ঢাকা, বাংলাদেশ   বুধবার ১৮ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২ আশ্বিন ১৪৩১

চাঁদাবাজি ও পরিবহন খাতে সিন্ডিকেট ছিল প্রধান হাতিয়ার

শাজাহান খান হাতিয়ে নিয়েছেন ১৫ হাজার কোটি টাকা

শংকর কুমার দে

প্রকাশিত: ০০:৪২, ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪

শাজাহান খান হাতিয়ে নিয়েছেন ১৫ হাজার কোটি টাকা

শাজাহান খান

বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-জনতার আন্দোলনে ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকারের সময়ের সাবেক নৌপরিববহনমন্ত্রী ও সাবেক এমপি আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান ছিলেন সারাদেশের পরিবহন সেক্টরের মাফিয়া ডন। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি ছিলেন দোর্দ- প্রতাপশালী পরিবহন শ্রমিক নেতা শাজাহান খান।

শাজাহান খান নিজে পরিবহন শ্রমিক না হলেও তিনি পরিবহন শ্রমিক সংগঠনের নেতা সেজে সারাদেশের পরিবহন সেক্টরে কোটি কোটি টাকার চাঁদাবাজি করার জন্য গড়ে তুলেছিলেন তার নিজস্ব পরিবহন সিন্ডিকেট। গত ১৫ বছরে পরিবহন খাতের চাঁদাবাজির আয়ের উৎস দিয়ে ধন সম্পদের পাহাড় গড়ে তুলেছেন তিনি।

আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ১৫ বছরে পরিবহন সেক্টরের ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি করেছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান ও তার পরিবহন সিন্ডিকেট। আওয়ামী লীগ সরকার ক্ষমতায় থাকতে কথায় কথায় পরিবহন ধর্মঘট ডেকে সরকার অচল করে দেওয়ার হুমকি দেওয়ার এই নেতা শাজাহান খানকে গ্রেপ্তার করে রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ শেষে কারাগারে পাঠানো হয়েছে।

শাজাহান খানের অবৈধভাবে অর্জিত হাজার হাজার কোটি টাকার আয়ের উৎসের সন্ধানে তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
দুর্নীতি দমন কমিশনের আমলে নেওয়া অভিযোগে জানা গেছে, ‘মন্ত্রিত্ব নয় আলাদিনের চেরাগ পেয়েছিলেন শাজাহান খান’। এক যুগ আগেও তার ঢাকা শহরে ছিল না কোনো ফ্ল্যাট বা জমি। মন্ত্রিত্ব পাওয়ার আগে তার মাসিক আয় ছিল ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা। মন্ত্রী হবার পর তার সম্পদ বেড়েছে প্রায় শতগুণ। নিজ জেলা মাদারীপুর আর ঢাকা শহরে গড়েছেন সম্পদের পাহাড়। আছে আবাসন, হোটেল ও শিপিং ব্যবসা।

পরিববহন খাতে চাঁদাবাজির একক গডফাদার শাজাহান খান। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য শাজাহান খান ও তাঁর স্ত্রীর সম্পদ ১৫ বছরে বেড়েছে অস্বাভাবিক হারে। বেড়েছে বার্ষিক আয়ও। মাদারীপুর শহরে মুকুটহীন সম্রাট শাজাহান খানের দৃশ্যমান সম্পত্তির মধ্যে আছে ১০ তলা একটি বাসভবন, ৬ তলা একটি হোটেল, আছে সার্বিক ফুড ভিলেজ। মাদারীপুর স্কুল অ্যান্ড কলেজের জমি দখল করে সেখানে গড়ে তোলেন ৪ তলা ভবন। একই শহরে রয়েছে তার ৩টি পেট্রোল পাম্প, ৪ তলা ভবনে নিজের বাবার নামে আসমত আলী খান হাসপাতাল।

