ঢাকা, বাংলাদেশ   শুক্রবার ১৩ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৯ ভাদ্র ১৪৩১

মোবাইল নেটওয়ার্ক কাজ করছে না

১০ জেলার মানুষ বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন, ফেনীর সব উপকেন্দ্র বন্ধ

​​​​​​​স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২২:৫৮, ২৩ আগস্ট ২০২৪; আপডেট: ০০:১৪, ২৪ আগস্ট ২০২৪

১০ জেলার মানুষ বিদ্যুৎ  বিচ্ছিন্ন, ফেনীর সব উপকেন্দ্র বন্ধ

.

আকস্মিক বন্যায় বিপর্যস্ত দেশের উত্তর-পূর্বাঞ্চলের কয়েকটি জেলা। এরই মধ্যে ১০টি জেলা বন্যার পানিতে তলিয়ে গেছে। ফেনী, নোয়াখালী, কুমিল্লা, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, লক্ষ্মীপুর, চট্টগ্রাম, খাগড়াছড়ি, হবিগঞ্জ, মৌলভীবাজার, সিলেটের কয়েকটি জায়গায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে বিদ্যুতের উপকেন্দ্রগুলো।

এসব এলাকায় কাজ করছে না মোবাইল নেটওয়ার্কও। ফলে যোগাযোগ বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছেন লাখো মানুষ।

বাংলাদেশ বিদ্যুৎ উন্নয়ন বোর্ড (পিডিবি) ও পল্লী বিদ্যুতায়ন বোর্ডের (আরইবি) তথ্যমতে, ফেনীর ১৭ টি উপকেন্দ্রের মধ্যে ১৭টিই বন্ধ রয়েছে। ১০৭টি ১১ কেভি ফিডারের মধ্যে বন্ধ ১০৬টি, এছাড়া নোয়াখালীর ২১টি উপকেন্দ্রের মধ্যে বন্ধ একটি, ১১২টি ১১ কেভি ফিডারের মধ্যে ২৩টি, লক্ষ্মীপুরে কোনো উপকেন্দ্র এবং ফিডার ক্ষতিগ্রস্ত না হলেও কুমিল্লা-২ এর ১৭টি উপকেন্দ্রের মধ্যে ২টি, ১০৪টি ফিডারের মধ্যে ২৮টি এবং কুমিল্লা-৪ এ ৫২ টি ফিডারের মধ্যে ২৭ ফিডার বন্ধ রয়েছে।

এছাড়া চট্টগ্রাম-৩ এর ৫৫ টি ফিডারের মধ্যে ৯টি বন্ধ রয়েছে। কক্সবাজারে ক্ষতিগ্রস্ত হওয়া কোনো উপকেন্দ্র নেই। তবে মৌলভীবাজার, বি-বাড়িয়া এবং চাঁদপুর ক্ষতিগ্রস্ত হওয়ার তালিকায় রয়েছে। সব মিলিয়ে বন্যাদুর্গত এলাকার ১৭৪টি উপকেন্দ্রের মধ্যে ২১ উপকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে, আর ৯০৮ টি ১১ কেভি ফিডারের মধ্যে বন্ধ রয়েছে ২০৮ টি। এসব এলাকা মোট ৫২ লাখ ২৪ হাজার ১০৮  গ্রাহকের মধ্যে বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে ১০ লাখ ৯৭ হাজার ৯৬  গ্রাহক। ক্ষতিগ্রস্ত পোলের সংখ্যা ৭১৯ টি, ট্রান্সফরমার নষ্ট হয়েছে ৩২৮টি, স্প্যান ছিঁড়েছে ২২৫৫টি।

বিদ্যুৎ বিভাগ বলছে, বন্যার কারণে এই জেলাগুলোতে বিদ্যুতের মোট আর্থিক ক্ষতির পরিমাণ এখন পর্যন্ত গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৭ কোটি ৯৫ লাখ ৯০ হাজার টাকা।

