প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন
জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে যোগ দিতে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা নোবেল বিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূস মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে গেছেন। সেখানে আজ মঙ্গলবার দেশটির প্রেসিডেন্ট জো-বাইডেনের সঙ্গে দ্বি-পক্ষীয় বৈঠক করবেন প্রধান উপদেষ্টা। তৃতীয় বিশ্বের প্রথম কোনো সরকার প্রধানের সঙ্গে জাতিসংঘের অধিবেশনের ফাঁকে বসতে যাচ্ছেন মার্কিন প্রেসিডেন্ট। এটি বাংলাদেশের জন্য বিরল সম্মানের। কারণ সাধারণত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘ অধিবেশনের সাইড লাইনে বৈঠক করেন না।
ঐতিহাসিক এই বৈঠকে বাংলাদেশের ছাত্র-আন্দোলনের অভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপট এবং নতুন বাংলাদেশ গড়ার রূপরেখাসহ চারটি বিষয় উপস্থাপন করবেন প্রধান উপদেষ্টা।
এর আগে সোমবার সকালে জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিতে নিউইয়র্কের উদ্দেশে যাত্রা করেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টা ও তার সফরসঙ্গীদের নিয়ে কাতার এয়ারওয়েজের একটি ফ্লাইট সোমবার সকাল ৫টা ১০ মিনিটের দিকে হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর ছেড়ে যায়।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি মাসেই যুক্তরাষ্ট্রের উচ্চ পর্যায়ের একটি প্রতিনিধি দল ঢাকা সফর করে গেছে। আর এখন দীর্ঘ আড়াই দশক পরে দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে। এর আগে ২০০০ সালে ঢাকা সফরে এসেছিলেন মার্কিন তৎকালীন প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন। সেই সময় দুই দেশের শীর্ষ পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হয়েছিল। ক্লিনটনের ঢাকা সফরের পেছনেও অন্যতম প্রভাবক হিসেবে কাজ করেছিলেন ড. ইউনূস।
বাংলাদেশে রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গেই বড় পরিবর্তন এসেছে ঢাকা-ওয়াশিংটন সম্পর্কে। ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানে শেখ হাসিনা সরকারের পতনের পর বাংলাদেশের সঙ্গে সম্পর্ক নতুন উচ্চতায় নিতে কাজ শুরু করেছে যুক্তরাষ্ট্র। এরই অংশ হিসেবে আজ বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ পর্যায়ে বৈঠক অনুষ্ঠিত হতে যাচ্ছে।
রাজনৈতিক ও কূটনৈতিক অঙ্গনে আগ্রহের কেন্দ্রে রয়েছে এই বৈঠক। সাধারণত মার্কিন প্রেসিডেন্ট জাতিসংঘ অধিবেশন চলাকালে নিউইয়র্কে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক করেন না। এ ধরনের বৈঠকগুলো হয়ে থাকে ওয়াশিংটনে। তাই বাইডেনের সঙ্গে ইউনূসের এই বৈঠক রীতিমতো হইচই ফেলে দিয়েছে কূটনৈতিক মহলে। কূটনীতিক বিশ্লেষকরা বলছেন, এখানে বাংলাদেশকে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়ার বিষয়ই জানান দিচ্ছে। বলা যায়, এতে করে অনন্য উচ্চতায় উঠেছে বাংলাদেশ।
জাতিসংঘে বাংলাদেশ মিশনসহ একাধিক সূত্র বলছে, গত ৩০ বছরের ইতিহাসে বাংলাদেশের মতো তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশের রাষ্ট্র কিংবা সরকার প্রধানকে বেছে নিয়েছেন আমেরিকান প্রেসিডেন্ট। জাতিসংঘের বাংলাদেশ স্থায়ী মিশন সূত্রে জানা গেছে, সব ঠিক থাকলে নিউইয়র্কের স্থানীয় সময় মঙ্গলবার দুপুরে জাতিসংঘ সদর দপ্তরে বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের শীর্ষ নেতারা বৈঠকে বসবেন। বাংলাদেশের পক্ষে ড. ইউনূসের সঙ্গে থাকবেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন।
বৈঠকে চারটি প্রস্তাবের মাধ্যমে যুক্তরাষ্ট্রের কাছ থেকে বাংলাদেশের প্রত্যাশার বিষয়টি আনুষ্ঠানিকভাবে তুলে ধরা হবে। প্রস্তাবের প্রথমে গত ৫ আগস্টের আগে এবং পরে বাংলাদেশের সার্বিক পরিস্থিতি তুলে ধরা হবে। বিশেষ করে বিভিন্ন খাতের সংস্কারের বিষয়টি তুলে ধরা হবে।
দ্বিতীয়ত, যুক্তরাষ্ট্রের বিভিন্ন সংস্থা এবং কোম্পানির কাছে থাকা ঋণ পরিশোধের সময় চাওয়া হবে। তৃতীয়ত, বাংলাদেশে যুক্তরাষ্ট্রের আরও বেশি বিনিয়োগের প্রস্তাব দেওয়া হবে। চতুর্থত, যুক্তরাষ্ট্রের প্রতিনিধিদের বাংলাদেশে আসার আমন্ত্রণ জানানো হবে। প্রস্তাব দেওয়া হবে সরেজমিনে বাংলাদেশ পরিদর্শন করে সিদ্ধান্ত নিতে।
ঢাকা ও নিউইয়র্কের উচ্চপর্যায়ের সূত্রগুলো জানিয়েছে, গত বৃহস্পতিবার বিকেলে ওয়াশিংটনের পক্ষ থেকে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনের ফাঁকে ইউনূস-বাইডেন বৈঠকের বিষয়টি চূড়ান্ত করা হয়।
যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট সাধারণত জাতিসংঘ অধিবেশনে তার নির্ধারিত বক্তৃতার দিন সকালে নিউইয়র্কে পৌঁছেন। তিনি সেদিন সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে বক্তৃতা দেন। এরপর বিকেলে জাতিসংঘের অধিবেশনে আগত রাষ্ট্র ও সরকার প্রধানদের সম্মানে সংবর্ধনার আয়োজন করেন। সেখানেও বাইডেনের সঙ্গে ফের দেখা হবে ড. ইউনূসের।
গত ৮ আগস্ট দায়িত্ব নেওয়ার পর নিউইয়র্ক (যুক্তরাষ্ট্র) যাচ্ছে ড. ইউনূসের প্রথম বিদেশ সফর। সেখানে জাতিসংঘের অধিবেশনের দিকে জো বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের পাশাপাশি ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট উরসুলা ভন ডার লিয়েনের সঙ্গে বৈঠক করবেন ড. ইউনূস। এ ছাড়া বিশ্বব্যাংকের প্রেসিডেন্ট অজয় বাঙ্গা এবং আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলের (আইএমএফ) ব্যবস্থাপনা পরিচালক ক্রিস্টালিনা জর্জিয়েভা বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করবেন।
বাইডেনের সঙ্গে বৈঠকের পর সন্ধ্যায় জাতিসংঘের একটি মিলনায়তনে ‘জাতিসংঘে বাংলাদেশের সদস্য হওয়ার ৫০ বছর পূর্তি’ অনুষ্ঠান হবে। সেখানে বিশ্ব নেতাদের স্বাগত জানাবেন ড. ইউনূস। গত ৫ দশকে জাতিসংঘ শান্তিরক্ষী মিশনে এবং বিভিন্ন ফোরামে বাংলাদেশের অবদানের প্রসঙ্গসহ সামনের দিনগুলোতে জাতিসংঘে বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের অন্তর্ভুক্তি বাড়ানোর আহ্বান জানাবেন ড. ইউনূস।
জাতিসংঘের অধিবেশনে আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর বক্তৃতা করবেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি তার বক্তব্যে বিগত দুই মাসে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অভাবনীয় গণঅভ্যুত্থানের বিবরণ এবং আগামী দিনে জনভিত্তিক, কল্যাণমুখী ও জনস্বার্থে নিবেদিত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার দৃঢ় প্রত্যয় বিশ্বদরবারে তুলে ধরবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।
পাশাপাশি, আন্তর্জাতিক শান্তি ও নিরাপত্তা নিশ্চিতের ক্ষেত্রে শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের বলিষ্ঠ অবস্থান, জলবায়ু পরিবর্তন ও এর প্রভাব, জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, বিশ্বব্যাপী সংঘাত, রোহিঙ্গা সংকট, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিকূলতা, উন্নয়নশীল দেশগুলো থেকে সম্পদ পাচার প্রতিরোধ, নিরাপদ অভিবাসন, অভিবাসীদের মৌলিক পরিষেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, জেনারেটিভ কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্তির টেকসই হস্তান্তর এবং ফিলিস্তিন সম্পর্কিত বিষয়সমূহ তার বক্তব্যে উঠে আসতে পারে।
পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, জাতিসংঘে প্রধান উপদেষ্টা মার্কিন প্রেসিডেন্ট ছাড়াও বেশ কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন। তিনি নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, নেপালের প্রধানমন্ত্রী, ইউরোপীয় কমিশনের প্রেসিডেন্ট, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতিসংঘ মহাসচিব, জাতিসংঘ মানবাধিকার সম্পর্কিত হাইকমিশনার, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট, ইউএসএইডের প্রশাসকের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নিয়ে পারস্পরিক স্বার্থসংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবেন। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে ইতালির প্রেসিডেন্ট এবং কুয়েতের ক্রাউন প্রিন্সের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজনের আলোচনাও চলছে। এ ছাড়া চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করতে পারেন।
বাইডেনের সঙ্গে বৈঠক হলেও নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে বৈঠক হচ্ছে না ড. ইউনূসের। কারণ, ড. ইউনূস যখন পৌঁছবেন, তখন নরেন্দ্র মোদির যুক্তরাষ্ট্র ছেড়ে যাওয়া কথা। তবে অধিবেশনের ফাঁকে ২৩ সেপ্টেম্বর স্থানীয় সময়ে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের সঙ্গে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্করের দ্বিপক্ষীয় আলোচনা হয়। সেখানে বাংলাদেশের পক্ষে বলা হয়েছে, ঐতিহাসিক প্রতিবেশী ভারতের সঙ্গে সত্যিকারের দীর্ঘস্থায়ী সুসম্পর্ক গড়তে চায় বাংলাদেশ। শুধু বাংলাদেশের কোনো একটা নির্দিষ্ট গোষ্ঠী বা দলের সঙ্গে ভারতের সুসম্পর্ক বজায় থাকুক, ঢাকা এমন চায় না। ঢাকা চায় যে বাংলাদেশের মানুষের সঙ্গে ভারতের মানুষের সত্যিকারের সখ্য গড়ে উঠুক, দুই দেশের মধ্যে টেকসই সুসম্পর্ক বজায় থাকুক।