অবশেষে উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাচ্ছেন গুরুতর অসুস্থ বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এজন্য প্রয়োজনীয় প্রস্তুতি শেষ পর্যায়ে। খালেদা জিয়ার চিকিৎসা বোর্ডের সদস্যদের সঙ্গে লন্ডন থেকে তাঁর পুত্রবধূ ডা. জোবাইদা রহমানসহ ক’জন চিকিৎসক নিয়মিত যোগাযোগ রাখছেন এবং শারীরিক অবস্থার পর্যালোচনা করছেন। সেইসঙ্গে দীর্ঘপথ ভ্রমণের জন্য খালেদা জিয়ার শারীরিক অবস্থা সহনীয় রাখতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করছেন।
চিকিৎসার জন্য খালেদা জিয়াকে লন্ডন নিয়ে যেতে বৃহস্পতিবার সেখান থেকে ঢাকায় এসেছেন তাঁর প্রয়াত ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর স্ত্রী শর্মিলা রহমান সিথি। তিনি এখন খালেদা জিয়ার গুলশানের বাসায় অবস্থান করছেন। ইতোমধ্যেই তিনি খালেদা জিয়ার সার্বিক পরিস্থিতি সম্পর্কে লন্ডনে অবস্থানরত বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমান ও তার স্ত্রী ডা. জোবাইদা রহমানকে অবহিত করেছেন।
এদিকে বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়ার সর্বশেষ শারীরিক অবস্থা সম্পর্কে জানতে ৪ সেপ্টেম্বর গুলশানের বাসা ফিরোজা’য় গিয়ে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করেন ঢাকায় নিযুক্ত ব্রিটিশ হাইকমিশনার সারাহ কুক। দীর্ঘ সাড়ে ৬ বছর পর এই প্রথম কোনো বিদেশী কূটনীতিক তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎ করলেন।
বিএনপি সূত্র জানায়, খালেদা জিয়া উন্নত চিকিৎসার জন্য লন্ডন যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছেন। এ পরিস্থিতিতে খালেদা জিয়ার স্বাস্থ্যের অবস্থা জানতে তার সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে গিয়েছিলেন সারাহ কুক। আর লন্ডনে চিকিৎসা নেওয়া খালেদা জিয়ার জন্য সুবিধাজনক। কারণ, সেখানে তাঁর বড় ছেলে বিএনপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান তারেক রহমানের পরিবার ও ছোট ছেলে আরাফাত রহমান কোকোর পরিবার থাকে। এ ছাড়া লন্ডন বিএনপির বেশ ক’জন প্রভাবশালী নেতা চান তাঁর চিকিৎসা যেন সেখানে হয়।
জানা যায়, এর আগে ২০১৭ সালের ১৬ জুলাই চিকিৎসার জন্য লন্ডনে গিয়েছিলেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। সে সময় লন্ডনের মরফিল্ড হাসপাতালে তার চোখের অপারেশন হয়। এ ছাড়া তখন হাঁটুর ব্যথার জন্যও লন্ডনে চিকিৎসা নেন।
৭৯ বছর বয়সী বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া দীর্ঘদিন ধরে আর্থ্রাইটিস ও ডায়াবেটিস ছাড়াও হৃদরোগ, ফুসফুস, লিভার, কিডনি, পরিপাকতন্ত্র ও চোখের রোগসহ বিভিন্ন জটিল রোগে ভুগছেন। এ কারণে ক’দিন পর পর তাঁকে হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নিতে হয়। তবে তাঁর লিভারের সমস্যা বর্তমানে খুবই খারাপ। তাই বিদেশে গিয়ে তিনি প্রথম লিভারের চিকিৎসা করাবেন। এ ছাড়াও তাঁর অন্যান্য আরও জটিল রোগের উন্নত চিকিৎসা করানো হবে।
