ঢাকা, বাংলাদেশ   রোববার ১৫ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ৩০ ভাদ্র ১৪৩১

সেমিনারে বক্তারা

আন্দোলনের সুফল পেতে সংবিধান পুনর্লিখনের বিকল্প নেই

কূটনৈতিক রিপোর্টার

প্রকাশিত: ২৩:২১, ৩১ আগস্ট ২০২৪

আন্দোলনের সুফল পেতে সংবিধান পুনর্লিখনের বিকল্প নেই

ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রকৃত সুফল পেতে সংবিধান পুনর্লিখন

বিদ্যমান সংবিধানই স্বৈরতন্ত্রের পথকে সুগম করেছে। সাবেক প্রধানমন্ত্রী নিজের ক্ষমতাকে কুক্ষিগত করতে সংবিধানের আলোকেই সবকিছু করেছেন। সেই কারণে এই সংবিধান বজায় রেখে রাষ্ট্রের পুনর্গঠন সম্ভব নয়। ছাত্র-জনতার আন্দোলনের প্রকৃত সুফল পেতে সংবিধান পুনর্লিখন বা ব্যাপক আকারে সংশোধনের বিকল্প নেই। এটির ব্যত্যয় ঘটলে স্বৈরতন্ত্র পুনরায় ফিরে আসতে পারে। 
শনিবার ‘গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের জন্য সংলাপ’ শীর্ষক সেমিনারে বক্তারা এসব কথা বলেন। 
অনুষ্ঠানে অন্তর্বর্তী সরকারের স্থানীয় সরকার, পল্লী উন্নয়ন ও সমবায় মন্ত্রণালয়ের উপদেষ্টা ও সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল এ এফ হাসান আরিফ বলেন, ’৭১ এর প্রত্যাশা এবং ২০২৪ এর প্রত্যাশা অভিন্ন নয়। ১৯৭১ এর প্রত্যাশা পূরণ হয়নি বিধায় ২০২৪ এর এই গণঅভ্যুত্থানের ঘটনা ঘটেছে।

