালতে ন্যায়ভ্রষ্ট বিচারক আর দেখতে চাই না। আমরা কোনো শপথবদ্ধ রাজনীতিবিদকে আদালতের বিচারক হতে দেখতে চাই না। কোনো দুর্বৃত্তকে আদালতের চেয়ারে দেখতে চাই না। নীতি নৈতিকতা ও বাস্তবতার ভিত্তিতে বিচার করবে, সেই রকম বিচারক দেখতে চাই। একজন সরকারি কর্মকর্তা রাষ্ট্রের সেবক, তিনি দল, গোষ্ঠী বা ব্যক্তির সেবক না। আমরা এমন কোনো কর্মকর্তা-কর্মচারী আগামীতে দেখতে চাই না যাদেরকে বাধ্য করা হবে রাষ্ট্র ও জনগণ বাদ দিয়ে গোষ্ঠীর পূজা করার জন্য।

আমাদের এমন একটা সমাজ প্রয়োজন যে সমাজে শিক্ষিত মানুষগুলো কলমের খোঁচায় হাজার হাজার কোটি টাকা জাতির কাছ থেকে লুটপাট করবে না। যারা এতদিন অন্যায়ভাবে মানুষকে হত্যা করেছে, অন্যায় অবিচার করেছে, জনগণের অর্থ সম্পদ লুট করেছে তাদেরও ন্যায় বিচার চাই। তাদের বিচার অবশ্যই হতে হবে। যাদের ফাঁসি হওয়া উচিত তাদের ফাঁসি হতে হবে। আর যাদের যাবজ্জীবন জেল হওয়া উচিত তাদের জেল এবং যারা খালাস হওয়ার তাদের খালাস হতে হবে। আমরা সকল অন্যায় অবিচারের শাস্তি হোক সেটাই চাই। এমন একটা দেশ আমাদের সকলের কামনা। সেই দেশটা আমাদেরই গড়তে হবে, ইনশাআল্লাহ। বাংলাদেশে জামায়াতে ইসলামী প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।

তিনি শুক্রবার গাজীপুর শহরের ভাওয়াল রাজবাড়ী মাঠে বৈষম্যবিরোধী ছাত্র- জনতার আন্দোলনে শহীদদের পরিবারের সঙ্গে মতবিনিময় ও সুধী সমাবেশে প্রধান অতিথির বক্তৃতাকালে এসব কথা বলেন। গাজীপুর মহানগর জামায়াতে ইসলামীর আমির অধ্যাপক মোহাম্মদ জামাল উদ্দীনের সভাপতিত্বে ও মহানগর সেক্রেটারি আবু সাঈদ মোহাম্মদ ফারুকের সঞ্চালনায় সমাবেশে বিশেষ অতিথি হিসেবে বক্তব্য রাখেন জামায়াতের কেন্দ্রীয় নির্বাহী পরিষদ সদস্য অধ্যক্ষ মুহাম্মদ ইজ্জত উল্লাহ, জামায়াতের ঢাকা উত্তর অঞ্চল টিম সদস্য ও গাজীপুর জেলার সাবেক আমির আবুল হাসেম খান, কেন্দ্রীয় কর্মপরিষদ সদস্য ড. খলিলুর রহমান মাদানী, গাজীপুর জেলা জামায়াতের আমির ড. জাহাঙ্গীর আলম, গাজীপুর মহানগর জামায়াতের নায়েবে আমির মো. খায়রুল হাসান, মহানগর জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি মো. হোসেন আলী, মো. আফজাল হোসেন, শিবিরের সাবেক সভাপতি ও গাজীপুর মহানগর জামায়াতের প্রচার সম্পাদক সালাহ উদ্দিন আইউবী, শিবিরের গাজীপুর মহানগর সভাপতি মো. আবু হানিফ প্রমুখ।

