ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ০৩ অক্টোবর ২০২৪, ১৭ আশ্বিন ১৪৩১

সাগর-রুনি হত্যা রহস্য ॥ তদন্তের দায়িত্ব থেকে র‌্যাবকে সরিয়ে পাঠানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে

এবার জট খুলবে?

ফজলুর রহমান

প্রকাশিত: ২২:৪৭, ২ অক্টোবর ২০২৪

এবার জট খুলবে?

সাগর-রুনি হত্যা রহস্য

থানা পুলিশ থেকে গোয়েন্দা পুলিশ হয়ে র‌্যাব পেয়েছিল তদন্তভার। কিন্তু এক যুগেও সাংবাদিক দম্পতি সাগর-রুনি হত্যার কোনো কূল-কিনারা হয়নি। ১৪৮ মাসে আদালতের কাছ থেকে ১১৩ বার সময় নিয়েও র‌্যাব কোনো কিছু বের করতে না পারায় মামলার তদন্ত থেকে সংস্থাটিকে সরিয়ে দিয়েছেন হাইকোর্ট। আগামী ৬ মাসের মধ্যে এ মামলার তদন্ত প্রতিবেদন জমা দিতে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

সেই সঙ্গে মামলার তদন্তের জন্য স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কে উচ্চ ক্ষমতাসম্পন্ন টাস্কফোর্স গঠনেরও নির্দেশ দিয়েছেন হাইকোর্ট। এক যুগ পর হাইকোর্টের এমন নির্দেশনা ও ছাত্র-জনতার আন্দোলনে আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটার পর অনেকে আশা করছেন, এখন আলোচিত এই হত্যা রহস্যের জট খুলবে। বাস্তবেই রহস্যের জট খুলবে নাকি বরাবরের মতোই হত্যাকা-ের ঘটনা রহস্য আড়ালেই থেকে যাবেÑএমন প্রশ্ন নিহতদের পরিবার, সাংবাদিক সামাজ ও সাধারণ মানুষের। তবে নতুন সরকারের কাছে তদন্ত শেষ করার দাবি নিহতদের পরিবারসহ সকলের। 
এ হত্যাকা-ের মামলা তদন্তে উচ্চ আদালত থেকে তদন্তর দায়িত্ব পাওয়া র‌্যাব বারবারই সময় নিয়ে আসছিল। অনেক তদন্ত কর্মকর্তা বদলের পর সম্প্রতি ১১৩তম বার তারা সময় নিয়েছিল। তবে নতুন কিছু জানাতে পারেনি। 
এই মামলার তদন্তে র‌্যাব কী পেয়েছিলÑ জানতে চাইলে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, তদন্তনাধীন বিষয় নিয়ে আমি কোনো মন্তব্য করতে পারব না। বিচারধীন বিষয় নিয়ে আসলে কারোরই কোনো মন্তব্য করার নিয়ম নেই। শুরুর দিকে তদন্তে যুক্ত ছিলেন, এমন একজন কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, আলামত বিশ্লেষণ ও তথ্য পর্যালোচনায় প্রাথমিক পর্যায়েই গুরুত্বপূর্ণ ধারণা মিলেছিল।

