ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ১৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ১ আশ্বিন ১৪৩১

সাংবাদিকদের গণতদন্ত কমিটি

আন্দোলনে শতাধিক শ্রমিক নিহত

বিশেষ প্রতিনিধি

প্রকাশিত: ২২:৫৯, ৭ সেপ্টেম্বর ২০২৪

আন্দোলনে শতাধিক শ্রমিক নিহত

ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শতাধিক শ্রমিক নিহত হয়েছেন

শ্রমিক হতাহতের ঘটনা অনুসন্ধানে গঠিত গণতদন্ত কমিটি জানিয়েছে, ছাত্র-জনতার আন্দোলনে শতাধিক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। তবে এ ঘটনার মামলা হয়নি। শনিবার ঢাকা রিপোর্টার্স ইউনিটিতে (ডিআরইউ) সংবাদ সম্মেলন করে গণতদন্ত কমিটি চূড়ান্ত প্রতিবেদন প্রকাশ করে। সেখানেই সাংবাদিকদের এক প্রশ্নের জবাবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে নিহত শ্রমিকদের বিষয়ে এই তথ্য জানানো হয়।
সরকার পতনের আন্দোলনে কতজন শ্রমিক নিহত হয়েছেন- এমন এক প্রশ্নের জবাবে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক আনু মুহাম্মদ বলেন, এ আন্দোলনে হতাহত শ্রমিকদের সংখ্যা বের করার বিষয়টি প্রক্রিয়াধীন। তবে আনুমানিক শতাধিক শ্রমিক নিহত হয়েছেন। এর আগে মজুরি আন্দোলনে নিহত শ্রমিকদের তথ্য তুলে ধরে তদন্ত কমিটি।

