ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৬ আশ্বিন ১৪৩১

জাতিসংঘ অধিবেশন

প্রধান উপদেষ্টা কাল নিউইয়র্ক যাচ্ছেন

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ০০:৫১, ২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪

প্রধান উপদেষ্টা কাল নিউইয়র্ক যাচ্ছেন

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা মো. তৌহিদ হোসেন জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের অধিবেশনে উপলক্ষে সাংবাদিকদের সঙ্গে মতবিনিময় করেন

জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে যোগ দিতে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস আগামীকাল সোমবার রাতে নিউইয়র্কের উদ্দেশে ঢাকা ত্যাগ করবেন। তবে চার্টার্ড বিমানযোগে নয়, বাণিজ্যিক ফ্লাইটে যুক্তরাষ্ট্রে যাচ্ছেন তিনি। আগামী ২৭ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্ক পর্বে বক্তব্য রাখবেন।

তিনি তাঁর বক্তব্যে বিগত দুই মাসে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অভাবনীয় গণঅভ্যুত্থানের বিবরণ ও আগামী দিনে কল্যাণমুখী ও জনস্বার্থে নিবেদিত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয় বিশ্বদরবারে তুলে ধরবেন। 

ছাত্র-জনতার তীব্র আন্দোলনের মুখে গত ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে ভারতে পালিয়ে যান। নোবেলবিজয়ী ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা হওয়ার প্রস্তাব দেওয়া হলে তিনি তা গ্রহণ করেন। এর পর ৮ আগস্ট তিনি দায়িত্ব নেন। অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে এটিই ড. মুহাম্মদ ইউনূসের প্রথম বিদেশ সফর। প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস তিনদিন নিউইয়র্কে অবস্থান করে ২৭ সেপ্টেম্বর বাংলাদেশের উদ্দেশে রওনা হবেন।
শনিবার দুপুরে সংবাদ সম্মেলনে এ তথ্য জানান পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা এম তৌহিদ হোসেন। জাতিসংঘের ৭৯তম অধিবেশনে বাংলাদেশের অংশগ্রহণ প্রসঙ্গে এ সংবাদ সম্মেলন করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। সংবাদ সম্মেলনে আরও উপস্থিত ছিলেন পররাষ্ট্র সচিব এম জসীম উদ্দিন ও পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ইস্ট এশিয়া প্যাসিফিক অনুবিভাগের মহাপরিচালক তৌফিক হাসান। 
সংবাদ সম্মেলনে এম তৌহিদ হোসেন বলেন, আগামী ২৪ সেপ্টেম্বর থেকে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে উচ্চপর্যায়ের বিতর্ক পর্ব শুরু হতে যাচ্ছে। এ অধিবেশনে যোগদানের জন্য প্রধান উপদেষ্টা আগামী ২৩ সেপ্টেম্বর একটি বাণিজ্যিক ফ্লাইটে নিউইয়র্কে পৌঁছবেন। জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে ৫৭ সদস্যের প্রতিনিধি দল যোগদান করবে। ড. ইউনূস ২৭ সেপ্টেম্বর সাধারণ পরিষদের ৭৯তম অধিবেশনে ভাষণ দেবেন।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, আগের সরকার কেন বড় ডেলিগেশন নিয়ে যেত, সেটি আমি জাস্টিফাই করতে পারব না, আমি তখন আপনাদের মতো সাধারণ মানুষ ছিলাম। সুতরাং আমি জানি না। তবে বর্তমান সরকার সিদ্ধান্ত নিয়েছে, অবশ্যই ব্যয় সংকোচন করতে হবে। অপ্রয়োজনীয় কোনো খরচ করা যাবে না।

স্বাভাবিক সময়ে ৭৩তম এবং ৭৪তম অধিবেশনে এ সংখ্যা ছিল ৩৪৪ ও ৩৩৫। এর পর করোনার জন্য ৭৫তম অধিবেশন হয়েছে ভার্চুয়ালি। করোনার সীমাবদ্ধতার মধ্যেও ৭৬তম অধিবেশনে ১০৮ জন, ৭৭তম অধিবেশনে ১৩৮ জন এবং কোভিড পরবর্তী যখন ব্যয় সংকোচনের কথা বলা হচ্ছিল তখনো ৭৮তম অধিবেশনে ১৪৬ জন গেছেন।
তিনি বলেন, এবার নিরাপত্তা এবং প্রেসসহ সব মিলিয়ে কিছু বিষয়ে আমরা সংকোচন করতে পারিনি, কারণ নিরাপত্তা তো সবার ওপরে। সব মিলিয়ে এবার ৫৭ জন যাচ্ছেন। তার মধ্যে বড় অংশ নিরাপত্তা এবং প্রেস। আমি এতটুকু বলতে পারি, একেবারে নিতান্ত প্রয়োজন য দের, তারাই যাবেন।