প্রধান অতিথির বক্তব্যে তিনি বলেন, গত সাড়ে ১৫ বছর ইতিহাসের বর্বরতম নির্যাতন চালানো হয়েছে জামায়াতে ইসলামীর ওপর। বিচারের নামে জামায়াতে ইসলামীর সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী ও আলী আহসান মোজাহিদসহ ১১ জন শীর্ষ নেতাকে হত্যা করা হয়েছে। কুরআনের পাখি আল্লামা দেলওয়ার হোসাইন সাঈদীর মর্মান্তিক মৃত্যু কোনো অবস্থাতেই মেনে নেওয়া যায় না। জুলুম করে এসব বিচারিক হত্যাকা- ঘটানো হয়েছে। আমরা শুধু আমাদের নেতা কর্মীদের হত্যার বিচার নয় সকল দলের ও নিরীহ মানুষের হত্যার বিচার দেখতে চাই। যারা হত্যার সঙ্গে জড়িত ছিল, যারা এসব হত্যার পরিকল্পনাকারী, মাস্টারমাইন্ড, হত্যা বাস্তবায়নকারী, আদালতে বসে যারা দুষ্ট রায় দিয়েছেন, মিথ্যা সাক্ষী দিয়েছেন, তদন্ত করতে গিয়ে যারা নাটক সাজিয়েছেন এবং বিভিন্নভাবে সহযোগিতা করেছেন তাদের কেউ যেন সেই অপরাধ থেকে রেহাই না পায়, তাদেরও বিচার করতে হবে। তারা গোটা জাতিকে হত্যা করতে চেয়েছিল। বিডিআর বিদ্রোহের নামে সেনাবাহিনীর ৫৭ জন চৌকস দেশ প্রেমিক অফিসারদের ক্ষমতায় আসার মাত্র দুই মাসের মাথায় নির্মমভাবে হত্যা করা হয়েছে। বিডিআর বাহিনীকে ধ্বংস করা হয়েছে। নিরীহ মানুষ যারা জেলে বন্দি আছে আমরা তাদের সবার মুক্তি চাই।

জামায়াতের আমির বলেন, আমরা বলেছিলাম আমরা প্রতিশোধ নেব না, আইন হাতে তুলে নেব না, আমরা আমাদের কথা রেখেছি। আমাদের সহকর্মীরা চরম ধৈর্য ধারণ করেছেন। ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বরে আলেম ওলামাদের সঙ্গে কি আচরণটা করা হয়েছে তা সবাই জানেন। রাতের অন্ধকারে চতুর্দিকে আলো নিভিয়ে তারা ব্রাশ ফায়ার করে কতজনকে যে হত্যা করেছে তা আল্লাহ ভালো জানেন। তাদের লাশটিও পাওয়া যায়নি। দুষ্ট সরকারের কয়েক মন্ত্রী ২৪ এর পতনের মাত্র চারদিন আগে বলেছেন বাড়াবাড়ি করবেন না, ২০১৩ সালের ৫ মে শাপলা চত্বর ভুলে যাবেন না। ওইদিন রাত ১২টার পর আমরা সব কয়টাকে সাফ করে দিয়েছি। এবারেও সাফ করে দেব।

