ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ০৪ অক্টোবর ২০২৪, ১৯ আশ্বিন ১৪৩১

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণের উদ্যোগ

ভোজ্যতেল ও চিনির আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার হচ্ছে

এম শাহজাহান

প্রকাশিত: ২২:৩৯, ৩ অক্টোবর ২০২৪

ভোজ্যতেল ও চিনির আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার হচ্ছে

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ভোজ্যতেল ও চিনির আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার

দ্রব্যমূল্য নিয়ন্ত্রণে ভোজ্যতেল ও চিনির আমদানি শুল্ক প্রত্যাহার করা হতে পারে। ইতোমধ্যে পেঁয়াজ ও আলুর  আমদানি শুল্ক কমিয়ে বাজারে স্বস্তি ফিরিয়ে আনার উদ্যোগ নেয় অন্তর্বর্তী সরকার। তবে আমদানি শুল্ক কমানো হলেও বাজারে এ দুটি পণ্যের দাম তেমন কমেনি। অন্যদিকে আন্তর্জাতিক বাজারে বাড়তে শুরু করেছে ভোজ্যতেল ও চিনির দাম। এ অবস্থায় দেশে যাতে এ দুটো নিত্যপণ্যের দাম সহনীয় পর্যায়ে থাকে সে লক্ষ্যে আমদানি শুল্ক কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে। সম্প্রতি বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের (বিটিটিসি) এক বৈঠকে ভোজ্যতেল ও চিনির আমদানি শুল্ক কমানোর ব্যাপারে তাদের ইতিবাচক মনোভাব পোষণ করে।

শীঘ্রই এ সংক্রান্ত একটি সুপারিশ বিটিটিসি থেকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে প্রেরণ করা হবে। এর পরই ভোজ্যতেল ও চিনির আমদানি শুল্ক কমানোর ব্যাপারে জাতীয় রাজস্ব বোর্ডকে (এনবিআর) চিঠি দিবে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়। সংশ্লিষ্ট সূত্রে এ তথ্য জানা গেছে। 
এদিকে, আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়া এবং আমদানি কম হওয়ার কারণে বাজারে এখন ভোজ্যতেল ও চিনির দাম বাড়তির দিকে রয়েছে।

সরকারি বাজার নিয়ন্ত্রণকারী সংস্থা টিসিবির তথ্যমতে, গত এক সপ্তায় পামঅওয়েল সুপার খোলা প্রতি লিটারে মানভেদে ৫-৮ টাকা দাম বেড়ে বিক্রি হচ্ছে ১৪৫-১৫০ টাকায়, পামঅওয়েল খোলা প্রতি লিটারে ২ টাকা বেড়ে ১৩৭-১৪২ এবং খোলা সয়াবিন প্রতি লিটারে ৩ টাকা বেড়ে ১৫১-১৫৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে খুচরা বাজারে। এ ছাড়া সয়াবিন এক লিটারের বোতল ১৬৫-১৬৭ এবং প্রতিটি পাঁচ লিটারের ক্যান ৮১০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে। এ ছাড়া সংস্থাটির তথ্যমতে, প্রতি কেজি খোলা চিনি ১২৮-১৩৫ টাকায় বিক্রি হচ্ছে।

যদিও খুচরা বাজারে খোলা চিনি প্রতি কেজি ১৪০ এবং প্যাকেট চিনি ১৫০ টাকায় বিক্রি হচ্ছে বলে জানিয়েছেন বিক্রেতারা। মৌলভী বাজারের পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, ভোজ্যতেল ও চিনির দাম বাড়ার খবর সত্য। ইতোমধ্যে আন্তর্জাতিক বাজারে দাম বেড়ে যাওয়ার কারণে অভ্যন্তরীণ বাজারে এর প্রভাব পড়েছে। এ প্রসঙ্গে মৌলভী বাজার ব্যবসায়ী সমিতির সাবেক সাধারণ সম্পাদক হাজী মোহাম্মদ আলী ভুট্টো জনকণ্ঠকে বলেন, বহির্বিশ্বে দাম বাড়ায় দেশে চিনি ও ভোজ্যতেলের দাম বাড়তে শুরু করেছে।