খালেদা জিয়ার ব্যক্তিগত চিকিৎসক ও বিএনপির স্থায়ী কমিটির সদস্য অধ্যাপক ডা. এজেডএম জাহিদ হোসেন জানান, তাঁর শরীরের জটিল কিছু সমস্যার জন্য বিদেশে উন্নত চিকিৎসার প্রয়োজন। এজন্যই চিকিৎসা বোর্ডের পরামর্শে তাঁকে বিদেশে নেওয়া হবে। তবে দীর্ঘ ভ্রমণের প্রয়োজনীয় প্রস্তুতির জন্য এতদিন অপেক্ষা করা হয়েছে। আশা করা হচ্ছে দ্রুতই তিনি চিকিৎসার জন্য বিদেশে যাবেন।
উল্লেখ্য, ২০১৮ সালের ৮ ফেব্রুয়ারি দুই মামলায় দন্ডপ্রাপ্ত হয়ে কারাবন্দি হন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। কারাগারে অসুস্থ হয়ে পড়লে পরে তাঁকে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালের প্রিজন সেলের কেবিনে রেখে চিকিৎসার ব্যবস্থা করা হয়। সেখানে থাকা অবস্থায় পরিবারের সদস্যদের আবেদনের পর সরকারের নির্বাহী আদেশে ২০২০ সালের ২৫ মার্চ সাময়িক মুক্তি পান খালেদা জিয়া। ওইদিন থেকেই তিনি গুলশানের বাসা ফিরোজায়। এর পর থেকে ৬ মাস পর পর তাঁর সাময়িক মুক্তির মেয়াদ বাড়ানো হয়। তবে ছাত্র-জনতার আন্দোলনে এ বছর ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকার পদত্যাগ করার একদিন পর দেশের পট পরিবর্তন হলে ৬ আগস্ট স্থায়ী মুক্তি পান খালেদা জিয়া।
২০২১ সালে করোনায় আক্রান্ত হওয়ার পর থেকে বেশ ক’বার এভারকেয়ার হাসপাতালে চিকিৎসা নেন খালেদা জিয়া। করোনায় আক্রান্ত হয়ে ওই বছর ১৫ এপ্রিল এক ঘণ্টার জন্য খালেদা জিয়াকে এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে সিটি স্ক্যান করানো হয়। রিপোর্ট ভালো আসায় ওইদিন তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়নি। ২৭ এপ্রিল খালেদা জিয়াকে আবারও এভারকেয়ার হাসপাতালে নিয়ে সিটি স্ক্যানসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করা হয়। পরীক্ষার রিপোর্ট ভালো না আসায় ওইদিনই তাঁকে ভর্তি করা হয় হাসপাতালে। ৫৪ দিন পর খালেদা জিয়াকে হাসপাতাল থেকে গুলশানের বাসায় নিয়ে যাওয়া হয় ১৯ জুন।
১১৫ দিন পর দ্বিতীয় দফায় ২০২১ সালে ১২ অক্টোবর খালেদা জিয়া আবার এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন। তাঁর শরীরের একটি অংশের চামড়া ফোসকার মতো (চাকা) হয়ে ছিল। এজন্য ২৫ অক্টোবর এভারকেয়ার হাসপাতালে তাঁর বায়োপসি করা হয়। দ্বিতীয় দফায় ২৭ দিন চিকিৎসা নেওয়ার পর খালেদা জিয়া এভারকেয়ার হাসপাতাল থেকে গুলশানের বাসায় ফেরেন ওই বছর ৭ নভেম্বর। এরপর ১৩ নভেম্বর আবারও এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ৮১ দিন চিকিৎসা নেন তিনি। তখন হাসপাতালে ভর্তির পর থেকেই তিনি সিসিইউতে ছিলেন। শারীরিক অবস্থার কিছুটা উন্নতি হওয়ায় ২০২২ সালের ৯ জানুয়ারি তাঁকে সিসিইউ থেকে কেবিনে নেওয়া হয়। ৮১ দিন হাসপাতালে থাকার পর ২০২২ সালের ১ ফেব্রুয়ারি গুলশানের বাসায় ফেরেন খালেদা জিয়া।
২০২২ সালের ৬ এপ্রিল এভারকেয়ার হাসপাতালে গিয়ে রেডিওলজিক্যাল পরীক্ষা, ইমেজিং, ব্লাড ও ইউরিন টেস্ট, লিভার ফাংশন টেস্ট, কিডনি ফাংশন টেস্ট, হার্টের টেস্টসহ বিভিন্ন পরীক্ষা করান খালেদা জিয়া। এরপর ব্যক্তিগত চিকিৎসকরা চিকিৎসা ব্যবস্থায় সামান্য পরিবর্তন আনেন। ১০ জুন রাত সোয়া ৩টায় বুকের ব্যথা নিয়ে চতুর্থ দফায় এভারকেয়ার হাসপাতালের সিসিইউতে ভর্তি হন।