হাসান আরিফ বলেন, অনেক রক্তের বিনিময়ে আমরা যে স্বাধীন দেশ পেয়েছিলাম, তাকে সমুন্নত রাখার জন্যই দ্বিতীয় প্রজাতন্ত্র গঠনের প্রয়োজন। ১৯৭১ এর পর সংবিধান রচনায় যে ধরনের আলোচনা হয়েছিল, তা থেকে আমরা দিক নির্দেশনা পেতে পারি। সময়ের সঙ্গে তাল মিলিয়ে সংবিধান পরিবর্তন করা হয়েছে বিভিন্ন দেশে। সংবিধান জীবিত ডকুমেন্ট, তাকে নিয়ে কাজ করা সম্ভব।
তিনি বলেন, গোঁজামিল দিয়ে সংবিধানকে সংশোধন করা হয়েছে বারবার, তা নিয়ে পুনর্বিবেচনা করা প্রয়োজন। সব ধরনের মতামতকে সঙ্গে নিয়েই গণতান্ত্রিক পুনর্গঠনের দিকে এগিয়ে যাবে দেশ। সরকার সিদ্ধান্ত দেবে না, সিদ্ধান্ত দেবে ছাত্র-জনতা।
রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও যুক্তরাষ্ট্রের ইলিনয় স্টেট ইউনিভার্সিটির ডিস্টিংগুইশড প্রফেসর ড. আলী রীয়াজ বলেন, বর্তমান যে সংবিধান আছে সেটা সংশোধন করে কোনো লাভ হবে না। তাঁর মতে সংবিধান পুনর্লিখন ছাড়া কোনো উপায় নেই।
আলী রিয়াজ বলেন, সংবিধানে যে পরিস্থিতি তৈরি হয়েছে এটি পুনর্লিখন ছাড়া আর কোনো উপায় নেই। যদি কোনো দল নির্বাচনে ৩০০ আসনও পায় তারাও এই সংবিধান পরিবর্তন করতে পারবে না। সংবিধান সংশোধন কোনো কাজে আসবে না জানিয়ে তিনি বলেন, এটি পুনর্লিখন ছাড়া কোনো উপায় নেই। কারণ সংবিধানের ৭ অনুচ্ছেদে ‘ক’ ধারায় এমন কিছু জিনিস আনা হয়েছে যেটি সংশোধন করার কোনো উপায় নেই।
এই রাজনৈতিক বিশ্লেষক বলেন, সাংবিধানিকভাবে একনায়কতন্ত্রের প্রতিষ্ঠা করা হয়েছে। এ কারণে প্রধানমন্ত্রীর হাতে অভাবনীয় ক্ষমতা। নির্বাচনী সার্চ কমিটিও অস্বচ্ছ ছিল। শেখ হাসিনা নিজের লোকদের কমিশনে বসিয়েছেন।
আলী রীয়াজ বলেন, ঐকমত্যের জায়গাকে গণতন্ত্র মনে করি না। সহনশীলভাবে মত প্রকাশ এবং মত প্রকাশে সংখ্যালঘুর নিশ্চয়তা বিধানই হচ্ছে গণতন্ত্র। আমাদের সেই গণতন্ত্র পুনর্গঠন করতে হবে। তাই সংবিধানে হাত দেওয়া ছাড়া আমি আর কোনো পথ দেখতে পাচ্ছি না।
আদালতকে ব্যবহার করে আর কোনো অবৈধ রায় দেওয়া যাবে না বলে মন্তব্য করেন সুপ্রিম কোর্ট আইনজীবী সমিতির সভাপতি ব্যারিস্টার মাহবুব উদ্দিন খোকন। তিনি আরও বলেন, আদালতের মাধ্যমে বিগত সরকারের তিনটি মেয়াদকে অবৈধ ঘোষণা করা সম্ভব। আর এটি সম্ভব হলে পরিশ্রম অনেকখানিই কমে যাবে।
সুপ্রিম কোর্টের জ্যেষ্ঠ আইনজীবী জেড আই খান পান্না বলেন, সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখন যাই হোক না কেন দেশের আপামর জনসাধারণকে সম্পৃক্ত করতে হবে। বেশিরভাগ মানুষকে সম্পৃক্ত করতে না পারলে জনগণের প্রতিনিধিত্ব থাকবে না। 
ব্যারিস্টার সারা হোসেন বলেন, সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখন করতে হবে সব শ্রেণিপেশার মানুষ এবং ভিন্নমতকে গুরুত্ব দিয়ে। এখানে শুধু একটি পক্ষের মানুষকে আলোচনায় ডাকা হয়েছে, এটি বৈষম্যবিরোধী কোনো স্পিরিট হলো না। আর সংবিধানে কোটা ব্যবস্থা চালুর ব্যবস্থা থাকতে হবে। জনকল্যাণকর রাষ্ট্র নির্মাণে নারীসহ পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীর সুবিধা দিতে হবে।
চাকমা রাজা ব্যারিস্টার দেবাশীষ রায় বলেন, সংবিধানে ক্ষুদ্র জনগোষ্ঠীর বিষয়টিও ভাবতে হবে। পিছিয়েপড়া জনগোষ্ঠীকে গুরুত্ব দিয়ে সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে। আর সেটি করলে বিচ্ছিন্নতাবাদীর সৃষ্টি হবে না।  
প্রধান উপদেষ্টার বিশেষ সহকারী মাহফুজুল আলম বলেন, জনগণের বৃহত্তর অংশ কী চাচ্ছে সেটা গুরুত্ব দিতে হবে। যে ত্যাগের মাধ্যমে বর্তমান দেশ আমরা পেয়েছি, সংবিধানে তার প্রতিফলন থাকতে হবে। একাত্তরের আকাক্সক্ষা বাদ দেওয়া হলে সংবিধান পুনর্লিখন আত্মঘাতী হবে।
ছাত্রনেতা হাবিবুর রহমান বলেন, সংবিধান সংশোধন বা পুনর্লিখন করতে অ্যাসেম্বলির আয়োজন করা যেতে পারে। বর্তমানের অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের এটিই প্রথম দায়িত্ব হওয়া উচিত। পরবর্তীতে নির্বাচনের বিষয়টি আসতে পারে। আর সংবিধান পুনর্লিখন বা সংশোধনটি হতে হবে ১৯৭২ সালের আলোকেই। বর্তমানে একটি অংশ চাচ্ছে আগের সংবিধানের সব কিছুই বাদ দিতে, সেটা হতে পারে না। 
ব্র্যাক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক মঞ্জুর হাসান বলেন, মানুষের আকাক্সক্ষাকে সংবিধানে অন্তর্ভুক্ত করার বিকল্প নেই। এতে অনেক বিতর্ক এড়ানো যাবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর বোরহান উদ্দিন খান বলেন, সংবিধান সংশোধন করতে পারে সংসদ। সংবিধানের অষ্টম সংশোধনের সময় আমরা ভুল করেছি। সংবিধান পূনর্লিখন চাইলেই করা যায় না। 
অনুষ্ঠানে আরও বক্তব্য রাখেন নিউএজের সম্পাদক নূরুল কবির, সেন্টার ফর গভর্নেন্স স্টাডিজের নির্বাহী পরিচালক জিল্লুর রহমান, সাবেক বিচারক ইকতেদার আহমেদ, সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী দিলরুবা শারমিন, ফেয়ার ইলেকশন মনিটরিং অ্যালায়েন্সের সভাপতি মুনিরা খান ও সুশাসনের জন্য নাগরিকের (সুজন) সম্পাদক ড. বদিউল আলম মজুমদার প্রমুখ।

×