এ ছাড়া আগে এস আলম গ্রুপ নিজেদের স্বার্থে বড় ধরনের সিন্ডিকেট তৈরি করে বাজার নিয়ন্ত্রণ করত। কিন্তু তাদের এখন কোনো কার্যক্রম ও আমদানি নেই। ফলে সাপ্লাই চেইনে কিছুটা ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। এ অবস্থায় সরবরাহ ঠিক রাখতে নতুন উদ্যোক্তারা আমদানি কার্যক্রম শুরু করেছেন। আমদানিকৃত এসব পণ্য আসা শুরু হলে ভোজ্যতেল ও চিনির দাম কমে আসবে বলে আশা করা হচ্ছে। অন্যদিকে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলছেন, ভোজ্যতেল ও চিনির দাম স্বাভাবিক রাখার বিষয়ে বিটিটিসি ইতোমধ্যে একটি বৈঠক করেছে।

তাদের সুপারিশ পাওয়ার পর এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণ করবে সরকার। তবে তিনি জানান, ভোজ্যতেল ও চিনির আমদানি শুল্ক কমানোর ব্যাপারে আমদানিকারক ব্যবসায়ীদের দাবি রয়েছে। যদি শুল্ক কমিয়ে দাম নিয়ন্ত্রণ করা যায় তবে ভোক্তা স্বার্থে সেই উদ্যোগ নেওয়া হবে। ইতোমধ্যে পেঁয়াজ ও আলুর আমদানি শুল্ক কমিয়ে দাম কমানোর উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। তথ্যমতে, দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা প্রতি বছর বাড়ছে। মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নত ও আয় বেড়ে যাওয়ায় ভোক্তাদের খাদ্যাভ্যাসে পরিবর্তন এসেছে। খাদ্যে ভোজ্যতেল ও চিনির ব্যবহার বেড়েছে।

কয়েকটি নির্ভরযোগ্য তথ্যমতে, প্রতি বছর দেশে ভোজ্যতেলের চাহিদা রয়েছে ৩০ লাখ টন এবং ২৪ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। তবে ট্যারিফ কমিশনের তথ্যমতে, বছরে ২০ লাখ টন ভোজ্যতেল ও সাড়ে ১৭ লাখ টন চিনির চাহিদা রয়েছে। চাহিদা মেটাতে ৯০ শতাংশ ভোজ্যতেল ও চিনি আমদানি করা হয়ে থাকে। আমদানির পরিমাণ দিন দিন বাড়ছে। বছরে ২০ লাখ টন চাহিদার চিনি আমদানিতে বর্তমানে পাঁচ ধরনের শুল্ক-কর রয়েছে। প্রতি টন অপরিশোধিত চিনিতে আগে আমদানি শুল্ক ছিল নির্ধারিত তিন হাজার টাকা।

