ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০১ অক্টোবর ২০২৪, ১৫ আশ্বিন ১৪৩১

সাত কার্যদিবসের মধ্যে প্রতিবেদন

চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির বিষয়ে কমিটি গঠন

স্টাফ রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২২:৫৬, ৩০ সেপ্টেম্বর ২০২৪; আপডেট: ০১:৪১, ১ অক্টোবর ২০২৪

চাকরিতে প্রবেশের বয়স বৃদ্ধির বিষয়ে কমিটি গঠন

প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান নিলে তাদের ছত্রভঙ্গ করতে টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী    

সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবিতে রাজধানীর শাহবাগ ও হেয়ার রোডে প্রধান উপদেষ্টার সরকারি বাসভবন যমুনার সামনে অবস্থান করে আন্দোলন করেছেন চাকরিপ্রত্যাশীরা। সোমবার বেলা ১১টার দিকে প্রথমে শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে অবস্থান নেন শত শত চাকরিপ্রার্থী। সেখানে কিছুক্ষণ অবস্থানের পর দুপুরের দিকে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে এসে অবস্থান নেন তারা। 
এ সময় পুলিশ তাদের বাধা দিয়েও রাখতে পারেননি। পরে আন্দোলনকারীদের ছত্রভঙ্গ করতে পুলিশ টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। তবে পুলিশ অ্যাকশনে গেলেও আন্দোলনকারীরা সরে না গিয়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে বসে পড়েন এবং তাদের দাবির পক্ষে নানা স্লোগান দিতেন থাকেন। এক পর্যায়ে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনের সড়ক ব্যারিকেড দিয়ে যান চলাচল বন্ধ রাখে পুলিশ ও সেনাবাহিনী। 
আন্দোলনকারীরা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎ চান। সোমবার বিকেল সোয়া ৫টার দিকে চাকরিপ্রত্যাশীদের পক্ষ থেকে ৫ সদস্যের একটি প্রতিনিধি প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনে প্রবেশ করেন। এ সময় দুই উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে তারা আন্দোলনরত চাকরিপ্রার্থীদের দাবি মানার আশ্বাস দেওয়া হয়। এ বিষয়ে আজ মঙ্গলবার জনপ্রশাসন সচিবের সঙ্গে আন্দোলনকারীদের একটি টিম আলোচনা করবে। আলোচনার প্রতিবেদন সাতদিনের মধ্যে প্রকাশ করা হবে।  
দুই উপদেষ্টার সঙ্গে সাক্ষাৎ শেষে যমুনা থেকে বেরিয়ে চাকরিপ্রার্থীদের প্রতিনিধিদলের সমন্বয়ক রাসেল সাংবাদিকদের জানান, সরকারি চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার জন্য আন্দোলনরত চাকরিপ্রার্থীদের প্রতিনিধি দলকে আশ্বস্ত করেছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
সমন্বয়ক রাসেল বলেন, আমাদের দাবির পূর্ণ সমর্থন দিয়েছেন প্রধান উপদেষ্টা। দাবি বাস্তবায়নে তিনি আমাদের আশ্বাস দিয়েছেন। তিনি বলেন, ড. মুহাম্মদ ইউনূস দীর্ঘ জার্নি করে এসেছেন। এজন্য উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ ও নাহিদ ইসলামের সঙ্গে দীর্ঘ এক ঘণ্টা আলোচনা হয়েছে আমাদের। আলোচনার সময় চাকরিতে প্রবেশের বয়স বাড়ানোর সুপারিশ কমিটির প্রধান সাবেক সচিব ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীর সঙ্গে মোবাইলে আমাদের কথা হয়েছে। তারা আমাদের জানিয়েছেন, ‘চাইলেই আজকে প্রজ্ঞাপন নিতে পারেন। কিন্তু এটার একটা প্রসেস আছে, সেই প্রসেসের মধ্যেই হবে।’
আজ মঙ্গলবার জনপ্রশাসন সচিবের সঙ্গে আমাদের টিম আলোচনা করবে। মূলত দাবি বাস্তবায়নের জন্য আলোচনা হবে। এ আলোচনার প্রতিবেদন সাতদিনের মধ্যে প্রকাশ করা হবে বলেও উল্লেখ করেন সমন্বয়ক রাসেল।
