ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৮ ভাদ্র ১৪৩১

কয়েকটি বাস টার্মিনাল বেদখল

ঢেলে সাজানো হচ্ছে পরিবহন খাতের নেতৃত্ব

আজাদ সুলায়মান

প্রকাশিত: ২৩:৩৫, ১৮ আগস্ট ২০২৪

ঢেলে সাজানো হচ্ছে পরিবহন খাতের নেতৃত্ব

ঢেলে সাজানো হচ্ছে পরিবহন খাত

ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পরপরই পরিবহন সেক্টরে শুরু হয়েছে দখলের লড়াই। এখানে রাতারাতি দখল-পাল্টা দখলের মতো ঘটনা ঘটছে। গত দুই সপ্তাহে রাজধানীসহ ঢাকার বাইরে বেশ কয়টি টার্মিনাল বেদখল হয়ে যায়। বিগত ১৫ বছর ধরে যারা টার্মিনালের বাইরে ছিলেন- তারাই হঠাৎ বিএনপির ব্যানারে টার্মিনালগুলোর ওপর নজর ফেলে। ক্ষমতার বদলে পরিবহনেও হাত বদল হচ্ছে। এরই মধ্যে সাইফুল ইসলামকে আহ্বায়ক করে বাস মালিকদের নতুন ৩১ সদস্যের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে গত ১৪ আগস্ট। এখন নতুন কমিটি গঠনতন্ত্র অনুযায়ী দায়িত্ব পালন করবে বলে সাংবাদিকদের জানানো হয়েছে।
সর্বশেষ রবিবার পর্যন্ত জানা গেছে, শুধু ঢাকায় নয়, গোটা দেশজুড়েই বিভাগ, জেলা এবং উপজেলা পর্যায়েও ঢেলে সাজানো হচ্ছে পরিবহনের নেতৃত্ব। চট্টগ্রাম, রাজশাহী, সিলেট, ময়মনসিংহ, বরিশাল, রংপুর ও খুলনায় নেতৃত্ব ঠিক করা হয়েছে। দ্রুত সময়ের মধ্যে আহ্বায়ক কমিটি ঘোষণা করার তোড়জোড় চলছে। এরই মধ্যে রাজধানীর পাঁচ শতাধিক পরিবহন কোম্পানির পরিচালনায় গঠন করা মালিক সমিতির বেশিরভাগই বদলে ফেলা হয়েছে। যদিও বিগত সরকারের আমলের মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের সব নেতা পলাতক রয়েছেন।

রাজধানীর সবচেয়ে বড় টার্মিনাল গাবতলী, সায়েদবাদ ও ফুলবাড়িয়া এখন নতুন মালিক-শ্রমিকদের নিয়ন্ত্রণে। জানা গেছে, সরকার পরিবর্তনের সঙ্গে সঙ্গে মহাখালীর এনা পরিবহন বন্ধ হয়ে গেছে। প্রথমেই তারা ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে এনার গাড়ি বন্ধ করে দেয়। কিন্তু এতে মহাখালীর মালিক-শ্রমিকদের শক্ত অবস্থানের দরুন পিছু হটে। তবে এখনো বন্ধ এনা পরিবহন।

এ কোম্পানির বিরুদ্ধে সাধারণ মালিক-শ্রমিকদের অভিযোগ, বিগত ১৫ বছর ধরে এনার মালিক খন্দকার এনায়েত উল্যাহ একক আধিপত্য বিস্তার করায় অনেকে বৈধ গাড়ি মালিক হওয়া সত্ত্বেও ব্যবসা করতে পারেননি। তিনি একাই ২২টি গাড়ির মালিক থেকে ২৭৮টি বিলাসবহুল গাড়ির মালিক বনে যান। পাশাপাশি ঢাকা সড়কের ব্যানারে রাজধানীসহ গোটা দেশের পরিবহন সেক্টর থেকে দৈনিক ১ কোটি ৩৪ লাখ টাকা বিভিন্ন খাতের নামে চাঁদা তুলতেন। এ টাকার পুরোটাই তিনি আত্মসাৎ করেন।

এমনকি মালিকদের চাঁদার টাকায় পরীবাগে ঢাকা সড়কের নামে অফিস হিসেবে একটি ফ্ল্যাট কিনে নিজের নামে লিখে নেন। এতে সাধারণ মালিকরা চরম ক্ষুব্ধ হয়ে দুদকে নালিশ দেয়। দুদক তার বিরুদ্ধে তৎপর হওয়ার পর তিনি বিভিন্ন অজুহাত দেখান এবং প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে সুসম্পর্ক থাকার কয়েকটি ছবি দেখিয়ে প্রভাব বিস্তার করেন। এরপর দুদক চুপসে যায়।
জানা গেছে, বিগত ১৫ বছর ঢাকা সড়কের একমাত্র গডফাদার হওয়ায় তার বিরুদ্ধে কেউ কোনো কথা বলতে পারেনি। যদিও সরকারবিরোধী আন্দোলন চাঙ্গা হওয়ার পর তিনি দেশত্যাগ করে আশ্রয় নেন অস্ট্রেলিয়ায়। এদিকে ৫ আগস্ট ক্ষমতার পরিবর্তনের পর মহাখালী থেকে ময়মনসিংহ ও সিলেট রুটে এনার সব গাড়ি চলাচল বন্ধ করে দেয় বিএনপি সমর্থিত পরিবহন মালিক ও শ্রমিকরা। একই কায়দায় দখল চাঁদাবাজিতে জড়িয়ে পড়ে দেশের বৃহত্তর টার্মিনাল গাবতলীতে। এখানে হানিফ পরিবহনের মালিক-শ্রমিকরা আওয়ামী লীগ সমর্থিত মালিকদের গাড়ি ও কাউন্টার দখল করে নেয়।

