ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ৮ পৌষ ১৪৩১

আক্রান্ত ৫ হাজারের বেশি, মশা নিধনে নেই কার্যকর উদ্যোগ

ডেঙ্গু সংক্রমণ বেড়েই চলেছে ১৩ দিনে ২০ জনের মৃত্যু

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:০৫, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

ডেঙ্গু সংক্রমণ বেড়েই চলেছে  ১৩ দিনে ২০ জনের মৃত্যু

রাজধানীর মুগদা হাসপাতালে প্রতিদিন বাড়ছে ডেঙ্গু রোগীর সংখ্যা

ক্যালেন্ডারের পাতায় বর্ষাকাল শেষ হলেও এখনো থামেনি বৃষ্টি। ভাদ্রমাসের তালপাকা গরমে মাঝে মাঝে হচ্ছে স্বস্তির বৃষ্টিও। কিন্তু যত স্বস্তিই হোক, এই বৃষ্টি আবার ডেঙ্গুর প্রজনন বাড়তে সাহায্য করছে। বৃষ্টির পর জমা পানিতে এডিসের লার্ভা পূর্ণরূপ লাভ করে বাড়ছে ডেঙ্গু মশা। এতে প্রতিদিনই বাড়ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত মৃত্যুর সংখ্যা। শুধু সেপ্টেম্বরের প্রথম ১৩ দিনে দেশে ডেঙ্গুতে মৃত্যু হয়েছে ২০ জনের, আক্রান্ত হয়েছে পাঁচ হাজার চারজন। এতে চলতি বছর ডেঙ্গুতে মোট মৃত্যু হয়েছে ১০৩ জনের।

আর আক্রান্ত ছাড়িয়েছে ১৮ হাজারের ঘর। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, সেপ্টেম্বরের তারিখে মৃত্যু হয়েছে তিনজনের। সময় নতুন করে আক্রান্ত হয়েছেন ৪৭৮ জন। এরপর সেপ্টেম্বর আরও একজন করে মৃত্যুবরণ করেন। এর পরদিন অর্থাৎ তারিখ মারা যায় আরও দুজন। তারিখ আবার তিনজন মারা যায়। সর্বশেষ শুক্রবার নতুন করে আক্রান্ত হয় ১৯৬ জন। সব মিলিয়ে ১৩ দিনে ২০ জনের ঘটনায় বিশেষজ্ঞদের কপালে চিন্তার ভাঁজ পড়েছে। তারা বলছেন, নগরীতে মশা নিধনে যে ধীরগতি এসেছে, তার ফলেই বাড়ছে এডিস মশার প্রজনন। থেমে থেমে বৃষ্টিও এর অন্যতম কারণ। এমন পরিস্থিতি থেকে উত্তরণে আবারও মশা মারতে বিশেষ ব্যবস্থা গ্রহণের দাবি জানিয়েছেন তারা। এমন পরিস্থিতিতে সেপ্টেম্বরের শেষে ডেঙ্গুর সংক্রমণ মারাত্মক আকার ধারণ করার আশঙ্কা করছেন বিশেষজ্ঞরা।

দেশে সাধারণত জুলাই, আগস্ট, সেপ্টেম্বরে ডেঙ্গুর প্রকোপ শুরু হলেও চলতি বছর এর আগেই এর দৌরাত্ম্য শুরু হয়ে গিয়েছিল।

জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাণিবিদ্যা বিভাগের অধ্যাপক কীটতত্ত্ববিদ . কবিরুল বাশার জনকণ্ঠকে বলেন, এখনো প্রতিদিনই বৃষ্টি হচ্ছে। তাই সেপ্টেম্বরের শেষে পরিস্থিতি কী দাঁড়াবে তা নিয়ে আমরা আতংকিত। আমরা ঢাকা, চট্টগ্রাম, কক্সবাজার, চাঁদপুর, বরিশালসহ কয়েকটি জেলায় মশার ঘনত্ব পরীক্ষা করেছি। এসব জেলায় মশার ঘনত্ব অত্যধিক। এখনই মশা নিধনে কার্যকর ব্যবস্থা নিতে হবে। কার্যকর ব্যবস্থা বলতে শুধু সিটি করপোরেশন একা নয়, সরকারের সবগুলো সংস্থার সমন্বয়ে একটি কমিটি গঠন করে মশা নিধনে পরিকল্পিত পদক্ষেপ নিতে হবে এবং অবশ্যই এতে জনসধারণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের রোগ নিয়ন্ত্রণ শাখার আওতাধীন জাতীয় ম্যালেরিয়া নির্মূল এডিসবাহিত রোগনিয়ন্ত্রণ কর্মসূচির অধীনে গত ১৭ থেকে ২৭ এপ্রিল পর্যন্ত চালানো প্রাক-বর্ষা জরিপে বলা হয়, রাজধানীর প্রায় ১৫ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। ঢাকা উত্তরের ১৪.৩০ শতাংশ এবং ঢাকা দক্ষিণের ১৪.৯৮ শতাংশ বাড়িতে এডিস মশার লার্ভা পাওয়া গেছে। দুই সিটির ৯৯টি ওয়ার্ডের মধ্যে ১৮টিতে ব্রুটো ইনডেক্স ২০ এর বেশি। এর অর্থ হচ্ছে, এসব এলাকার ১০০টির মধ্যে ২০টির বেশি পাত্রে মশা বা লার্ভা পাওয়া গেছে। এই এলাকাগুলো ডেঙ্গুর বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। বর্ষার শেষ দিকে পরিস্থিতি কি হবে তা ভাবতে পারছেন না খোদ বিশেষজ্ঞরা।

