সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে বাড়ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা
সময়ের সঙ্গে পাল্লা দিয়ে দেশে বাড়ছে বিদ্যুৎ ও জ্বালানির চাহিদা। বিগত সরকারের আমলে চাহিদা পূরণে অনেকটাই আমদানিনির্ভর হয়ে পড়ে খাতটি। সাম্প্রতিক সময়ে চাহিদা ক্রমবর্ধমান থাকায় এখনই আমদানি বন্ধ না করতে পারলেও দেশের অভ্যন্তরে থাকা কূপগুলো খনন ও অনুসন্ধানে ব্যাপক পরিকল্পনা নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার। ২০২৫ সাল থেকে ২০২৮ সাল পর্যন্ত দেশে অন্তত ১০০টি কূপ অনুসন্ধান, উন্নয়ন ও ওয়ার্কওভারের বড় পরিকল্পনার কথা জানিয়েছে জ্বালানি বিভাগ। এমনকি এ সময়ের মধ্যেই প্রকল্পগুলোর কাজ সমাধানেরও তাগিদ দিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান।
জ্বালানি বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, আগামী তিন বছরে দেশের বিভিন্ন স্থানে ৬৯টি কূপের অনুসন্ধান ও উন্নয়ন কার্যক্রম পরিচালনা করা হবে। একইসঙ্গে ৩১টি কূপের ওয়ার্কওভার সম্পন্ন হবে। এরমধ্যে বাংলাদেশ পেট্রোলিয়াম এক্সপ্লোরেশন অ্যান্ড প্রোডাকশন কোম্পানি লিমিটেড (বাপেক্স) ১০টি, সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড (এসজিএফএল) দুটি ও বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ড কোম্পানি লিমিটেড তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়িত করবে।
এর বাইরেও বাপেক্সের নিজস্ব রিগ দিয়ে ২৮টি, বিজিএফসিএলের রিগ দিয়ে দুটি, এসজিএফএলের রিগ দিয়ে তিনটিসহ মোট ৩৩টি কূপ খনন হবে। আর বাপেক্সের মাধ্যমে রিগ ভাড়া করে দশটি কূপে চলবে খনন কাজ। আর আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে বাপেক্স ১৪টি, বিজিএফসিএল সাতটি, এসজিএফএল পাঁচটি কূপ খনন করবে। সব মিলিয়ে ৬৯টি কূপের খনন হবে।
কূপগুলো ওয়ার্কওভার কার্যক্রমে বাপেক্সের রিগ দিয়ে হবে ১৬টি, বিজিএফসিএলের রিগ দিয়ে ১২টি, এসজিএফএল দিয়ে তিনটিসহ মোট ৩১টি কূপের ওয়ার্কওভার হবে। জ্বালানি বিভাগ বলছে, ২০২৬ সালের ডিসেম্বর থেকে ২০২৮ সালের অক্টোবর পর্যন্ত তিতাস ফিল্ডে পাঁচটি কূপের মূল্যায়ন কাম উন্নয়ন কূপ খনন করা হবে বাপেক্সে এবং আউট সোর্সিংয়ের মাধ্যমে। ২০২৭ সালের মার্চ থেকে ২০২৮ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত হবিগঞ্জ, বাখরাবাদ ও মেঘনা গ্যাস ফিল্ডে চারটি অনুসন্ধান কূপ খনন করা হবে একইভাবে।
২০২৬ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৮ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত দোয়ারাবাজারে একটি মূল্যায়ন কাম উন্নয়ন কূপ, বিয়ানীবাজার-৩ এ একটি মূল্যায়ন কাম অনুসন্ধান কূপ এবং বিয়ানীবাজারে তিনটি কূপের খনন হবে।
