.
পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে নতুন জোটের কৌশল নিয়েছে এই মুুহূর্তে দেশের রাজনীতিতে সবচেয়ে আলোচিত সংগঠন বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী। আগামী জাতীয় সংসদ নির্বাচন ঘিরে ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে হচ্ছে এ জোট। এরই মধ্যে সাংগঠনিক তৎপরতা জোরদারের পাশাপাশি অন্যদের তুলনায় এগিয়ে থাকার কৌশলেই ইসলামী মহাজোট করার পরিকল্পনা নিয়ে মাঠে নেমেছে সংগঠনটি। দলটির প্রধান ডা. শফিকুল ইসলাম রাজধানীসহ দেশজুড়ে সফর নিয়ে ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছেন। এমন অবস্থায় কৌতূহলী প্রশ্ন- তবে কি জামায়াত তার দীর্ঘদিনের পুরনো মিত্র বিএনপিকে ছাড়াই নতুন জোট করে ক্ষমতায় যাবার দৌড়ে এগিয়ে থাকার কৌশল নিয়েছে। তবে কি আগামী নির্বাচনে জেতার টার্গেট নিয়েই ইসলামী মহাজোট গড়ার মিশনে সক্রিয় জামায়াতে ইসলামী! এমন প্রশ্নই এখন রাজনৈতিক অঙ্গনে ঘুরপাক খাচ্ছে।
জানতে চাইলে জামায়াতের একজন শীর্ষ নেতা বলেছেন, ‘আমরা এখন সাংগঠনিক কাজে ব্যস্ত। দল গোছানোর পাশাপাশি দেশের মানুষের দীর্ঘদিনের প্রত্যাশা পূরণে সংস্কারের মতো কঠিন কাজগুলো সম্পন্ন করায় বিশ্বাসী। একটা যৌক্তিক সময়ে নির্বাচন হলে তখন আসবে জোট-মহাজোটের প্রশ্ন।
দলটির ভেতরের একাধিক বিশ্বস্ত সূত্র নিশ্চিত করেছে, ঠিক এই মুহূর্তে জামায়াতে ইসলামী জোট গঠনের ঘোষণা দিয়ে কোনো তৎপরতা শুরু করেনি। তবে ইসলামী মূল্যবোধ ও আদর্শে বিশ্বাসী দলগুলোর সঙ্গে মতবিনিময়, সৌজন্য সাক্ষাৎ ও চিন্তা-চেতনা নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছে, যা একটা যৌক্তিক পরিণতির দিকে যাবে। ইসলামী দলগুলোকে নিয়ে একটা প্ল্যাটফর্ম গড়ে তোলার বিষয়ে দলটির নেতাকর্মীদের একটা ইতিবাচক ভাবনা রয়েছে। এমন ভাবধারা থেকে দলটি ইতোমধ্যে বেশ কটি ইসলামী সংগঠনের সঙ্গে আলোচনা ও বৈঠক করেছে। এর মধ্যে চরমোনাই পীরের ইসলামী আন্দোলন, ১২ দলীয় জোট, জাকের পার্টি, খেলাফত মজলিশ ও ফরায়েজী আন্দোলন উল্লেখযোগ্য। এছাড়া খেলাফত মজলিশের মহাসচিব মাওলানা মামুনুল হক, হেফাজতে ইসলামের যুগ্ম মহাসচিব আজিজুল হক ইসলামাবাদী, বাংলাদেশ নেজামে ইসলাম পার্টির জ্যেষ্ঠ নায়েবে আমির আব্দুল মাজেদ আতাহারী, বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলনের আমির আবু জাফর কাসেমী, জামিয়া মাদানিয়ার মুহতামিম মনিরুজ্জামান কাসেমী, জনসেবা আন্দোলনের আমির ফখরুল ইসলামসহ ব্যক্তি পর্যায়ে বিভিন্ন মাদ্রাসার শিক্ষক ও আলেমদের সঙ্গে জামায়াতের আমির পৃথক মতবিনিময় করেন। গত ১৫ আগস্ট থেকে বিভিন্ন রাজনৈতিক দল ও সংগঠনের সঙ্গে বৈঠক শুরু করে সংগঠনটি।
জানা গেছে, দেশে এখন ১১টি ইসলামপন্থি দল নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত। এর মধ্যে জামায়াতে ইসলামীর নিবন্ধনের বিষয়টি আদালতের সিদ্ধান্তে আটকে আছে। ২০১৩ সালে হাইকোর্ট এ নিবন্ধন বাতিল করেছিল। বিগত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর হঠাৎ আলোর ঝলকানির মতো উদ্ভাসিত হয় জামায়াতে ইসলামী। সেই থেকেই দলটি এখনো দেশীয় রাজনীতির কেন্দ্রবিন্দুতে। পরিবর্তিত পরিস্থিতিতে এখন জামায়াতে ইসলামীই সবার নজরকাড়া রাজনীতি করছে। প্রতিদিনই দলটির আমির ও অন্যান্য নেতা কোথাও না কোথাও সাংগঠনিক কর্মকান্ডে সক্রিয়। তাদের অনুসারী ইসলামী ছোটবড় দলগুলোও একই চিন্তা ও মানসিকতায় আগামী নির্বাচনে অংশ নিয়ে ভালো ফলাফলের প্রত্যাশী।