এর আগে গত বৃহস্পতিবার পিডিবি জানিয়েছিল, বন্যার কারণে বিতরণ কুমিল্লা অঞ্চলের চৌদ্দগ্রাম ৩৩/১১ কেভি উপকেন্দ্র বন্ধ রয়েছে। বন্ধ রয়েছে ১১ কেভির ১৭ টি উপকেন্দ্র। যার আওতায় রয়েছে মুন্সিরহাট উপজেলা, থানা বাজার, ফাল্গুনকড়া এলাকা। বিবি-ফেনী উপকেন্দ্রের আওতায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে ফেনীবাজার, রামপুর, মাস্টারপাড়া, একাডেমি, সুলতানপুর, সহদেবপুর, রানিরহাট, সালাউদ্দিন, সদর হাসপাতাল, বনানীপাড়া এবং বরাহপুর এলাকা।

এছাড়া, বিবিবি-১/২/৩, কুমিল্লা কেন্দ্রের আওতায় বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে কালিয়াজুড়ী, রেইসকোর্স, কাঠেরপুল, সংরাইশ, শুভপুর, পালপাড়া, ছত্রখিল, চানপুর, টিক্কারচর, সমারচর, বাবুরবাজার, বুড়িচং এলাকা। চৌদ্দগ্রাম বি/স এর আওতায় চৌদ্দগ্রাম, মুন্সীরহাট, ডাকরা, ফাল্গুনকড়া, ফুলমুড়ি, বারাইশ এলাকা বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে। বিবিবি-ব্রাহ্মণবাড়িয়ার আওতায় নিয়ামতপুর, দাওয়ারিয়া, শাহাবাজপুর, ধরমতি এলাকার গ্রাহকদের বিদ্যুৎ সংযোগ বন্ধ রয়েছে। এছাড়া, বিবিবি-চৌমুহনীতে বেগমগঞ্জ, চৌমুহনী, আলীপুর, হাজীপুর, উত্তর ও দক্ষিণ বাজার এলাকা বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রয়েছে। বিবি-ফেনীতে ফেনীবাজার, রামপুর, মাস্টারপাড়া, অ্যাকাডেমি, সুলতানপুর, সহদেবপুর, রানিরহাট, বনানীপাড়া ও বরাহপুর এলাকায় নেই বিদ্যুৎ সরবরাহ।

সব মিলিয়ে কুমিল্লা অঞ্চলে প্রায় ৫৭ হাজার গ্রাহক বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় আছে। বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন অবস্থায় রয়েছে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ১৫ হাজার। সীমান্তবর্তী ৮টি গ্রামে বিদ্যুৎ বন্ধ রয়েছে। আগরতলা বর্ডারের পাশেই আরও সাতটি গ্রাম বন্যাকবলিত হওয়ায় সেখানে বন্ধ রাখা  হয়েছে বিদ্যুৎ সরবরাহ। বন্যার পানি না কমা পর্যন্ত বিদ্যুৎবিহীন অবস্থায় থাকতে হবে চট্টগ্রাম পল্লি বিদ্যুৎ সমিতির অধীনে প্রায় ৬৫ হাজার গ্রাহককে। সংশ্লিষ্টরা জানিয়েছেন, বন্যার পানি না কমলে এসব এলাকায় বিদ্যুৎ সরবরাহ করা ঝুঁকিপূর্ণ। তাই বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে।

তবে বন্যায় সবচেয়ে বেশি দুর্ভোগ পোহাতে হচ্ছে নোয়াখালী, ফেনী, কুমিল্লা অঞ্চলের গ্রাহকদের। নোয়াখালী পল্লি বিদ্যুৎ সমিতির সিনিয়র জেনারেল ম্যানেজার জাকির হোসেন সাংবাদিকদের বলেন, গত বৃহস্পতিবার সকাল থেকে বৃষ্টি বন্ধ হলেও বন্যার পানি যা ছিল তাই আছে। এখানে বন্যাকবলিত এলাকার মধ্যে ২ লাখ ৪৩ হাজার গ্রাহকের বিদ্যুৎ সরবরাহ বন্ধ রাখা হয়েছে। বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় বেগমগঞ্জের একটি সাবস্টেশনও বন্ধ রাখা হয়েছে জানিয়ে বলেন, আমাদের অফিস এলাকাই এখন বন্যাকবলিত। পানি কমলে লাইন চেক না করে আমরা বিদ্যুৎ সরবরাহ শুরু করতে পারব না।