তিনি জানান, ২৭ সেপ্টেম্বর প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদের সাধারণ বিতর্ক পর্বে বক্তব্য রাখবেন। তিনি তাঁর বক্তব্যে বিগত দুই মাসে বাংলাদেশে ঘটে যাওয়া অভাবনীয় গণÑঅভ্যুত্থানের বিবরণ ও আগামী দিনে কল্যাণমুখী ও জনস্বার্থে নিবেদিত একটি রাষ্ট্রব্যবস্থা গড়ে তোলার প্রত্যয় বিশ্বদরবারে তুলে ধরবেন।
তৌহিদ হোসেন বলেন, আন্তর্জাতিক শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে বাংলাদেশের বলিষ্ঠ অবস্থান, জলবায়ু পরিবর্তন, জলবায়ু ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা, রোহিঙ্গা সংকট, টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা (এসডিজি) অর্জনের ক্ষেত্রে উন্নয়নশীল দেশগুলোর প্রতিকূলতা, সম্পদ পাচার প্রতিরোধ, নিরাপদ অভিবাসন, অভিবাসীদের মৌলিক পরিষেবা প্রাপ্তির নিশ্চয়তা, জেনারেটিভ কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার পরিপ্রেক্ষিতে প্রযুক্তির টেকসই হস্তান্তর এবং ফিলিস্তিন সম্পর্কিত বিষয়সমূহ প্রধান উপদেষ্টার বক্তব্যে উঠে আসতে পারে।
তিনি জানান, প্রধান উপদেষ্টা বেশ কয়েকটি দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশগ্রহণ করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে। তিনি নেদারল্যান্ডসের প্রধানমন্ত্রী, পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী, নেপালের প্রধানমন্ত্রী, ইউরোপিয়ান কমিশনের প্রেসিডেন্ট, যুক্তরাষ্ট্রের পররাষ্ট্রমন্ত্রী, জাতিসংঘ মহাসচিব, জাতিসংঘ মানবাধিকার সম্পর্কিত হাইকমিশনার, বিশ্বব্যাংক গ্রুপের প্রেসিডেন্ট, ইউএসএইডের প্রশাসকের দ্বিপক্ষীয় বৈঠকে অংশ নিয়ে পারস্পরিক স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন বিষয়ে আলোচনা করবেন বলে আশা করা যাচ্ছে।

পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, এ সময়ে অনেক বৈঠকের সিদ্ধান্ত শেষ মুহূর্তেও হয়ে যায়। সে বিবেচনায় নতুন বৈঠক তালিকায় যোগ হতে পারে, আবার সময়ের অভাবে কোনো বৈঠক বাদও যেতে পারে। প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট, ইতালির প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক আয়োজনের আলোচনা চলমান রয়েছে। এ ছাড়া চীনের পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে দেখা করতে পারেন বলে আলোচনা চলছে।
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, জাতিসংঘের অগ্রাধিকার ইস্যুগুলো বাংলাদেশের জন্য সমানভাবে গুরুত্বপূর্ণ। এই ইস্যুগুলোর ওপর যেসব ইভেন্ট আছে, বাংলাদেশ তার সবগুলোতেই সক্রিয়ভাবে অংশগ্রহণ করবে। বাংলাদেশ জাতিসংঘসহ বহুপক্ষীয় কূটনীতিকে জাতীয় স্বার্থ সংরক্ষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে মনে করে।

এবারের অধিবেশনে বাংলাদেশ প্রতিনিধি দল অংশগ্রহণের মাধ্যমে জাতীয় স্বার্থ সংশ্লিষ্ট বিষয়সমূহে আন্তর্জাতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রকে বিস্তৃত ও সুদৃঢ় করবে আশা করা যাচ্ছে। এ ছাড়া সফকালে জাতিসংঘে বাংলাদেশের ৫০ বছরপূর্তি উপলক্ষে বাংলাদেশ এক সংবর্ধনার আয়োজন করবে। 
পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, এ কথা বলার অবকাশ রাখে না যে, প্রধান উপদেষ্টার পরিচিতি এবং সুনাম বিশ্বব্যাপী। এ কারণে অনেকগুলো বিশ্ব খ্যাত সংবাদ সংস্থা তাঁর সাক্ষাৎকার গ্রহণের জন্য অনুরোধ জানিয়েছে। এ ছাড়া, বিভিন্ন পর্যায়ে দ্বিপক্ষীয় বৈঠক ও সভায় অংশগ্রহণ করার জন্যও অনুরোধ এসেছে। যেহেতু তিনি মাত্র তিনদিন নিউইয়র্কে অবস্থান করবেন, সেহেতু পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের পক্ষে এই স্বল্প সময়েরর মধ্যে সকলের অনুরোধ রক্ষা করা বেশ কঠিন।
তিনি আরও বলেন, জাতিসংঘ অধিবেশনে আমরা রোহিঙ্গা সংকট বিষয়ে একটি উচ্চ-পর্যায়ের সাইড ইভেন্টও আয়োজন করছি। এটা বলার অপেক্ষা রাখে না যে, নতুন বাংলাদেশ বিনির্মাণে অন্তর্বর্তী সরকার সংস্কার কাজ শুরু করেছে। এ প্রেক্ষাপটে এবারের অধিবেশন নতুন বাংলাদেশের জন্য জাতিসংঘে বা বিশ্ব সভায় নতুন পদচারণা। এবারের অধিবেশনে আমাদের কাছে একটি বিরাট সুযোগ বিশ্বদরবারে এই বৈষম্যহীন, ন্যায়ভিত্তিক বাংলাদেশকে উপস্থাপনের জন্য।
কী কী  বিষয় নিয়ে আলোচনা হতে পারে জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা বলেন, সরকারের ক্ষমতাগ্রহণের  প্রেক্ষাপট নিয়ে কথা হবে। আমাদের যেসব প্রতিশ্রুতি আছে, সেগুলো নিয়ে কথা হবে। এখানে যেসব সংস্কার হবে সেটি তাদের অবহিত করবেন। আমরা এরই মধ্যে মানবাধিকার নিয়ে যে অগ্রগতি অর্জন করেছি, সেটিও জানাবেন। আমরা ইতোমধ্যে একটি মানবাধিকার কনভেনশনে পক্ষভুক্ত হয়েছি।