জানা গেছে, এখন পর্যন্ত জামায়াতে ইসলামী বেশ কটি ইসলামী দলের সঙ্গে আলোচনা করেছে। আগামীতে আরও বেশ কটি ইসলামী দলের সঙ্গে মত ও কুশল বিনিময়ের কর্মসূচি রয়েছে। যথাদ্রুত সময়ে আগামী নির্বাচন নিয়ে বিএনপি আগ্রহী হলেও জামায়াত এক্ষেত্রে অনেকটাই ধীরগতির কৌশল অবলম্বন করেছে। বিএনপি সারাদেশের মাঠপর্যায়ে ব্যাপক আধিপত্য প্রতিষ্ঠায় মরিয়া হলেও জামায়াত ব্যস্ত সাংগঠনিক শক্তি ও সমমনা দলগুলোর সঙ্গে বিশেষ জোট গড়া নিয়ে। দলটির মাঠ পর্যায় থেকে কেন্দ্রীয় নেতাদের দৃঢ় বিশ^াস, ইসলামী বড় জোট নিয়ে নির্বাচনে গেলে ফল তাদের অনুকূলেই যাবে।
জানতে চাইলে জামায়াতের মুখপাত্র মতিউর রহমান আকন্দ বলেছেন, আলোচনা ও বৈঠক রাজনীতির স্বাভাবিক গতি। নির্বাচন সামনে রেখে এ ধরনের জোট গড়ার বিষয়ে আলোচনা হতে পারে।
এ বিষয়ে একটি ইসলামী দলের প্রধান জানিয়েছেন, আগামী নির্বাচনের আগেই নির্বাচন কমিশনে নিবন্ধিত দলগুলোকে এক মঞ্চে আনা বা এক জায়গায় নিয়ে আসাই এবারের উদ্যোগের মূল লক্ষ্য বলে তাদের কাছে মনে হয়েছে। ইতোমধ্যেই ইসলামী শাসনতন্ত্র আন্দোলন, লেবার পার্টি, ১২ দলীয় জোট, ইসলামী আন্দোলনসহ কয়েকটি দল এবং কয়েকজন ইসলামী ব্যক্তিত্বের সঙ্গে মতবিনিময় করেছেন জামায়াতের নেতারা। আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিল এমন কয়েকটি ইসলামী দলকে বাদ দিয়ে বাকিদের নিয়ে একত্রিত হওয়ার বিষয়টি আলাপ-আলোচনা করছেন তারা। পুরো বিষয়টি নির্ভর করবে সামনে নির্বাচন প্রক্রিয়া কেমন হয় তার ওপর। তবে ইসলামী সংগঠনগুলোর প্রত্যাশা নির্বাচনী জোট। আবার কওমি মাদ্রাসাভিত্তিক সংগঠন হেফাজতে ইসলাম নিজেদের অরাজনৈতিক সংগঠন দাবি করলেও সংগঠনটির নেতাদের অনেকেই বিভিন্ন ধর্মভিত্তিক দলের সঙ্গে সম্পৃক্ত।
নির্বাচনী জোট সম্পর্কে জানতে চাইলে জামায়াতবিরোধী একটি ইসলামী সংগঠনের নেতা বলেন, সামনের দিনে নির্বাচন কীভাবে হয়, সেটার ওপর নির্ভর করছে জোট-মহাজোটের বিষয়টি। আওয়ামী লীগ যদি নির্বাচনে অংশ নেয়, তাহলে হবে এক প্রকার পরিস্থিতি, আর যদি নির্বাচনে আওয়ামী লীগ বাইরে থাকে, সেক্ষেত্রে জামায়াতে ইসলামীর জোট কৌশল হবে অন্যরকম। কেননা জামায়াতের বাইরে সমমনা ইসলামী দলসমূহ নামে ছয়টি দলের একটি জোট আছে। এই জোটের শরিক দলগুলো হলো জমিয়তে উলামায়ে ইসলাম, বাংলাদেশ খেলাফত মজলিশ (মামুনুল হক), মুসলিম লীগ (আবুল খায়ের), খেলাফত মজলিশ (আহমদ আবদুল কাদের), বাংলাদেশ খেলাফত আন্দোলন ও ইসলামী ঐক্য আন্দোলন। এর মধ্যে ইসলামী ঐক্য আন্দোলন নির্বাচনে বিশ্বাস করে না। আর খেলাফত আন্দোলন জোটের অবস্থানের বাইরে গিয়ে শেখ হাসিনার সরকারের অধীন ২০২৪ সালের সংসদ নির্বাচনে অংশ নেয়। ইসলামী ঐক্য আন্দোলন ও খেলাফত আন্দোলন ছাড়া বর্তমানে তাদের জোটে চারটি দল সক্রিয় আছে। তারা জামায়াতসহ ইসলামী দলগুলোর সমন্বয়ে একটি নির্বাচনী ঐক্য গড়ার চেষ্টা করছে। এ দুটো জোট আবার ইসলামী মহাজোট গড়ার বিষয়েও ইতিবাচক বলে জানা গেছে।