একই কথা জানানো হয় কুমিল্লা পল্লি বিদ্যুৎ সমিতির পক্ষ থেকেও। এই অঞ্চলের ১ লাখ ৬৩ হাজার ২৫৫ গ্রাহকের বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্ন রয়েছে। বন্যার পানি ঢুকে পড়ায় বন্ধ রয়েছে দুটি সাবস্টেশন। জানা যায়, মিয়াবাজারের আওতায় শামুকশার, ইলিয়াসপুর, গুনাগরি ও চৌদ্দগ্রামের অবস্থা বেশি খারাপ। বাগমারার পাশে বুসচি নামক একটি জায়গায় বিদ্যুৎ বন্ধ রাখা হয়েছে।

বন্যার কারণে সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত অবস্থায় আছেন ফেনীর গ্রাহকরা। ফেনী পল্লি বিদ্যুৎ সমিতির সহকারী জেনারেল ম্যানেজার আকাশ কুসুম বড়ুয়া সাংবাদিকদের জানান, বন্যার পানি ওঠায় ইতোমধ্যে চারটি সাবস্টেশন বন্ধ রাখা হয়েছে। বাকিগুলো বন্যার পানি ঢুকে পড়ার ঝুঁকিতে আছে।

এছাড়া, বিবিবি -১, ব্রাহ্মণবাড়িয়া দপ্তরের আওতাধীন বিভিন্ন নিচু এলাকায় পানি বৃদ্ধি পাচ্ছে। পানি এখনো বিপৎসীমা অতিক্রম করেনি। ৭ টা ১১ কেভি ফিডারের মধ্যে ৭ টা ফিডারই চালু আছে। অতি বর্ষণের কারণে ২ জায়গায় গাছ উপড়ে পড়েছে, ৪ টা এলটি খুঁটি হেলে পড়েছে। গাছ অপসারণ করে এলটি লাইন চালু করার ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলেও ঠিক কখন এর কাজ শেষ হবে, বলা যাবে না। বিজ্ঞপ্তিতে সব গ্রাহকের উদ্দেশে বলা হয়, চলমান অতিবৃষ্টিতে জলাবদ্ধতার কারণে মিটার বোর্ড ডুবে গেলে বা ডুবার সম্ভাবনা দেখা দিলে অথবা বৈদ্যুতিক খুঁটি/ লাইন বা তার মাটিতে পড়ে থাকতে বা কোনো স্থাপনার ওপর ছিঁড়ে বা বিপজ্জনকভাবে ঝুলে থাকতে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে বিদ্যুৎ অফিস/অভিযোগ কেন্দ্র/কর্মকর্তাদের জানাতে অনুরোধ করা হলো এবং তা স্পর্শ না করে বিদ্যুৎকর্মীরা না আসা পর্যন্ত নিজে ও এলাকাবাসীকে নিরাপদ দূরত্বে থাকার জন্য সতর্ক করতে বিশেষভাবে অনুরোধ করা হলো।

প্রয়োজনে, মাইজদী অভিযোগ কেন্দ্র- ০১৬১৬৯১৪১৪৬, শহর অভিযোগ কেন্দ্র-০১৬১৬৯১৪১৪৫, সোনাপুর অভিযোগ কেন্দ্র-০১৮৪০৩৬১৬২২, সহকারী প্রকৌশলী-০১৮৪১৯৩০৯৫৫, উপ-সহকারী প্রকৌ:-০১৭২২০২২৩৩৬, ০১৭৩২০৪৮৮৩১, ০১৮২৩২৪৪৮৩১, ০১৬১৮৩৭৪৮৭৭, ০১৬৩২৩৯২৭২১, ০১৭৭৩২৬৯৪০২ নম্বরগুলোতে যোগাযোগের পরামর্শ দেওয়া হয়।