এ ছাড়া সার্বিক পরিবহনের মালিকও তিনি ও তার পরিবার। ভাইদের আছে অঢেল সম্পত্তি। রাজধানীতে সাবেক এই মন্ত্রীর রয়েছে একাধিক বাড়ি। মাদারীপুর-২ নম্বর আসন থেকে টানা ৮ বারের এমপি ও ২ বার নৌপরিবহনমন্ত্রী ছিলেন শাজাহান খান। জেলার সবকিছুই ছিল তাদের নিয়ন্ত্রণে। ছোট ভাই হাফিজুর রহমান যাচ্চু খান জেলার টেন্ডার নিয়ন্ত্রণ করতেন।
দুর্নীতি দমন কমিশনে দেওয়া অভিযোগে জানা গেছে, মাদারীপুরে তার ছোট ভাই যাচ্চু খানের যত টেন্ডারবাজি-কিশোরগ্যাং থেকে শুরু করে সবই তার নেতৃত্বে হয়েছে। তা মাদারীপুরের আনাচে-কানাচের সকল লোকজনই জানেন। অনেকে মুখ খুলতে পারে না ভয়ের কারণে। শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি থাকাকালে শ্রমিকদের দিয়ে চাঁদাবাজি, তার ভাই টেন্ডারবাজি করেছে মাদারীপুর শহরে, অন্য ভাইরা ভূমিদস্যুতা, ব্যাপক সন্ত্রাসী-লুটপাট চালিয়েছে মাদারীপুরে।

এ ছাড়া মন্ত্রী থাকা অবস্থায় চট্টগ্রামের বন্দরও ছিল ছোট ভাই যাচ্চু খানের হাতে। আর এক ভাই অ্যাডভোকেট ওবায়েদুর রহমান কালু খান ছিলেন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি ও উপজেলা চেয়ারম্যান। টেন্ডারবাজি, ভূমি দখল, কিশোরগ্যাং নিয়ন্ত্রণ, মাদক নিয়ন্ত্রণসহ ভয়ংকর সব অভিযোগ শাজাহানের পরিবারের বিরুদ্ধে। বিএনপি, জামায়াতসহ সাধারণ মানুষ এখন পর্যন্ত তার বিরুদ্ধে কথা বলতে সাহস পায় না। বছরের পর বছর শ্রমিক ফেডারেশনের নির্বাহী সভাপতির পদে থেকে তিনি হয়ে ওঠেন পরিবহন জগতের কিং। কাজ করেন স্বৈরাচার সরকারের লাঠিয়াল বাহিনীর সর্দার হিসেবে।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট দুর্নীতি দমন কমিশনের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় আসার পর ২০০৯ থেকে ২০২৪ সাল পর্যন্ত গত ১৫ বছরে পরিবহন সেক্টরে ১৫ হাজার কোটি টাকার বেশি চাঁদাবাজি করেছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান ও তার পরিবহন সিন্ডিকেট। সারাদেশের পরিবহন সেক্টর থেকে এই টাকা চাঁদাবাজি করে হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে বলে অভিযোগ উঠেছে।

সড়ক পরিবহনে সংগঠন পরিচালনা ব্যয় সংক্রান্ত নির্দেশিকা প্রণয়ন করে এই চাঁদাবাজিকে বৈধতাও দেওয়া হয়েছে। এই ধরনের চাঁদাবাজি পরিবহন মালিকদের ইচ্ছার বিরুদ্ধে জোরপূর্বক আদায় করে শাজাহান খান ও তার পরিবহন সিন্ডিকেট ভাগবাটোয়ার করে হাতিয়ে নিয়েছেন বলে অভিযোগ ওঠার পর তদন্ত শুরু করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন ও আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। 
গত ৯ সেপ্টেম্বর দুর্নীতি দমন কমিশনকে (দুদক) চিঠি দিয়ে সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানের বিরুদ্ধে অভিযোগ করেছেন ঢাকা সিএনজি অটোরিক্সা মালিক সমিতি। সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানসহ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের তিন নেতাদের বিরুদ্ধে ক্ষমতার অপব্যবহার করে গত চার বছরে প্রায় ৬ হাজার ৯৫ কোটি টাকা আত্মসাৎ করার অভিযোগে করেছেন সংগঠনটি।