গত নভেম্বরে তা কমিয়ে অর্ধেক অর্থাৎ ১ হাজার ৫০০ টাকা করা হয়। এর বাইরে অপরিশোধিত চিনি আমদানিতে ১৫ শতাংশ ভ্যাট, ২ শতাংশ অগ্রিম আয়কর (এআইটি), ৩ শতাংশ অগ্রিম কর (এটি) এবং ৩০ শতাংশ নিয়ন্ত্রণমূলক শুল্ক (আরডি) রয়েছে। এ ছাড়া পরিশোধিত চিনিতে বর্তমানে আমদানি শুল্ক নির্ধারিত তিন হাজার টাকা, ভ্যাট ১৫ শতাংশ, এআইটি ৫ শতাংশ, এটি ৫ শতাংশ এবং আরডি রয়েছে ৩০ শতাংশ। ভোজ্যতেলের মূল্য স্থিতিশীল রাখতে সয়াবিন ও পাম  তেলের ওপর ২০২২ ও ২০২৩ সাল জুড়ে কয়েক দফায় ভ্যাট ছাড় দিয়েছে সরকার। সর্বশেষ ভ্যাট ছাড় সুবিধা ছিল গত বছরের ৩০ এপ্রিল পর্যন্ত। আমদানি পর্যায়ে শুধু ৫ শতাংশ ভ্যাট ছিল। এরপর বাণিজ্য মন্ত্রণালয় গত বছরের ৩০ জুন পর্যন্ত ছাড় সুবিধা বহাল রাখার অনুরোধ জানালেও এনবিআর আর তা মানেনি। এর ফলে বর্তমানে ভ্যাট ১৫ শতাংশই রয়েছে।
এদিকে আলু ও পেঁয়াজের দাম কমাতে গত ৫ সেপ্টেম্বর নিত্যপ্রয়োজনীয় এ দুই পণ্যের আমদানি শুল্ক কমায় অন্তর্বর্তী সরকার। এর প্রভাবে গত প্রায় এক মাসে দেশের বাজারে আলু ও পেঁয়াজের দাম কিছুটা কমেছে। এ সময়ে প্রতি কেজি আলুর দাম ১ দশমিক ৭৯ শতাংশ ও আমদানি করা পেঁয়াজের দাম ১১ দশমিক ৬৩ শতাংশ কমেছে বলে বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশনের এক প্রতিবেদনে উঠে এসেছে।

সম্প্রতি তৈরি করা ট্যারিফ কমিশনের প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, আন্তর্জাতিক বাজারে আলু ও পেঁয়াজের দাম গত এক মাসে বেশ খানিকটা  বেড়েছে। তা সত্ত্বেও  দেশের বাজারে এসব পণ্যের দাম বাড়েনি, বরং কিছুটা কমেছে। আমদানি শুল্ক কমানোর কারণে দেশের বাজারে আলু ও পেঁয়াজের দাম কমেছে বলে মনে করে ট্যারিফ কমিশন। 
এ ছাড়া দেশে বিরাজমান উচ্চ মূল্যস্ফীতির কারণে অনেক দিন ধরেই চাপে রয়েছেন সাধারণ মানুষ। গত আগস্ট মাসে দেশে খাদ্য মূল্যস্ফীতি ছিল ১১ দশমিক ৩৬ শতাংশ। জুলাই মাসে খাদ্য মূল্যস্ফীতি আরও বেশি ছিল। তবে এখন মূল্যস্ফীতি কিছুটা কমেছে বলে জানিয়েছে পরিসংখ্যান ব্যুরো বিবিএস। বাজারে চাল, ডিম, চিনি, বিভিন্ন ধরনের ফল, ভোজ্যতেল ও জ্বালানি তেলের দাম এখনো বেশ চড়া। এসব পণ্যের অনেকগুলো আমদানি করে চাহিদা মেটাতে হয়। তাই বাজার বিশেষজ্ঞরা মনে করেন, আলু-পেঁয়াজের মতো আরও কিছু নিত্যপণ্যে শুল্ক কমানো হলে সেগুলোর দাম কমে আসতে পারে।

এতে করে ভোক্তারা স্বস্তি পাবেন। ভোক্তা সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিরা বলছেন, নতুন সরকার ক্ষমতায় আসার পর প্রথম দুই সপ্তাহ নিত্যপণ্যের দাম কিছুটা কমিয়েছিলেন ব্যবসায়ীরা। কিন্তু সময় পার হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ী সিন্ডিকেট নিজেদের রং পরিবর্তন করে আগের মতোই দাপিয়ে  বেড়াচ্ছে। অথচ সরকারের পক্ষ থেকে কার্যকর পদক্ষেপ নেওয়া হচ্ছে না। এ প্রসঙ্গে কনজ্যুমারস অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশের (ক্যাব) সহসভাপতি এসএম নাজের হোসাইন বলেন, বাজারে সিন্ডিকেট চলমান। ব্যবসায়ীরা এখন নতুন রূপে আসছেন। এদের নিয়ন্ত্রণে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে।

×