মজুরি আন্দোলনে চারজন শ্রমিক নিহত হওয়ার তথ্য দিয়ে তদন্ত কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, নিহত চারজনের মধ্যে তিনজনকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে। এর মধ্যে একজনকে ঘুমন্ত অবস্থায় গুলি করে মারা হয়েছে।
তিনি বলেন, ১২ হাজার শ্রমিকের বিরুদ্ধে মামলা করা হয়েছে, গ্রেপ্তার করা হয়েছে ৮৮ জনকে। কিন্তু শ্রমিক হত্যার ঘটনায় জড়িতদের বিরুদ্ধে কোনো মামলা করা হয়নি।
ঘুমন্ত অবস্থায় যে শ্রমিককে গুলি করা হয়েছে, তাকে পুলিশ নাকি অন্য কেউ গুলি করেছে? সাংবাদিকদের এমন প্রশ্নের উত্তরে আনু মুহাম্মদ বলেন, ঘুমন্ত অবস্থায় যে শ্রমিক মারা গেছেন, তিনি কারখানায় আগুনে পুড়ে মারা গেছেন। এ সময় সাংবাদিকদের পক্ষ থেকে পাল্টা প্রশ্ন করা হয়- ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলছেন গুলি করে হত্যা করা হয়েছে, কিন্তু আপনি বলছেন- আগুনে পুড়ে মারা গেছে। কোনটা সঠিক? এর উত্তরে ব্যারিস্টার জ্যোতির্ময় বড়ুয়া বলেন, ঘুমন্ত অবস্থায় আগুনে পুড়ে যে শ্রমিক মারা গেছেন, তার শরীরে ছররা গুলি পাওয়া গেছে।
সংবাদ সম্মেলনে তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক আনু মুহাম্মদ বলেন, আমাদের তদন্ত কমিটি গঠন করা নিয়ে প্রশাসন প্রশ্ন তোলে। সুতরাং প্রশাসনও এ হত্যাকাণ্ডে জড়িত ছিল। বিজিএমইএ থেকে কোনো তথ্য আমরা পাইনি। শিল্প পুলিশ শ্রমিকদের দমন-পীড়নে কাজ করেছে। শ্রমিকদের সমস্যা সমাধানে কোনো পদক্ষেপ নেয়নি।
সংবাদ সম্মেলনের মাধ্যমে শিল্প পুলিশ বিলুপ্ত করাসহ তদন্ত কমিটির ৯টি সুপারিশ তুলে ধরা হয়। এর মধ্যে রয়েছে- শ্রমিক হত্যার যথাযথ তদন্ত করে দায়ী ব্যক্তিদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি নিশ্চিত করতে হবে। পুলিশ ও তৎকালীন সরকারি দলের সন্ত্রাসী বাহিনী শ্রমিকদের ওপর হামলা করেছে, গুলি করে হতাহত করেছে তারপর আবার সেই শ্রমিকদের নামেই মিথ্যা মামলা দিয়ে আটক করেছে, নির্যাতন করেছে। হয়রানি এখনো অব্যাহত রেখেছে। অবিলম্বে সবাইকে ক্ষতিপূরণ দিয়ে দায়েরকৃত সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করতে হবে।  
প্রচলিত আইন ভঙ্গ করে কোনো পুলিশ যদি কাউকে খুন কিংবা জখম করে তাহলে ব্যক্তি পুলিশের সঙ্গে সঙ্গে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়কেও তার দায়িত্ব নিতে হবে। আমরা বরাবর দেখছি, শিল্প পুলিশ তার ঘোষিত অবস্থান অনুযায়ী মালিকপক্ষের লাঠিয়াল বাহিনী হিসেবে ভূমিকা পালন করে, যা শিল্প পরিবেশ ক্ষুণœ করে এবং শিল্পাঙ্গনে অনাস্থা ও অনিশ্চয়তা তৈরি করে। সেজন্য শিল্পের স্বার্থেই এই বাহিনী বিলুপ্ত করতে হবে।
সাধারণভাবে পুলিশ যে রাষ্ট্রীয় বাহিনী হবার বদলে ক্ষমতাবান ব্যক্তি ও গোষ্ঠীর ব্যক্তিগত বাহিনী হিসেবে কাজ করে কিংবা দুর্নীতিতে নিমজ্জিত হয়ে শ্রমজীবী মানুষের ওপর নির্যাতন চালায় তার কারণ এর গঠন ও নিয়োগ প্রক্রিয়া। আমলানির্ভর বিদ্যমান নিয়োগ প্রক্রিয়া পরিবর্তন করে পুলিশ কমিশন গঠন করতে হবে। কমিশনে নাগরিকদের সংশ্লিষ্ট করে নতুনভাবে জনগণের কাছে জবাবদিহি নিশ্চিত করে দুর্নীতিমুক্ত নিয়োগ প্রক্রিয়া চালু করতে হবে।
মজুরি নির্ধারণ ও নির্দিষ্ট মেয়াদে তার পুনর্বিন্যাস করার গ্রহণযোগ্য প্রাতিষ্ঠানিক প্রক্রিয়া নিশ্চিত করতে হবে, যাতে মজুরি নিয়ে আন্দোলনে শ্রমিকদের রাস্তায় নামতে না হয়। মজুরি বকেয়া রাখা, জালিয়াতি, প্রতারণা বন্ধ করতে হবে।
কারখানায় সুস্থ কর্মপরিবেশ এবং সব শ্রমিকের সংগঠনের অধিকার নিশ্চিত করতে হবে। শ্রমিকদের সংগঠনের অধিকার বাধাগ্রস্ত করা শাস্তিযোগ্য অপরাধ হিসেবে বিবেচনা করতে হবে। যৌন নিপীড়ন বিরোধী নীতিমালা প্রণয়ন করে তা বাস্তবায়ন করতে হবে। বাংলাদেশে কার্যকর শ্রম আদালত নেই। যতটুকু আছে, তাতে শ্রমিকদের পক্ষে ন্যায়বিচার পাওয়া অসম্ভব।

শ্রম আদালতের সংখ্যা বাড়াতে হবে এবং শ্রমিকদের সমান সুযোগ নিশ্চিত করতে প্রাতিষ্ঠানিক সহায়তা দিতে হবে। শ্রমিক হতাহতের ক্ষতিপূরণ বর্তমানে যেভাবে নির্ধারণ করা হয় তা একেবারেই অগ্রহণযোগ্য, অপমানজনক। ক্ষতিপূরণ এমনভাবে নির্ধারণ করতে হবে যাতে হতাহতের জীবনের জন্য যথেষ্ট হয় এবং একইসঙ্গে তা যাতে অপরাধীর জন্য যথেষ্ট চাপ সৃষ্টি করতে পারে।

×