এই সমিতির সাধারণ সম্পাদক হানিফ খোকন অভিযোগ করেছেন, সড়ক পরিবহন আইনের তোয়াক্কা না করে তারা চাঁদাবাজির মাধ্যমে এ অর্থ আত্মসাৎ করেছেন। বিষয়টি নিয়ে বারবার সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে জানানো হলেও এতদিন কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। শাজাহান খান ছাড়া বাকি অভিযুক্তরা হলেন সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী ও যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক মোখলেছুর রহমান। চিঠিতে দুদককে অভিযোগ তদন্ত করে শীঘ্র ব্যবস্থা নেওয়ার দাবিও জানানো হয়েছে।
দুর্নীতি দমন কমিশনের আমলে নেওয়া অভিযোগে জানা গেছে, সড়কে চাঁদাবাজিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দিয়েছেন বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খান। ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ২৪৯ শ্রমিক ইউনিয়নের মাধ্যমে চাঁদা তোলা হয়েছে। এর একটি বড় অংশ নিয়মিত গেছে শাজাহান খানের পকেটে। ফেডারেশনের শীর্ষ নেতা হওয়ার সুবাদে পরিবহন মালিক সমিতির অপর প্রভাবশালী নেতাকে সঙ্গে নিয়ে সড়ক থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন।

তার ছিল মাস্তান বাহিনী। এ বাহিনীর কাছে বছরের পর বছর জিম্মি পরিবহন মালিকরা। বিগত সময়ে বিএনপির নির্দলীয় তত্ত্বাবধায়ক সরকারের দাবিসহ অন্যান্য দাবিতে বৃহৎ পরিসরে আন্দোলনের ডাক দিলেই বন্ধ হয়ে গেছে সড়কের যান চলাচল। এর নেপথ্যেও ছিলেন এই শাজাহান খান। সড়কের নিরাপত্তা নিশ্চিতে কঠোর শাস্তির বিধান রেখে সড়ক পরিবহন আইন প্রণয়নের অন্যতম বাধাও ছিলেন তিনি। সারাদেশের পরিবহন সেক্টরের সরকারের শৃঙ্খলা ফেরাতে উদ্যোগের অন্যতম বাধা ছিলেন শাজাহান খান।
পরিবহন শ্রমিক নেতাদের সঙ্গে আলাপ করে জানা গেছে, সড়ক পরিবহন আইনে রাস্তা থেকে চাঁদা উঠানোর কোনো বিধান নেই। এরপরও পরিবহন খাতে বেপরোয়া চাঁদাবাজির নেতৃত্বে ছিলেন শাজাহান খান। বিভিন্ন টার্মিনাল, উপজেলা পর্যায়ে চাঁদা তুলে পাঁচ ভাগের এক ভাগ বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের নামে গেছে। এই ফেডারেশনের সবকিছুই চলেছে শাজাহান খানের ইশারায়।

শাজাহান খান ও সহযোগীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে পরিবহনে চাঁদাবাজির স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। চাঁদাবাজির আয়ে পরিবার, পরিজন, আত্মীয়স্বজনের নামে তারা বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ ও সম্পদ করেছেন। পরিবহন শ্রমিক নেতারা বলেছেন, বর্তমান অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টার কাছে আমাদের আবেদন, অনতিবিলম্বে তদন্ত করে এসব অবৈধ সম্পত্তি জব্দ করে রাষ্ট্রীয় কোষাগারে জমা দেওয়া হোক।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পরপরই পরিবহন খাতে অপ্রতিরোধ্য হয়ে ওঠেন নেতা শাজাহান খান। আওয়ামী লীগ সরকারের নৌপরিবহনমন্ত্রী থাকাকালে সরকারের বিরুদ্ধে পরিবহন ধর্মঘটে উস্কানি দিয়ে সরকারকে বেকায়দায় ফেলে নিজের ক্ষমতার দাপট দেখিয়েছেন তিনি।