এ ছাড়া মানবাধিকার বিষয় নিয়ে কথা হবে। আমরা দেশে যে খোলামেলা পরিবেশ সৃষ্টি করতে যাচ্ছি বা করেছি, তাতে করে যে কেউ মানবাধিকার ইস্যু তুলতে পারেন এবং এ ব্যাপারে সরকার যথেষ্ট গুরুত্বের সঙ্গে সমাধানে তৎপর থাকবে, সে ব্যাপারে প্রতিশ্রুতি তিনি দিয়েছেন এবং দিয়ে থাকবেন।
চার্টার্ড নয়, বাণিজ্যিক বিমানে যাবেন ড. ইউনূস : জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে যোগ দিতে চার্টার্ড বিমানযোগে নয়, বাণিজ্যিক ফ্লাইটে যুক্তরাষ্ট্রে যাবেন প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূসের নেতৃত্বে প্রতিনিধি দল। সংবাদ সম্মেলনে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, সাম্প্রতিক বছরগুলোর মতো এবার বাংলাদেশ থেকে শতাধিক সদস্যের প্রতিনিধিদল চার্টার্ড বিমানে নিউইয়র্ক সফর করবে না।

বরং যার যেই সংশ্লিষ্টতা বা দায়িত্ব, সে অনুযায়ী যতটা সম্ভব সীমিত আকারে প্রতিনিধি দল গঠন করা হয়েছে। আমি আমার দায়িত্বের সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ উচ্চপর্যায়ের সভাগুলোতে অংশ নিতে ভিন্ন একটি ফ্লাইটে দুইদিন আগে নিউইয়র্ক যাবো।
নিউইয়র্কে জয়শঙ্করের সঙ্গে বৈঠক করবেন পররাষ্ট্র উপদেষ্টা : নিউইয়র্কে জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনের সাইডলাইনে ভারতের পররাষ্ট্রমন্ত্রী এস জয়শঙ্কর ও বাংলাদেশের পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেনের মধ্যে বৈঠক হবে। পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে এক প্রেস ব্রিফিংয়ে তৌহিদ হোসেন বলেন, সব সমস্যা সমাধান করে আমরা পারস্পরিক শ্রদ্ধা ও ন্যায্যতার ভিত্তিতে দুই দেশের সম্পর্ককে আরও এগিয়ে নিতে চাই।

তবে ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঙ্গে প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূসের কোনো বৈঠক হবে না। ড. ইউনূস ও নরেন্দ্র মোদির দ্বিপক্ষীয় বৈঠক হবে কি না জানতে চাইলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা জানান, প্রধান উপদেষ্টা জাতিসংঘের সাধারণ অধিবেশনে পৌঁছানোর আগেই নরেন্দ্র মোদি নিউইয়র্ক ত্যাগ করবেন বলেই তাঁদের মধ্যে বৈঠক হবে না।

ভারতীয় গণমাধ্যমের খবর অনুযায়ী, অন্তর্বর্তী সরকারের নেতৃত্বের বিভিন্ন বক্তব্যের কারণে দুই দেশের মধ্যে তৈরি হওয়া উত্তেজনার কারণে মোদি ও ইউনূসের মধ্যে বৈঠক হচ্ছে না। এ ব্যাপারে জিজ্ঞাসা করা হলে পররাষ্ট্র উপদেষ্টা তৌহিদ হোসেন বলেন, অতীতে ভারতের শীর্ষ নেতাদের থেকেও বিভিন্ন মন্তব্য এসেছে। সুতরাং এটা বৈঠক না হওয়ার কারণ নয়।

তিনি আরও বলেন, কিছু ক্ষেত্রে ভারতের অনেক মন্তব্য বাংলাদেশের পছন্দ হয় না। এটি বড় সমস্যা নয়। আমরা আমাদের প্রতিবেশী পরিবর্তন করতে পারি না, শুধু সুসম্পর্ক বজায় রেখে সহাবস্থান করতে পারি।

×