স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের মুখপাত্র অধ্যাপক ডা. মো. নাজমুল ইসলাম জনকণ্ঠকে বলেন, গত কয়দিন দেশের বিভিন্ন জায়গায় বিক্ষিপ্তভাবে বৃষ্টি হয়েছে। বৃষ্টির পানি জমে থাকায় এডিস মশার প্রজননের সম্ভাবনা বেশি। এডিস মশার জীবনচক্র ডিম পাড়ার পরবর্তী সময় থেকে চারটি ধাপে ডিম, লাভা পিউপা এবং পূর্ণাঙ্গ অবস্থা সম্পন্ন হয়। তার জন্য এক সপ্তাহ বা কয়েক সপ্তাহ সময় লাগতে পারে। স্ত্রী এই মশাগুলো বন্যার সময় জলাধার, গাছের গর্ত বা উদ্ভিদ অক্ষের কাছাকাছি কালো রঙের ডিম জমা করে। ডিম পাড়ার জন্য সবচেয়ে উপযোগী জায়গা হচ্ছে মানুষের তৈরি জিনিসপত্র যেমন মাঠির পাত্র, প্লাস্টিকের বোতল এবং গাড়ির চাকা। পানিতে নিমজ্জনের পর ডিম থেকে বাচ্চা ফোটার এই প্রক্রিয়াটি কয়েকদিন বা কয়েক সপ্তাহ পর্যন্ত সময় লাগে। সেই হিসেবে আগামী দুই সপ্তাহ একটু বেশি ঝুঁকিপূর্ণ। এসময় নিজেকে মশার কামড় থেকে রক্ষার পাশাপাশি বাড়ির আঙ্গিনায় পরিস্কার-পরিচ্ছন্ন রাখতে হবে। না হলে মাসের শেষে আক্রান্তের সংখ্যা আরও বাড়বে।

বিশেষজ্ঞরা বলছেন, ডেঙ্গুর মৌসুম শুরু হয় মূলত বর্ষাকালে। আগস্ট থেকে বাড়তে থাকে এর ভয়াবহতা। কিন্তু চলতি বছর মার্চের মাঝামাঝি থেকেই দেশের বিভিন্ন জায়গায় বৃষ্টি শুরু হয়। এতে করে এডিস মশা তাদের প্রজননে উপযুক্ত আবহাওয়া পেয়ে গেছে বর্ষার আগেই। এখনো এর ধারাবাহিকতা অব্যাহত রয়েছে। আর এর অন্যতম কারণ হিসেবে ডেঙ্গুর প্রজননস্থল ধ্বংসে ব্যর্থতাকে দায়ী করছেন তারা। একই সঙ্গে আবহাওয়ার তারতম্যও সমানভাবে দায়ী উল্লেখ করে তারা বলছেন, এখনই এডিসের জীবাণুবাহী মশার প্রজননস্থল ধ্বংস না করতে পারলে পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যেতে পারে।

এমন যখন পরিস্থিতি তখন কীটতত্ত্ববিদসহ বিশেষজ্ঞ চিকিৎসকরা বার বার তাগিদ দিচ্ছেন মশা নিয়ন্ত্রণের। মশা নিয়ন্ত্রণ ছাড়া পরিস্থিতি কোনোভাবেই নিয়ন্ত্রণে আনা যাবে না বলেও সতর্ক করছেন তারা। করোনার সময় যেভাবে সরকারের সঙ্গে সাধারণ মানুষেরও সংশ্লিষ্টতা ছিল ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে তা একেবারে নেই। মাস্ক, সামাজিক দূরত্ব, হ্যান্ড স্যানিটাইজার, পিপিই, আইসোলেশন, কোয়ারেন্টাইনের মতো কঠিন কঠিন শব্দ ছাড়া শুধুমাত্র মশা নিধন করেই যে রোগ নিয়ন্ত্রণ করা যায় তাতেও যেন সায় নেই কারও। এতে করে দিনের পর দিন করুণ মৃত্যু বরণ করে নিতে হচ্ছে ডেঙ্গু আক্রান্ত রোগীদের। বিষয়ে জনস্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞ ডা. লেনিন চৌধুরী জনকণ্ঠকে বলেন, করোনার সময়টায় উন্নত বিশ্বের পরিস্থিতি দেখে জনগণের মধ্যে একটা আতংক তৈরি হয়েছিল। ডেঙ্গুর ক্ষেত্রে যা হচ্ছে না। ডেঙ্গু বাংলাদেশেই তীব্রতা চালাচ্ছে। পার্শ্ববর্তী দেশ ভারতেরও কিছু কিছু জায়গায় ডেঙ্গু রোগী বাড়ছে। কিন্তু তারা নিয়ন্ত্রণে তৎপর। যে তৎপরতটা প্রয়োজন ছিল আমাদের। করোনার সময় যেমন একটা গাইড লাইন, কারিগরি কমিটি তৈরি করে দেওয়া হয়েছিল, তেমনি এখনো তার প্রয়োজন ছিল।