শাজাহান খান এতই দাপটশালী পরিবহন শ্রমিক নেতা ছিলেন যে তিনি পরিবহন ধর্মঘটের ডাক দিলেই সরকারের স্বাভাবিক চলাচলে অচলাবস্থা দেখা দেয়ায় তাকে সমীহ করে চলতে হয়েছে। ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত পরিবহন খাতে একচ্ছত্র প্রভাব ছিল তার। ২০০৯ সাল থেকে সড়কে বিক্ষিপ্ত আকারে নানা অঙ্কের চাঁদা তোলা হতো। করোনাকালে সরকার লকডাউন ঘোষণা করলে গণপরিবহন চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

পরে ২০২৪ সালের ১ জুন থেকে গণপরিবহন চালুর সিদ্ধান্ত হয়। আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কঠোর অবস্থানে ২০২০ সালের জুন, জুলাই ও আগস্ট এই ৩ মাস সড়কে চাঁদা তোলা বন্ধ ছিল। এ সময় চাঁদা তোলার নতুন ফন্দি আঁটা হয়। প্রণয়ন করা হয় সড়ক পরিবহন সংগঠন পরিচালনা ব্যয় বা সার্ভিস চার্জসংক্রান্ত নির্দেশিকা।

এ নির্দেশিকা প্রণয়নের সঙ্গে যুক্ত ছিল বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন মালিক সমিতি, সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন, বাস ট্রাক ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন, ট্রাক ও কাভার্ড ভ্যান মালিক সমিতি। শাজাহান খান ও তার পরিবহন সিন্ডিকেট নিজেরা নিয়মনীতি করে পরিবহনের ব্যয় তোলার নামে যে চাঁদাবাজি করেছেন তা ছিল ওপেন সিক্রেট।

মালিকরা অভিযোগ করেছেন, পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রক ছিলেন আওয়ামী লীগ সরকারের আমলের নৌমন্ত্রী শাজাহান খান। সরকারের বাসভাড়া নির্ধারণের ক্ষেত্রেও ব্যাপক প্রভাব ছিল শাজাহান খানের সিন্ডিকেটের। উপরন্তু সরকার নির্ধারিত ভাড়া না মানলেও পরিবহন কোম্পানির বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে পারত না সরকার। আবার পণ্য পরিবহনে বাড়তি ভাড়া আদায়েও শাজাহান খানদের ইন্ধন ছিল।

তাদের কথাই ছিল সড়কে আইন। ক্ষমতাচ্যুত আওয়ামী লীগ সরকার সড়ক আইন প্রণয়ন করলেও শাজাহান খানদের চাপে আইনের ধারা শিখিল করে। শাজাহান খানের ইশারাতেই কথায় কথায় যান চলাচল বন্ধ রেখে মানুষের ভোগান্তিকে জিম্মি করে দাবি আদায় করত পরিবহন কর্মীরা। এক কথায় শাজাহান খান ছিলেন পরিবহন খাতের মাফিয়া ডন।

পরিবহন মালিকদের অভিযোগ আমলে নেওয়া তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে, সরকারে থেকেও পরিবহন খাতের জন্য বিকল্প সরকারের ভূমিকায় ছিল শাজাহান খানের অনুসারীরা। পরিবহন খাতে অন্যায়ভাবে চাঁদাবাজিকে বৈধতা দিয়েছিলেন শাজাহান খান-ওসমান আলী গ্রুপ। বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের বিভিন্ন শ্রমিক গ্রুপগুলোর সবাই চলেছে শাজাহান খানের ইশারায়। গত ১৫ বছরে পরিবহন খাতের নিয়ন্ত্রকের ভূমিকায় শাজাহান খান ছাড়াও ছিলেন ঢাকা সড়ক পরিবহন সমিতির সাধারণ সম্পাদক খন্দকার এনায়েত উল্ল্যাহ ও সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সাধারণ সম্পাদক ওসমান আলী।