তবে বয়স বিষয়ে সুপারিশ দিতে সরকার কমিটি গঠন করেছে বলে সোমবার সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে জানিয়েছেন জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান। এরপরই বিকেলে প্রবেশের যৌক্তিক বয়সসীমা নির্ধারণের বিষয়ে সার্বিক বিষয়াদি পর্যালোচনা করে সুনির্দিষ্ট সুপারিশসহ প্রতিবেদন দাখিলের জন্য কমিটি গঠন করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়। এদিকে দিনভর গুরুত্বপূর্ণ এ দুটি সড়ক অবরোধ করে আন্দোলনের ফলে এসব এলাকায় তীব্র যানজটের সৃষ্টি হয়। এর প্রভাব পড়ে আশপাশের সড়কেও।  
প্রথমে বেলা ১১টা শাহবাগ জাতীয় জাদুঘরের সামনে জড়ো হন শত শত চাকরিপ্রার্থী। আন্দোলনে যোগ দেন দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে আসা শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী ও পড়াশোনা সম্পন্ন করা বিভিন্ন বয়সী নারী-পুরুষ। তারা আন্তর্জাতিক মানদ- অনুযায়ী সরকারি চাকরিতে প্রবেশের বয়সসীমা ৩৫ বছর করার দাবি ছাড়াও শর্তসাপেক্ষে বয়সসীমা উন্মুক্ত করারও দাবি জানান। তাদের দাবির সঙ্গে একাত্মতা প্রকাশ করেন নিরাপদ সড়ক আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা ইলিয়াস কাঞ্চন। তিনি চাকরিতে বয়সসীমা ৩৫ করার দাবি মেনে নিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান। এ সময় ইলিয়াস কাঞ্চন আরও বলেন, আমাদের সবার আশা আকাক্সক্ষা ছিল এ রাষ্ট্রের মধ্যে আর কোনো বৈষম্য থাকবে না। কিন্তু এখনো চাকরিতে আবেদনের বয়সসীমা ৩০ থেকে ৩৫ এর জন্য আমার সন্তানরা কষ্ট পাবে, বৃষ্টি উপেক্ষা করে দাবি আদায়ের জন্য দাঁড়াতে হবে এটা আমি কখনো আশা করিনি। আমি চাইব অন্তত চাকরিতে বয়সসীমা বাড়ানোর দাবি নিয়ে আর যেন কোনো দিন আমাদের সন্তানদের রাস্তায় দাঁড়াতে না হয়। 
শাহবাগ থেকে আন্দোলনকারীরা দুপুরের পর পর স্লোগান দিতে দিতে হেয়ার রোডে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবন যমুনার দিকে অগ্রসর হতে থাকেন। এ সময় পুলিশ তাদের বাধা দেয় এবং টিয়ারশেল নিক্ষেপ করে। তবে পুলিশ অ্যাকশনে গেলেও আন্দোলনকারীরা চলে যাননি, তারা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে বসে পড়েন এবং তাদের দাবির পক্ষে নানা স্লোগান দিতে থাকেন। আন্দোলনকারীরা ‘বয়স না মেধা, মেধা মেধা; ৩০ না ৩৫, ৩৫, ৩৫; আর নয় কালক্ষেপণ, আজই প্রজ্ঞাপন’ বলে স্লোগান দিতে থাকেন।’ 
সরজমিনে দেখা যায়, প্রায় পাঁচ শতাধিক চাকরিপ্রত্যাশী প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনের সড়ক অবরোধ করে আন্দোলন করছেন। তাদের কেউ কেউ দাঁড়িয়ে নানা স্লোগান দিচ্ছেন। এ ছাড়া আবার অনেক চাকরিপ্রত্যাশী রাস্তায় শুয়ে পড়েন। আন্দোলনকে কেন্দ্র করে প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করা হয়েছে। পুলিশের পাশাপাশি ঘটনাস্থলে সেনা সদস্যদের সংখ্যাও বৃদ্ধি করা হয়েছে। যমুনা ভবনের সামনের দুই পাশের সড়ক ব্যারিকেড দিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়। এতে ওই সড়ক দিয়ে যান চলাচল বন্ধ থাকে। তখনও আন্দোলনকারী যমুনার সামনে অবস্থান নিয়ে স্লোগান দিতে থাকেন। যে কোনো ধরনের আনাকাক্সিক্ষত ঘটনা প্রতিরোধ করতে পুলিশ ও সেনাবাহিনীকে প্রস্তুত থাকতে দেখা যায়। 
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (ক্রাইম অ্যান্ড অপারেশনস) মো. ইসরাইল হাওলাদার বলেন, প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনের সামনে সভা-সমাবেশ করার বিষয়ে আগেই নিষেধাজ্ঞা ছিল। কিন্তু আন্দোলনকারীরা পুলিশের নিষেধ অমান্য করে প্রধান উপদেষ্টার বাসার সামনে যায়। তাদের বিষয়ে আমরা ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং সেখানে তাদের আমরা থাকতে দেব না। পরিস্থিতি বিবেচনায় আমরা পদক্ষেপ গ্রহণ করেছি। সেখানে আন্দোলনরত চাকরিপ্রার্থী ও শিক্ষার্থীরা প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সাক্ষাৎ চান। প্রধান উপদেষ্টা ছাড়া কারও সঙ্গে তারা আলোচনা করতে রাজি নন। বিকেল সাড়ে ৩টার দিকে যমুনার সামনে সাংবাদিকদের কাছে নিজেদের এ চাওয়ার কথা জানান আন্দোলনকারীরা।