একইভাবে ২০২৭ সালের এপ্রিল থেকে ২০২৮ সালের এপ্রিল পর্যন্ত কৈলাশটিলা-১০, রশিদপুর-১৪ ও ডুপিটিলা-২ খনন করা হবে। এর বাইরে ২০২৬ সালের জানুয়ারি থেকে একই বছরের নভেম্বর পর্যন্ত বেগমগঞ্জ-৫, বেগমগঞ্জ-৬, সুনেত্র-২ খনন করা হবে। একই এলাকায় ২০২৬ সালের জুলাই থেকে ২০২৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত সুবর্ণচর-১, নোয়াখালী-১, মতলব-১, সুন্দলপুর-৫ নামের চারটি কূপের খনন কাজ চলবে। সেমুতাং-৭, সেমুতাং-৮, চর লক্ষ্যা-১, মানিকগঞ্জ-১, মোবারকপুর সাউথ ইস্ট-১ নামের পাঁচটি কূপ খনন হবে ২০২৬ সালের জুন থেকে ২০২৭ সালের সেপ্টেম্বর পর্যন্ত। ২০২৬ সালের জুলাই থেকে ২০২৭ সালের জুলাই পর্যন্ত শাহবাজপুর-১, ভোলা নর্থ-৫, শাহবাজপুর-৬ ও শাহবাজপুর-৮ কূপগুলো খনন করা হবে।
এছাড়াও এই তিন বছরে কাসালং-১, পটিয়া-২, সীতাপাহাড়-৩, জলদি-৪, ফেঞ্চুগঞ্জ নর্থ-১, মদন-১, ধর্মপুর-১, বেগমগঞ্জ-৭, উড়িরচর-২, সন্দীপ সাউথ-১, সন্দীপ নর্থ-১, মোবারকপুর সাউথ, ওয়েস্ট-১, বালিগাঁও-১, দোয়ারাবাজার ইস্ট-১, দোয়ারাবাজার ওয়েস্ট-১, শাহবাজাপুর-১০, শাহবাজপুর-১১, শাহবাজপুর-১৩, শাহবাজপুর সাউথ-১, আলিমাবাদ-১, শাহবাজপুর নর্থ-১, ভোলা ওয়েস্ট-১, শাহবাজপুর নর্থ ওয়েস্ট-১, শেরপুর-১, কোম্পানীগঞ্জ-১, সুনেত্র ইস্ট-১, ঘাটাইল-১, বিশ্বনাথ-১, মদন-২, জামালপুর-২, ফেঞ্চুগঞ্জ সাউথ-২, ডাকাতিয়া-১, নোয়াখালী-২, সুবর্ণচর-২, সুবর্ণচর-৩, মতলব-২, মতলব-৩ নামের কূপগুলো খনন করা হবে।
এছাড়াও, ২০২৫ সালের সেপ্টেম্বর থেকে ২০২৬ সালের ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত তিতাস-১৩, তিতাস-১৫, তিতাস-২২ কূপের ওয়ার্কওভারের কাজ চালানো হবে। এরপর নানা সময়ে বাখরাবাদ-২, বাখরাবাদ-১০, বাখরাবাদ-৩, তিতাস-১৭, তিতাস-১৮, তিতাস-২৫, তিতাস-২০, তিতাস-২৩, তিতাস-২৬, কৈলাশটিলা-৭, রশিদপুর-৭, সিলেট-৯, রূপগঞ্জ-১, হালদা-১, সেমুতাং-৬, শ্রীকাইল-৪, ফেঞ্চুগঞ্জ-৪, ফেঞ্চুগঞ্জ-৩, শ্রীকাইল ইস্ট-১, শ্রীকাইল-২, বেগমগঞ্জ-৩, শাহবাজপুর-৩, শাহবাজপুর-১, শাহবাজপুর ইস্ট-১, শাহবাজপুর-২, শ্রীকাইল-৪, ফেঞ্চুগঞ্জ-৩, ফেঞ্চুগঞ্জ-৪ কূপগুলোর ওয়ার্কওভার করা হবে।
এসব বিষয় নিয়ে বৃহস্পতিবার এক সংবাদ সম্মেলনে বিদ্যুৎ, জ্বালানি ও খনিজসম্পদ উপদেষ্টা মুহাম্মদ ফাওজুল কবির খান বলেন, চলমান জ্বালানি সংকট নিরসনেই গ্যাস অনুসন্ধান কার্যক্রমে এই জোরদার পরিকল্পনা গ্রহণ করা হয়েছে। তিনি বলেন, গ্যাসের রিজার্ভ কমে আসার কারণে জ্বালানি সংকট তৈরি হচ্ছে। ফলে ব্যয়বহুল এলএনজি (তরলীকৃত প্রাকৃতিক গ্যাস) আমদানি করতে বাধ্য হচ্ছে সরকার। তাই বর্তমান সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে গ্যাসের অনুসন্ধান কার্যক্রম আরও জোরদার করার।