চাঁদাবাজিকে প্রাতিষ্ঠানিক রূপ দেওয়ার অভিযোগ আছে বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের সভাপতি শাজাহান খানের বিরুদ্ধে। ওই সময় ফেডারেশনের অন্তর্ভুক্ত ২৪৯টি শ্রমিক ইউনিয়নের মাধ্যমে চাঁদা তোলা হতো। এর একটি বড় অংশ নিয়মিত গেছে শাজাহান খানের পকেটে। ফেডারেশনের শীর্ষ নেতা হওয়ার সুবাদে পরিবহন মালিক সমিতির অপর প্রভাবশালী নেতাদের সঙ্গে নিয়ে সড়ক থেকে কোটি কোটি টাকা চাঁদাবাজি করেছেন তিনি।
সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশন ও মালিক সমিতির নির্দেশিকার ৪১টি ধারায় সড়কে চাঁদাবাজিকে দেওয়া হয় প্রাতিষ্ঠানিক রূপ। নির্দেশিকায় ঢাকা মহানগর এলাকা ও শহরতলির মধ্যে কোথায়, কোন রুটে, কে চাঁদা তুলবে, আন্তঃজেলায় চলা যানবাহনে ঢাকার কোন স্পটে কারা চাঁদা তুলবেÑ তা নির্ধারণ করে দেওয়া হয়। মালিক সমিতি ও শ্রমিক ইউনিয়নগুলোর চাঁদা তোলার বিষয়ে বিস্তারিত বলা হয়েছে নির্দেশিকায়।

নির্দেশিকা অনুযায়ী প্রতিদিন একটি বাণিজ্যিক যানবাহন থেকে একবার ৫০ টাকা হারে চাঁদা তোলার কথা। কিন্তু বাস্তবে একদিনে ১৫ থেকে ২০ বারও চাঁদা দিতে হচ্ছে এসব যানবাহনকে। শাজাহান খানের অনুসারিদের কাছে বছরের পর বছর জিম্মি ছিলেন পরিবহন মালিকরা। শাজাহান খান ও তার সহযোগীরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে পরিবহনে চাঁদাবাজির স্বর্গরাজ্য গড়ে তুলেছিলেন। চাঁদাবাজির আয়ে পরিবার, পরিজন, আত্মীয় স্বজনের নামে তারা বিপুল পরিমাণ নগদ অর্থ ও সম্পদ করেছেন।

সরকারবিরোধী আন্দোলন ঠেকাতে কখনো পূর্ব ঘোষণা ছাড়াই, আবার কখনো নানা অজুহাতে ধর্মঘটের ডাক দিয়ে গণপরিবহন চলাচল বন্ধের নেপথ্যে ছিলেন শাজাহান খান। পরিবহন ধর্মঘটের কারণে প্রত্যন্ত অঞ্চল থেকে আন্দোলনে যোগ দিতে আসতে পারেননি অনেক নেতাকর্মী। এতে সাধারণ মানুষও চরম দুর্ভোগে পড়েছেন।
তদন্ত সংশ্লিষ্ট সূত্র জানান, ২০১৮ সালে ঢাকায় বাসচাপায় দুই কলেজ শিক্ষার্থী নিহত হওয়ার ঘটনায় নিরাপদ সড়কের দাবিতে আন্দোলনের সময় সড়ক পরিবহন শ্রমিক নেতা শাজাহান খান বিতর্কিত মন্তব্য করে সমালোচিত হন। শিক্ষার্থীরা রাজপথে আন্দোলনে নামে। এ ছাড়া বিভিন্ন সময় সড়ক দুর্ঘটনার জেরে ছাত্র-জনতার নিরাপদ সড়কের দাবিতে করা আন্দোলনেরও সমালোচনা করেছেন শাজাহান খান।