বিদ্যুৎ বিচ্ছিন্নের পাশাপাশি এই দশ জেলায় বন্যার পানিতে তলিয়ে অচল হয়ে পড়েছে মোবাইলের অনেক টাওয়ার। এতে করে এসব অঞ্চলে বিদ্যুৎ ও নেটওয়ার্ক বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। যদিও গত বৃহস্পতিবার এক বিজ্ঞপ্তিতে সরকারের ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, যোগাযোগ নিরবচ্ছিন্ন রাখার জন্য বাংলাদেশ স্যাটেলাইট  কোম্পানির সহায়তায় ১০টি ভি-স্যাট প্রস্তুত রাখা হয়েছে। এরই মধ্যে ৫টি ভি-স্যাট পাঠানো হয়েছে। বাতিল করা হয়েছে সব কর্মকর্তার ছুটি।

শুক্রবার ডাক ও টেলিযোগাযোগ বিভাগের পক্ষ থেকে জানানো হয়, নোয়াখালীতে বন্যাপ্লাবিত জেলাগুলোতে মোট সাইট সংখ্যা ১১৫১ টি। এর মধে অচল রয়েছে ২৪৮টি। লক্ষ্মীপুরে ৭০১টির মধ্যে অচল ৫০ টি, ফেনীতে ৬৫৩টির মধ্যে অচল ৬০০টি, কুমিল্লার ২৫২৯টি সাইটের মধ্যে অচল ৩৫১টি, ব্রাহ্মণবাড়িয়ার ১০৬৫টি সাইটের মধ্যে ১৮ অচল, চট্টগ্রামে ৪২৫৮টির মধ্যে ১১৩টি অচল, খাগড়াছড়িতে ২৩০টির মধ্যে অচল রয়েছে ৩৫টি, হবিগঞ্জের ৭৩৬টির মধ্যে অচল ২টি, মৌলভীবাজারের ৬৪৮টির মধ্যে অচল ৩৭টি, সিলেটের ১২৬৯ টির মধ্যে ৭ টি অচল। সব মিলিয়ে ১৩২৪০টি টাওয়ারের মধ্যে ১ হাজার ৪৬১টি সাইট অচল রয়েছে।

কিন্তু গত বুধবার রাত থেকেই রানীরহাটে বসবাস করা নিজের মা-বাবা এবং বড় ভাইয়ের সঙ্গে কোনো ধরনের যোগাযোগ করতে পারছেন না সংবাদকর্মী আদিত্য আরাফাত। তিনি জানান, শেষ যখন বাবার সঙ্গে কথা হয় তখন বাড়িতে পানি ওঠা শুরু করেছিল। এরপর থেকে তাদের কারো সঙ্গে আর মোবাইলে যোগাযোগ করতে পারছি না। দিশেহারা লাগছে নিজেকে।

সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ফেনী, নোয়াখালী অঞ্চলের অনেকেই ঢাকায় বসে পরিবারের কোনো সদস্যের সঙ্গে কোনোপ্রকার যোগাযোগ করতে পারছেন না জানিয়ে প্রতিনিয়ত স্ট্যাটাস দিচ্ছেন।

বন্যাকবলিত এলাকার জনগণের মোবাইল টাওয়ার সার্বক্ষণিক চালু রাখার প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সকল মোবাইল অপারেটর এবং টাওয়ার শেয়ারিং কোম্পানিদের বিটিআরসি থেকে নির্দেশনা প্রদান করা হলেও পরিস্থিতি নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে গেছে বলে দাবি করছেন সংশ্লিষ্টরা।

×