যেহেতু এর চিকিৎসা নেই তাই প্রতিরোধই গুরুত্বপূর্ণ। এক্ষেত্রে সামাজিক আন্দোলন গড়ে তোলার বিকল্প নেই। সাধারণ মানুষ যদি না বোঝে যে মশার কামড়ে তার মৃত্যু হতে পারে। তাহলে কে বোঝাবে? কিন্তু ইচ্ছে থাকলেও মশা থেকে রক্ষা পাওয়ার কোনো উপায় নেই রাজধানীবাসীর। বেশিরভাগ এলাকাতেই সাম্প্রতিক সময়ে মশা মারার কোনো কার্যক্রম চোখে পড়ে না বলে অভিযোগ এলাকাবাসীর। নিজের এলাকায় সিটি করপোরেশনের মশা মারার ধোঁয়ার মেশিন গত একমাসে দেখেননি অভিযোগ করে রাজধানীর মধুবাগ এলাকার বাসিন্দা খালেদা আক্তার বলেন, দুই ছেলে স্বামী নিয়ে থাকি। মশা থেকে বাঁচতে কয়েল জ্বালাই। ডেঙ্গু বাড়ায় কয়েলের দামও বেড়েছে। সিটি করপোরেশন থেকে এলাকায়ও মশার ওষুধ ছিটালে ডেঙ্গুর চিন্তায় রাতের ঘুম উজাড় হতো না।

একই অভিযোগ করে রাজধানীর নিউ ইস্কাটন এলাকার দোকানি আক্কাস মাহমুদ বলেন, গত এক মাসে সিটি করপোরেশনের মশা মারার কোনো মেশিন চোখে পড়ে নাই। রাতে তো মশার কামড়ে ঘুমানো মুশকিল। দিনেও মাঝে মাঝে কামড়ায়। কোনটা যে এডিস আর কোনটা যে কী তা তো জানি না। জন্য ছোট বাচ্চাগুলোকে নিয়ে সব সময় আতংকিত থাকতে হয়।

পুরান ঢাকার বিভিন্ন অলি-গলিতেও কোনোদিন ফগার মেশিন দেখতে পাওয়া যায় না বলে অভিযোগ করে নাজিমুদ্দিন রোডের বাসিন্দা ফজলুর রহমান বলেন, দিনের বেলায়ও মশার জন্য ঘরে থাকা যাচ্ছে না। রাতে তো আরও ভয়াবহ হয় পরিস্থিতি

তবে মশা মারতে নিজেদের কার্যক্রম স্বাভাবিক চালু আছে বলে দাবি করেন দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের এক কর্মকর্তা। নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ওই কর্মকর্তা বলেন, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে নগর ভবনে একটা দৃশ্যমান পরিবর্তন এসেছে তা আপনারা জানেন। তবু মশা মারতে আমরা নিয়মিত কার্যক্রম চালু রাখার চেষ্টা করেছি। এখনো যা চালু রয়েছে।

প্রসঙ্গত, ২০২৩ সালের প্রথম তিন মাসে ৮৪৩ জন আক্রান্ত হয়েছিলেন এবং মারা গিয়েছিলেন জন। এর মধ্যে জানুয়ারি মাসে ৫৬৬ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হন এবং ছয়জন মারা যান। ফেব্রুয়ারিতে আক্রান্ত ১৬৬ এবং মৃত্যু তিনজন, মার্চে আক্রান্ত ১১১ জন এবং কেউ মারা যাননি। ওই বছর দেশে রেকর্ড পরিমাণ মানুষ ডেঙ্গু আক্রান্ত হন এবং মারা যান। বছরটিতে লাখ ২১ হাজার ১৭৯ জন ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়েছিলেন। আর ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাজার ৭০৫ জনের মৃত্যু হয়েছিল।

সাম্প্রতিক বছরগুলোর পরিসংখ্যান বিবেচনায়, ডেঙ্গুর ভয়াবহতা বেশি হয় ২০০০ সালে। ওই বছর সরকারি হিসাবমতে, পাঁচ হাজার ৫০০ মানুষ ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয় এবং ৯৩ জন মারা যায়। সরকারি হিসাব মতে, ২০২২ সালে ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা ৬২ হাজার ৩২১ মৃত্যু হয়েছে ২৮১ জনের। ২০২৩ সালের শুরু থেকে পর্যন্ত সারাদেশে ডেঙ্গু রোগ নিয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়ে যারা চিকিৎসা নিয়েছে তাদের প্রায় অর্ধেক ঢাকার বাইরের জেলার।

 

×