এ বিষয়ে হেফাজতের নেতা আজিজুল হক ইসলামাবাদী বলেছেন, দলগুলোর মধ্যে আলোচনা এখনো প্রাথমিক পর্যায়ে আছে। আলোচনা পর্যালোচনা করে দেখা হচ্ছে। দেখা যাক কী হয়। এখনো বলার মতো কোনো পর্যায়ে আসেনি। একই ধরনের কথা বলেছেন খেলাফত মজলিশের মহাসচিব আহমদ আব্দুল কাদের। তিনি বলেন, আলোচনার প্রক্রিয়ায় আমরা আছি। তবে চূড়ান্ত কিছু হয়নি।
এদিকে জামায়াতে ইসলামের পুরনো মিত্র বিএনপির সঙ্গে আগের মতো আর নির্বাচনী ঐক্যের সম্ভাবনা একেবারেই ক্ষীণ বলে জানিয়েছে দলটির একটি সূত্র। এমনকি বিএনপির মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর একাধিক বক্তব্যে জামায়াতে ইসলামীর সঙ্গে বিএনপির কোনো জোট নেই বলে উল্লেখ করেছেন। ২০২২ সালের ডিসেম্বরে ২০-দলীয় জোট ভেঙে দেওয়ার পর থেকে জামায়াতের সঙ্গে দূরত্ব বজায় রেখে চলেছে বিএনপি। তবে ২০-দলীয় জোটের দলগুলোকে নিয়ে যুগপৎ আন্দোলন করলেও জামায়াতের সঙ্গে প্রকাশ্যে আর সম্পর্ক গড়েনি। তবে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের এক দফা দাবিতে গত ২৬ জুলাই বিএনপির মহাসচিব জামায়াতে ইসলামীসহ সব ইসলামী রাজনৈতিক দল এবং সংগঠনের প্রতি জাতীয় ঐক্যের যে আহ্বান জানিয়েছিলেন, তাতে দল দুটির মধ্যে যোগাযোগ বৃদ্ধি পায়। জামায়াত বিবৃতি দিয়ে বিএনপির আহ্বানে সাড়া দেয়। কিন্তু বিগত ৫ আগস্টের পটপরিবর্তনের পর সেই উষ্ণ সম্পর্ক আর চোখে পড়েনি। বরং তাদের পরস্পরবিরোধী বক্তৃতা বিবৃতি রাজনৈতিক অঙ্গনে নতুন কৌতূহল সৃষ্টি করেছে।
উল্লেখ্য, আওয়ামী লীগ সরকারের শেষ পর্যায়ে এসে জামায়াতে ইসলামীকে নিষিদ্ধ করা হয়। এর আগে স্বাধীনতার পরপরই একবার নিষিদ্ধ করা হয়েছিল দলটিকে। পরে সংবিধান সংশোধন করে ধর্মভিত্তিক রাজনীতি করার সুযোগ দেওয়া হয়েছিল ১৯৭৮ সালে। সেই সুযোগ নিয়ে তখন নিষিদ্ধ ইসলামপন্থি কটি দল রাজনীতি শুরু করেছিল। ২০০১ সালের নির্বাচনে বিএনপির সঙ্গে জোটবদ্ধ হয়ে সরকারের অংশ হয়েছিল জামায়াত। গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার বিদায়ের তিন সপ্তাহের মাথায় অন্তর্বর্তী সরকার সেই নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে নেয়। তারপর হঠাৎ উল্কা বেগে জামায়াতে ইসলামী রাজনৈতিক আলোচনা-সমালোচনার শীর্ষে উঠে যায়।
জানা গেছে, বিরাজমান পরিস্থিতিতে দেশের ছোট বড় সব ইসলামী দলকে নিয়ে বড় জোট গড়লে আওয়ামী লীগ ও বিএনপির সঙ্গে ত্রিমুখী নির্বাচনী লড়াইয়ের সম্ভাবনা যথেষ্ট উজ্জ্বল বলে মনে করেন ইসলামী আন্দোলনের জ্যেষ্ঠ যুগ্ম মহাসচিব গাজী আতাউর রহমান। তিনি বলেন, আমরা ইসলামী দলগুলোর মধ্যে রাজনৈতিক জোট করার চেয়ে নির্বাচনী ঐক্য নিয়েই ভাবছি। এ লক্ষ্যে অনানুষ্ঠানিক আলোচনা চলছে। জামায়াতে ইসলামীকে বাদ দিয়ে ইসলামী দলগুলোর নির্বাচনী ঐক্য শক্তিশালী হবে না। আমরা থানা ও জেলার নেতাদের মতামত নেব। আমরা মাঠের মনোভাবকে শ্রদ্ধা জানাব। এবার উদার মনে আমাদের সবাইকে এগিয়ে আসতে হবে।