২০২৫ সাল পর্যন্ত ৫০টি কূপ খননের পরিকল্পনা রয়েছে জানিয়ে তিনি বলেন, ইতোমধ্যে ১৫টি খনন করা হয়েছে এবং সেখান থেকে প্রতিদিন ১৭৬ মিলিয়ন ঘনফুট উত্তোলনযোগ্য গ্যাস মিলেছে। তবে পাইপলাইন না থাকায় জাতীয় গ্রিডে এখন ৭৬ মিলিয়ন ঘনফুট দেওয়া হচ্ছে। শুধু তাই নয়, ২০২৫ সালের মধ্যে আরও ৩৫টি কূপ খনন করা হবে। এরমধ্যে ১১টি কূপ খনন করবে বাপেক্স, বাকি ২৪টি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে কাজ দেওয়া হবে বলেও জানান তিনি।
এছাড়াও ২০২৮ সালের মধ্যে আরও ১০০টি কূপ খনন করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে তিনি বলেন, স্থলভাগের ৬৯টি কূপে অনুসন্ধান কার্যক্রম চালানো হবে। এরমধ্যে ৩৩টি কূপে অনুসন্ধান করবে বাপেক্স। আরও ১০টি রিগ ভাড়ার মাধ্যমে অনুসন্ধান করা হবে। বাকি ২৬টি উন্মুক্ত দরপত্রের মাধ্যমে করা হবে। ফলে গ্যাস সংকট অনেকটাই কেটে যাবে। এখন থেকে কোনো প্রকল্পের সময় ও অর্থ আর বাড়ানো হবে না বলেও জানান তিনি।
এর আগে গণ-অভ্যুত্থানে পতন হওয়া আওয়ামী লীগ সরকার ৪৬টি কূপ ২০২২-২৫ সালের মধ্যে নতুন করে খনন, ওয়ার্কওভারের কথা জানিয়েছিল। একটা সময় গ্যাস সংকট তীব্র হওয়ায় সময় কমিয়ে ক্রাশ প্রোগ্রামের মাধ্যমে চলতি বছরের মধ্যেই এগুলোর কাজ শেষ করার কথা জানিয়েছিলেন তৎকালীন বিদ্যুৎ, জ্ব¡ালানি ও খনিজ সম্পদ প্রতিমন্ত্রী নসরুল হামিদ। এর মাধ্যমে দৈনিক অন্তত ৬১৮ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উত্তেলানেরও লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল।
জ্বালানি বিভাগ বলছে, বর্তমানে কাতার থেকে বার্ষিক ১.৮ থেকে ২.৫ মিলিয়ন টন এলএনজি আমদানির চুক্তি রয়েছে বাংলাদেশের। ২০১৭ সাল থেকে ১৫ বছর মেয়াদি চুক্তির আওতায় কাতার থেকে এলএনজি আমদানি করে আসছে বাংলাদেশ। কাতারের রাশ লাফান লিক্যুফাইড ন্যাচারাল গ্যাস কোম্পানি লিমিটেডের সঙ্গে ওই চুক্তির আওতায় বার্ষিক ১.৮ থেকে ২.৫ মিলিয়ন টন এলএনজি পাচ্ছে বাংলাদেশ।
বাপেক্স বলছে, বর্তমানে দেশে বাপেক্স দৈনিক ১৪৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করছে। এছাড়া বাংলাদেশ গ্যাস ফিল্ডস কোম্পানি লিমিটেড (বিজিএফসিএল) উৎপাদন করছে ৬১৬ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। আর সিলেট গ্যাস ফিল্ডস লিমিটেড উৎপাদন করছে ১০৪ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস। সব মিলিয়ে এই তিন কোম্পানি দৈনিক মোট ৮৬৩ মিলিয়ন ঘনফুট গ্যাস উৎপাদন করছে। আর বাকিটা বেসরকারি প্রতিষ্ঠান শেভরন আর আমদানি করা এলএনজি।