১১ জুন এনজিওগ্রামের পর তাঁর হার্টে ৩টি ব্লক ধরা পড়লে ওইদিনই একটি ব্লকে রিং পরানো হয়। পরদিন দ্রুত এনজিওগ্রাম করে তাঁর হৃৎপিন্ডে ৩টি ব্লক পাওয়া যায়। এর মধ্যে একটি ব্লকে রিং পরানো হয়। রিং পরানোর ক’দিন পর তাঁকে কেবিনে নেওয়া হয়। কেবিনে রেখেই নিবিড় পর্যবেক্ষণে চিকিৎসা চালায় মেডিক্যাল বোর্ড। এভারকেয়ার হাসপাতালে টানা ১৪ দিন চিকিৎসা শেষে ২৪ জুন গুলশানের বাসা ফিরোজায় ফেরেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। এরপর ২২ আগস্ট স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে যান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। তবে পরীক্ষা শেষে রাতেই আবার বাসায় ফেরেন তিনি। এর পাঁচদিন পর ২৭ আগস্ট আবার স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। সেখানে চিকিৎসার পর ৩১ আগস্ট তিনি বাসায় ফেরেন।
২০২৩ সালের ২৭ ফেব্রুয়ারি এভারকেয়ার হাসপাতালে গিয়ে বিভিন্ন শারীরিক পরীক্ষার পর গুলশানের বাসায় ফিরে যান খালেদা জিয়া। ২৯ এপ্রিল সন্ধ্যায় স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য আবার এভারকেয়ার হাসপাতালে যান বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। প্রয়োজনীয় পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে চিকিৎসা বোর্ডের পরামর্শে ওইদিন রাতেই তাঁকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। নিবিড় পর্যবেক্ষণে ৬ দিন চিকিৎসার পর ৪ মে আবার তিনি গুলশানের বাসায় চলে যান। এরপর আবারও ১৩ জুন তিনি এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ৫ দিন চিকিৎসা শেষে ১৭ জুন বাসায় ফেরেন। ৫৩ দিন পর ৯ আগস্ট আবারও চিকিৎসার জন্য এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। প্রয়োজনীয় শারীরিক পরীক্ষা-নিরীক্ষা শেষে ওইদিনই হাসপাতালে ভর্তি হন। ৫ মাস ২ দিন পর এ বছর ১১ জানুয়ারি তিনি হাসপাতাল থেকে বাসায় ফেরেন।
এ বছর ৮ ফেব্রুয়ারি স্বাস্থ্য পরীক্ষার জন্য বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া এভারকেয়ার হাসপাতালে যান। পরীক্ষা-নিরীক্ষার পর সেদিনই তিনি গুলশানের বাসা ফিরোজায় ফেরেন। এর পর ১৩ মার্চ এভারকেয়ার হাসপাতালে গিয়ে চিকিৎসা নেন বিএনপি চেয়ারপারসন খালেদা জিয়া। একদিন পর ১৪ মার্চ তিনি বাসায় ফেরেন। ৩০ মার্চ রাত ৩টায় আবারও এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে চিকিৎসা শেষে ২ এপ্রিল বাসায় ফেরেন তিনি। এর পর ১ মে সন্ধ্যায় এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ২ মে রাতে তিনি বাসায় ফেরেন।
২১ জুন গভীর রাতে আবারও এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হয়ে ১১ দিন চিকিৎসা শেষে ২ জুলাই সন্ধ্যায় বাসায় ফেরেন খালেদা জিয়া। ২৩ জুন তাঁর হৃদযন্ত্রে পেসমেকার বসানো হয়। সর্বশেষ ৮ জুলাই খালেদা জিয়া এভারকেয়ার হাসপাতালে ভর্তি হন এবং ৪৫ দিন পর ২১ আগস্ট গুলশানের বাসায় ফেরেন।