তবে সাক্ষ্য ও প্রমাণ সংগ্রহের সময় বাধে বিপত্তি। নানা বাধা আসে, সাংবাদিক মহল থেকেও আসে। তারপর তদন্ত সঠিক পথে এগোতে পারেনি। মূলত তখনই গন্তব্য ও গতি হারায় তদন্ত। 
এরমধ্যে সোমবার হাইকোর্টের আদেশ সংশোধন চেয়ে স্বরাষ্ট্র সচিব আবেদন করেন। সেই আবেদনের শুনানি নিয়ে বিচারপতি ফারাহ মাহবুব ও বিচারপতি মুহাম্মদ মাহবুব উল ইসলামের হাইকোর্ট বেঞ্চ উচ্চ ক্ষমতার একটি টাস্ক ফোর্স গঠনের নির্দেশনা দেন। 
হাইকোর্ট বলেছেন, এ হত্যাকা-ের তদন্তভার থেকে র‌্যাবকে সরানো হলো। এটি পাঠানো হয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে, বিভিন্ন সংস্থার অভিজ্ঞ, যোগ্যতাসম্পন্ন ব্যক্তিদের সমন্বয়ে গঠিত টাস্কফোর্সের মাধ্যমে তদন্ত করাতে পারবে সরকার। ৬ মাসের মধ্যে প্রতিবেদন জমা দিতেও বলা হয়েছে। এক যুগে এ হত্যার তদন্ত শেষ না হওয়া জাতির জন্য দুঃখজনক বলেও মন্তব্য করেছেন হাইকোর্ট। 
পরিবার কর্তৃক নিয়োগপ্রাপ্ত আইনজীবী শিশির মুনীর বলেন, র‌্যাবকে সরিয়ে দিয়ে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে টাস্কফোর্স গঠন করার মধ্য দিয়ে সাগর-রুনি হত্যাকা-ের জট খুলবে। তদন্ত কাজ পুলিশের তদন্ত সংস্থা পিবিআইকে দিতে চান তিনি। 
নিহত সাংবাদিক রুনির ভাই ও মামলার বাদী নওশের রোমান বলেন, তদন্ত করার চেয়ে পরিবারকে হয়রানি করা হয়েছে, গণমাধ্যমে কথা বললেই চাপ দেওয়া হতো, র‌্যাব আন্তরিক ছিল না বলেই এক যুগে তদন্ত শেষ হয়নি। হত্যার তদন্ত ধামাচাপা দিতেই র‌্যাবকে দায়িত্ব দেওয়া হয় বলে অভিযোগ করেছেন তিনি। দীর্ঘ সময় এটি তদন্ত না হওয়ায় তারা হতাশ। তাই তার পরিবারের পক্ষ থেকে আইনজীবী নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। নতুন সরকারের কাছে তাদের দাবি তদন্ত শেষ করার। 
এ প্রসঙ্গে বুধবার র‌্যাব মিডিয়া সেন্টারে আয়োজিত সংবাদ সম্মেলনে সাগর-রুনির মামলা তদন্ত করতে র‌্যাব ব্যর্থ কি না- এমন প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের লিগ্যাল অ্যান্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লেফটেন্যান্ট কর্নেল মুনীম ফেরদৌস বলেন, তদন্ত আরও বেগবান করার জন্য হাইকোর্ট মনে করেছেন। আরও অভিজ্ঞ লোক দরকার, যারা এ ধরনের কাজে পারদর্শী, তাদের অন্তর্ভুক্ত করে টাস্কফোর্স গঠন করতে বলা হয়েছে। এতে যদি র‌্যাবের কোনো সহায়তা লাগে, আমরা যে কোনো ধরনের সহায়তা করতে প্রস্তুত আছি।  
সাগর-রুনির মামলা তদন্ত প্রতিবেদন দিতে বিগত সরকারের কোনো চাপ ছিল কি-না এমন প্রশ্নের জবাবে র‌্যাবের মুখপাত্র বিষয়টি এড়িয়ে গিয়ে বলেন, তদন্তের জন্য আরও অভিজ্ঞদের নিয়ে টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। 
মাছরাঙা টেলিভিশনের বার্তা সম্পাদক সাগর সরোয়ার এবং এটিএন বাংলার সিনিয়র রিপোর্টার মেহেরুন রুনি তাদের একমাত্র ছেলে মাহির সরোয়ার মেঘকে নিয়ে থাকতেন ঢাকার পূর্ব রাজাবাজারের একটি ফ্ল্যাটে। ২০১২ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি সেই ভাড়া বাসায় খুন হন এই সাংবাদিক দম্পতি। সেই রাতে কর্মস্থল থেকে মধ্যরাতে ঘরে ফিরেছিলেন সাগর। পাঁচ বছরের মেঘকে নিয়ে রুনি বাড়িতেই ছিলেন। সকালে সাগর ও রুনির রক্তাক্ত লাশ উদ্ধার হয়। সাগরের দেহে ধারালো অস্ত্রের কয়েক ডজন আঘাতের চিহ্ন ছিল। যা দেখে পুলিশ কর্মকর্তারা বলেছিলেন, যেন খুনির সবটুকু ক্ষোভ ছিল তার ওপর।
হাত ও পা বাঁধা সাগরের দেহে বাঁটবিহীন দুটি ছুরি বিঁধে ছিল, ঘরে পাওয়া গিয়েছিল রক্তমাখা একটি বটি। রুনির পেটে ও পাঁজরে ছিল ধারালো অস্ত্রের দুটি আঘাতের চিহ্ন। ফরেনসিক প্রতিবেদন অনুযায়ী, সাগর ও রুনির মৃত্যুর ব্যবধান ন্যূনতম দুই ঘণ্টা। 