শহীদ পরিবারের উদ্দেশে তিনি বলেন, ’২৪ এর আন্দোলনে শহীদ ও আহতরা আমাদের অহংকার। তাদের প্রাপ্য মর্যাদা আমাদের দিতে হবে। এই শহীদরা জাতির সম্পদ, ইজ্জতের চূড়ান্ত সীমায় আমরা তাদের রাখতে চাই, দেখতে চাই। আন্দোলনে শহীদদের আমরা দলীয় কোনো পরিচয়ে দেখতে চাই না। সকল শহীদ ও আহত ভাইয়েরা আমাদের সকলের আপনজন। তাদের পরিবারের দায়িত্ব সরকারকে নিতে হবে। যারা শহীদ হয়েছেন তারা চাকরি পাওয়ার জন্য বা কারও সহযোগিতার জন্য লড়াই করেন নাই। তারা আমাদের অহংকার, মর্যাদার এবং সম্মানের পাত্র। তারা জাতিকে সম্মানিত করার জন্য নিঃস্বার্থ লড়াই করেছে। তারা দেশের জন্য করেছে। এখন আমাদের উচিত তাদের জন্য কিছু করা। জাতির দায়িত্ব তাদের পরিবারকে সম্মানিত করা। এটা করতে হবে, এর বিকল্প নেই। সরকারের কাছে দাবি জানাব তাদের সঠিক স্বীকৃতিটা যেন দেওয়া হয়। প্রতিটা শহীদ পরিবার থেকে কমপক্ষে একজনকে সম্মানজনক সরকারি চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। লড়াই করে যারা আহত হয়েছেন, পঙ্গু হয়েছেন তাদেরও চাকরির ব্যবস্থা করতে হবে। তারা যেন আজীবন কারও করুণার পাত্র হয়ে না থাকে। তিনি আগামীতে দেশ গঠনে আপামর জনতার সহযোগিতা চেয়ে নেতাকর্মী ও দেশবাসীকে প্রত্যেক শহীদ এবং আহত পরিবারের পাশে দাঁড়ানোর আহ্বান জানান।

তিনি বলেন, আমরা এমন একটি সমাজ চাই যেখানে ব্যবসায়ীরা নির্ভয়ে তাদের ব্যবসা করবে কিন্তু কোন দুর্বৃত্ত তাদের কাছে চাঁদা চাইবে না। যদি তাই হয় তাহলে বাজারে ৩০ টাকার পেঁয়াজ আর ৩০০ টাকা হবে না। সামাজিক নিরাপত্তা এমন হবে যে, সমাজের প্রতিটা নাগরিক নিরাপদে তার ঘরে ঘুমাতে পারবে। স্বাস্থ্য সেবাসহ প্রতিটা শিশু তার প্রাপ্য সব অধিকার যাতে রাষ্ট্রের কাছ থেকে পায় সেই রকম একটি রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করতে হবে।

তিনি বলেন, আমাদের দেশে মতলববাজরা মালিক এবং শ্রমিকের মধ্যে সংঘর্ষ বাঁধিয়ে রাখে। উদ্যেক্তা এবং মালিক যদি না থাকে শ্রমিকরা কোথায় কাজ করবে। শিল্প যদি না বাঁচে কর্মসংস্থান কোথায় হবে। আমরা চাই ব্যবসায়ীরা তার জায়গায় বসে ব্যবসা করুক, কোন দুর্বৃত্তের সাহস হবে না তার কাছে চাঁদা চাওয়ার। বাজারে স্বস্তি থাকবে, সহনীয় দ্রব্যমূল্য থাকবে, যাতে প্রতিটি মানুষ তার সামর্থ্য অনুযায়ী স্বস্তির সঙ্গে বসবাস করতে পারে। সামাজিক নিরাপত্তা এমন হবে, সে ঘরের মধ্যে দরজা খোলা বা বন্ধ হোক রাতের বেলা শান্তিতে ঘুমাবে, কোনো দুর্বৃত্ত তার সম্পদ বা ইজ্জত লুটে নেওয়ার সাহস করবে না। আমরা এমন একটা সমাজ চাই।

অনুষ্ঠানে জামায়াতের আমির বৈষম্যবিরোধী আন্দোলনে শহীদ ও আহত পরিবারের খোঁজখবর নেন। এ সময় ২৬ জন শহীদ পরিবারের সদস্যদের হাতে ২ লাখ টাকা করে মোট ৫২ লাখ টাকা আর্থিক অনুদান প্রদান করেন। এর আগে সকাল থেকে জামায়াতের আমিরের আগমন ঘিরে জেলা ও মহানগরের বিভিন্ন স্থান থেকে নেতাকর্মী ও সমর্থকরা মিছিল নিয়ে রাজবাড়ী মাঠে উপস্থিত হন।

×