২০১১ সালের ১৮ আগস্ট নৌ মন্ত্রণালয়ের সভাকক্ষে তৎকালীন নৌমন্ত্রী শাজাহান খান বলেছিলেন, অশিক্ষিত চালকদেরও লাইসেন্স দেওয়া দরকার। কারণ তারা সিগন্যাল চেনে, গরু-ছাগল চেনে, মানুষ চেনে। সুতরাং তাদের লাইসেন্স দেওয়া যায়। তার এমন বক্তব্য গণমাধ্যমে প্রচার হলে সর্বমহলে তীব্র সমালোচনা হয়। 
ঢাকা সড়ক পরিবহন মালিক সমিতির আহব্বায়ক সাইফুল আলম জানিয়েছেন, কিছু অসাধু বাস মালিক নেতার সঙ্গে আঁতাত করে পরিবহন খাতকে নাজেহাল করেছেন শাজাহান খান ও তার পরিবহন সিন্ডিকেট। অনেক মালিক তার কাছে জিম্মি হয়ে পড়েছিলেন। পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনকে তার ইচ্ছেমতো ব্যবহার করেছেন। ঢাকা-মাদারীপুর রুটের সার্বিক পরিবহন কোম্পানিতে একক আধিপত্য ছিল শাজাহান খানের।

বাংলাদেশ সড়ক পরিবহন শ্রমিক ফেডারেশনের ভারপ্রাপ্ত সাধারণ সম্পাদক হুমায়ুন কবির খান সম্প্রতি সংবাদ সম্মেলনে বলেছেন, শাজাহান খান ও ওসমান আলীর নেতৃত্বে বাংলাদেশের অধিকাংশ জেলার টার্মিনালগুলোতে শ্রমিক স্বার্থের পরিবর্তে বিরোধী দলের গণতান্ত্রিক আন্দোলন নস্যাৎ করার জন্য পেশাজীবী শ্রমিক সংগঠনের পক্ষে কাজ করাতে তৎকালীন নেতারা বাধ্য করতেন। নির্বাচনী হলফনামায় দেওয়া তথ্য অনুযায়ী, ২০০৮ সালে শাজাহান খানের বার্ষিক আয় ছিল ৬ লাখ ৮৫ হাজার টাকা। যা ২০২৪ সালে হয়েছে ২ কোটি ২১ লাখ টাকা।

এ সময়ে শাজাহান খানের আয় বেড়েছে প্রায় ৩২ গুণ। নির্বাচনী ব্যয়ের হলফনামায় যেখানে ৩২ গুণ আয় বেড়েছে সেখান অপ্রদর্শিত আয় আরও বহু গুণ বেড়েছে এমন অভিযোগে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক) তদন্ত শুরু করেছে।
ডিএমপির অতিরিক্ত পুলিশ কমিশনার (গোয়েন্দা) রেজাউল করিম মল্লিক জানিয়েছেন, আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও সাবেক মন্ত্রী শাজাহান খানকে রাজধানীর ধানমন্ডি থেকে যৌথ বাহিনী গ্রেপ্তার করেছে।
তার বিরুদ্ধে বিরুদ্ধে পরিবহন খাতে চাঁদাবাজি ও নৈরাজ্য সৃষ্টির অভিযোগ রয়েছে। শাজাহান খান ও তার ভাই, ছেলেসহ পরিবারের অন্য সদস্যদের বিরুদ্ধেও জ্ঞাত আয় বহির্ভূত বিপুল সম্পদ অর্জনের তথ্য থাকার অভিযোগ রয়েছে দুর্নীতি দমন কমিশনে। 
দুদকের উপপরিচালক মো. আকতারুল ইসলাম জানিয়েছেন, সাবেক নৌপরিবহনমন্ত্রী শাজাহান খানের বিরুদ্ধে অর্থ পাচার, প্রকল্পে অনিয়মসহ দেশে-বিদেশে বিপুল অবৈধ সম্পদ গড়ার অভিযোগ আমলে নিয়ে দুদকের গোয়েন্দা ইউনিটের তথ্য আমলে নিয়ে প্রকাশ্যে অনুসন্ধান করছে। এর আগে তার বিরুদ্ধে অনুসন্ধান টিমের পক্ষ থেকে মঙ্গলবার তলবি নোটিস পাঠানো হয়েছিল। তবে ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে গত ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতনের পর আত্মগোপনে থেকে গ্রেপ্তার হয়েছে।

×