তদন্তকালে নজর রেখেছেন, ডিবির এমন এক কর্মকর্তা বলেছিলেন, একই ঘরে ও একই ঘটনায় দুজনের মৃত্যু হলেও ভিন্নতা আছে ধরনে। দীর্ঘ সময় ধরে নির্যাতন করে হত্যা করা হয়েছে সাগরকে। তার শরীরে ২৮টি আঘাতের চিহ্ন ইঙ্গিত করে, তিনি চরম প্রতিহিংসা ও ক্ষোভের শিকার। হাত-পা ও মুখ বেঁধে তাকে রান্নাঘরের বটি দিয়ে কোপানো হয়েছে, ব্যবহার হয়েছে ফল কাটার দুটি চাকু। 
খুনিরা অপেশাদার, তাদের দেহের ক্ষতচিহ্ন দেখে ময়নাতদন্তকারী চিকিৎসকরা বলেছিলেন তখন। খুনিরা পূর্ব পরিচিত বলে সন্দেহের কথা জানিয়েছিলেন পুলিশ কর্মকর্তারা।  
তবে হত্যাকা-ের পরপরই তৎকালীন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী সাহারা খাতুন ৪৮ ঘণ্টার মধ্যে খুনিদের গ্রেপ্তারের আশ্বাস দিয়েছিলেন। কিন্তু খুনি চিহ্নিত হওয়ার আগেই তাকে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ছাড়তে হয়েছিল। ঘটনার এক সপ্তাহ পর তৎকালীন পুলিশ প্রধান হাসান মাহমুদ খন্দকার তদন্তে ‘প্রণিধানযোগ্য অগ্রগতি’ হওয়ার খবর দিলেও তার দেখাও মেলেনি। মেহেরুন রুনির ভাই নওশের রোমান লাশ উদ্ধারের দিনেই হত্যা মামলা দায়ের করেন।
মামলাটি তদন্তের দায়িত্ব শুরুতে পেয়েছিলেন শেরেবাংলা নগর থানার তৎকালীন এসআই জহুরুল ইসলাম। তার কাছ থেকে তদন্তের দায়িত্ব দেওয়া হয়েছিল ডিবির পরিদর্শক রবিউল আলমকে।
কিন্তু ডিবি ৬২ দিনেও কোনো কূল-কিনারা করতে না পারার পর ওই বছরের ১৮ এপ্রিল আদালতে ব্যর্থতা স্বীকার করে। তখন ডিবির দায়িত্বে ছিলেন মনিরুল ইসলাম, যিনি সরকার পরিবর্তনের পর সম্প্রতি চাকরি হারান। 
এরপর হাইকোর্টের নির্দেশে র‌্যাব আসে তদন্তের দায়িত্বে। তারপর ১২ বছর চার মাস ধরে তারা কাজ করে যাচ্ছিল। পেশাগত বিরোধ, সম্পত্তি ও ব্যক্তিগত শত্রুতাÑএই তিনটি বিষয় মাথায় রেখে তদন্ত এগিয়ে নেওয়ার কথা শুরুতে বলেছিলেন তখনকার পুলিশ কর্মকর্তারা।
খুনের কয়েকদিন পর ডিএমপির তৎকালীন মুখপাত্র মনিরুল ইসলাম বলেছিলেন, ডাকাতি-চুরিসহ ছয়টি কারণকে সামনে রেখে তদন্ত চলছে। একটি ল্যাপটপ, মোবাইল ফোন, স্বর্ণালঙ্কার ও ১১শ’ ইউরো খোয়া যাওয়ার কথাও বলেছিলেন তিনি।
এরপর একদল গ্রিল কাটা চোরকে ধরে তারাই এই হত্যাকা- ঘটিয়েছিল দাবি করে কয়েক মাস পর অক্টোবরে ঘটা করে সংবাদ সম্মেলন করেছিলেন সাহারার পর স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব নেওয়া মহীউদ্দীন খান আলমগীর।
তখন রুনির বন্ধু তানভীর রহমানসহ সন্দেহভাজন আটজনকে আটক করা হয়েছিল। অন্যরা হলেন- এনাম আহমেদ ওরফে হুমায়ুন কবির, রফিকুল ইসলাম, বকুল মিয়া, মিন্টু ওরফে বারগিরা মিন্টু ওরফে মাসুম মিন্টু, কামরুল হাসান অরুণ, আবু সাঈদ এবং বাড়ির দারোয়ান পলাশ রুদ্র পাল। এদের অধিকাংশই ২০১২ সালের ২৩ আগস্ট মহাখালীতে বক্ষব্যাধি হাসপাতালের চিকিৎসক নারায়ণ চন্দ্র দত্ত হত্যা মামলার আসামি। 
গ্রেপ্তার কামরুল আদালতে বলেছিলেন, ‘আমরা নির্দোষ। সাগর-রুনির নামও কোনোদিন জানতাম না।’ গ্রেপ্তারদের মধ্যে বকুল পেঁয়াজের এবং রফিকুল কাঁচামালের ব্যবসা করতেন। সাইদ ছিলেন রাস্তার দোকানি।
ডাকাতি-চুরির সম্ভাব্যতা যাচাইয়ে সাগর-রুনির ফ্ল্যাটের ১ ফুট ৮ ইঞ্চি দৈর্ঘ্যরে গ্রিল কাটা অংশ দিয়ে মানুষ ঢোকানোর মহড়াও চালিয়েছিল পুলিশ। ছোট শিশু ছাড়া সেই ফাঁক দিয়ে কাউকে ঢোকানো সম্ভবপর হয়নি। ফলে সেদিকেও তদন্ত আর এগোয়নি। 
সাংবাদিক দম্পতি খুনের তদন্ত শেষ না হওয়ায় সমালোচনার মুখে ছিল আওয়ামী লীগ সরকার। সরকার পতনের পরপরই এ হত্যাকা- নিয়ে দৃশ্যমান অগ্রগতি আসতে শুরু করে। তাই বর্তমানে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের কাছে তদন্ত শেষ করার দাবি পরিবারসহ সকলের।

×