তারা বলেন, আমরা যমুনার সামনে অবস্থান নেওয়ার পরে দুপুর ২টার দিকে চারজনের একটি প্রতিনিধি দলের সঙ্গে আলোচনা করেছেন প্রশাসনের কর্মকর্তারা। তারা আমাদের কর্ম কমিশনের একজন কমিশনারের পিএসের সঙ্গে আলোচনায় বসার প্রস্তাব দিয়েছেন। 
যমুনা থেকে বেরিয়ে আন্দোলনকারী রাসেল আল মাহমুদ বলেন, ভেতরে কোনো সিদ্ধান্ত হয়নি। আলোচনা হয়েছে। আমাদের বলা হয়েছে, সংস্কার উপদেষ্টা ড. আবদুল মুহিতের সঙ্গে এ বিষয়ে কথা বলা হচ্ছে। পরে যখন বললাম তার সঙ্গে আমরা কথা বলব। তখন তারা সময়ক্ষেপণ শুরু করেন। আন্দোলনকারীরা বলেন, আমরা দীর্ঘদিন ধরে ৩৫-এর দাবিতে আন্দোলন চালিয়ে আসছি। বিভিন্ন সময় নানা জনের আশ্বাসও পেয়েছি। কিন্তু এখনো আমাদের দাবি বাস্তবায়ন হয়নি। তাই আমরা কোনো কর্মকর্তা বা পিএসের সঙ্গে বসতে চাই না। আমরা অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে চাই। তার সঙ্গে কথা বলতে চাই। অন্যথায় আমাদের আন্দোলন চলবে। এর পরপরই আন্দোলনকারীদের পক্ষ থেকে প্রতিনিধি দলের সদস্যরা প্রধান উপদেষ্টার বাসভবনে প্রবেশ করেন। 
কমিটি গঠন ॥ সাবেক সচিব ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা আব্দুল মুয়ীদ চৌধুরীকে প্রধান করে এ বিষয়ে সোমবারই কমিটি গঠন করেছে সরকার। কমিটিকে আগামী সাত দিনের (কর্মদিবস) মধ্যে সুপারিশ সম্বলিত প্রতিবেদন দিতে বলা হয়েছে। জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব কমিটিতে সদস্য সচিবের দায়িত্ব পালন করবেন। দুপুরে সচিবালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে এমনটি জানান জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সিনিয়র সচিব মো. মোখলেস উর রহমান। 
সিনিয়র সচিব বলেন, এই কমিটি সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময় সীমা বৃদ্ধির বিষয়ে সংশ্লিষ্ট সকলের দাবি এবং চলমান আন্দোলনের পরিপ্রেক্ষিতে সরকারি চাকরিতে প্রবেশের যৌক্তিক বয়সসীমা নির্ধারণের বিষয়ে সার্বিক পর্যালোচনা করে সুপারিশসহ প্রতিবেদন দেবে। কমিটির আহ্বায়ককে ক্ষমতা ও এখতিয়ার দেওয়া হয়েছে যে কয়জন সদস্য প্রয়োজন তিনি কমিটিতে নেবেন। এক প্রশ্নে জনপ্রশাসন সচিব বলেন, সরকারি চাকরিতে প্রবেশের সময়সীমা বাড়ানোর বিষরয় যারা আন্দোলন করছেন তাদের কোনো আশ্বাস দিচ্ছি না, এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়া হচ্ছে।
সরকারি চাকরিতে প্রবেশের ক্ষেত্রে বয়সসীমা ৩৫ বছর ও অবসরের বয়স ৬৫ বছর করার দাবি জানিয়ে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগে চিঠি দিয়েছে প্রশাসন ক্যাডার কর্মকর্তাদের সংগঠন বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন। অ্যাসোসিয়েশনের এই চিঠিটি গত ১৮ সেপ্টেম্বর জনপ্রশাসন মন্ত্রণালয়ের সচিবের কাছে পাঠিয়ে এ বিষয়ে ব্যবস্থা নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ। এর আগে গত ৫ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশ অ্যাডমিনিস্ট্রেটিভ সার্ভিস অ্যাসোসিয়েশন মহাসচিব মুহাম্মদ মাহবুবুর রহমান এ বিষয়ে ব্যবস্থা নিতে মন্ত্রিপরিষদ বিভাগের চিঠি দেন। 
এদিকে শাহবাগ ও হেয়ার রোডে চাকরিপ্রত্যাশীদের অবস্থানের কারণে মিন্টো রোড থেকে কাকরাইল মসজিদ পর্যন্ত উভয় পথে যানচলাচল বন্ধ করে দেওয়া হয়। ফলে মিন্টো রোডকে ঘিরে থাকা চারদিকের সড়কগুলোতে যানজট তৈরি হয়।

×