বিএনপি আমলে গোটা পরিবহন সেক্টরে একচ্ছত্র আধিপত্য ছিল হানিফ পরিবহনের মালিক মো. হানিফ মিয়ার। ২১ আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলায় তিনি জেলে যাওয়ার পর কোম্পানির দায়িত্ব নেন তার ভাই কফিল উদ্দিন। তিনি বিএনপির পক্ষে সাভার উপজেলার চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরিবহনের নতুন পরিবর্তনের নেপথ্যে হানিফ পরিবহনের দুই ভাইসহ বিএনপির স্থায়ী কমিটির দুই শীর্ষ নেতা রয়েছেন।

এ সম্পর্কে ভুক্তভোগী কয়েকজন মালিক দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, হানিফ পরিবহনের মালিক একুশে আগস্ট গ্রেনেড হামলা মামলার আসামি হিসেবে দেশত্যাগ করার পরও তার পরিবহনে কেউ হাত দেয়নি। বিগত ১৫ বছর ধরেই আওয়ামী লীগের মালিকরা তার ব্যবসা টিকিয়ে রেখেছে। একটি কাউন্টারও বন্ধ করা হয়নি। অথচ এবার আওয়ামী লীগ ক্ষমতা হারানোর পরপরই টার্মিনাল দখলে হামলে পড়ে হানিফ পরিবহন। তারা আওয়ামী লীগের গাড়িগুলো বন্ধ করে একতরফা ব্যবসার ঘোষণা দেয়। এ নিয়ে টার্মিনালে বর্তমানে থমথমে অবস্থা বিরাজ করছে। 
তবে নতুন দখলদাররা এখনো সুবিধা করতে পারেনি মহাখালীতে। যদিও এনার মালিক খন্দকার এনায়েত উল্লাহ আওয়ামী লীগ সরকারের সময় পরিবহন খাতে ব্যাপক প্রভাব খাটিয়েছেন বলে অভিযোগ। এনা বাসের শ্রমিকেরা সড়কে চলাচলকারী অন্য বাসের শ্রমিকদের সঙ্গেও দুর্ব্যবহার করতেন। সরকার পতনের পর থেকেই ময়মনসিংহসহ সারাদেশে এনা পরিবহনের বাস চলাচল বন্ধ হয়ে যায়।

ময়মনসিংহের মাসকান্দা টার্মিনালে এনার কাউন্টার বন্ধ থাকলেও এর ব্যবস্থাপক রতন পন্ডিত সাংবাদিকদের জানান, ময়মনসিংহ-ঢাকা মহাসড়কে এনা পরিবহনের মোট বাস ৬৭টি। এর মধ্যে খন্দকার এনায়েতের ৩৮টি। বাকিগুলো বিভিন্ন মালিকের। সরকার পতনের পর প্রথম তিনদিন সব বাস বন্ধ ছিল। এরপর কিছুদিন এনায়েত ছাড়া অন্য মালিকদের বাস চলেছে।
এ বিষয়ে পরিবহন মালিকরা জানিয়েছেন, ঢাকা-ময়মনসিংহ রুটে এনা পরিবহনের অন্যতম শেয়ারহোল্ডার ছিলেন ময়মনসিংহ জেলা বাস মালিক সমিতির সভাপতি আমিনুল হক শামীম। তিনি শামীম পরিবহনের মালিক। তিনি এনায়েত উল্যাহর বাসগুলোকে ইউনাইটেড নামে একটি কোম্পানি গঠন করে চালানোর উদ্যোগ নিয়েছেন। সব বাস থেকে মুছে দেওয়া হয়েছে এনার নাম।

নতুন কোম্পানির নামে চলবে পুরনো বাস। এ বিষয়ে মালিকদের ভাষ্য হচ্ছে, মহাখালীতে চলবে সমঝোতার নীতি। নতুন কোম্পানিতে এনার বাস পরিচালনার সুযোগ দিয়ে নিয়মিত লোনের কিস্তি পরিশোধের উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। এতে বেঁচে যাবে এ রুটের তিন হাজার শ্রমিক। 
মহাখালী সম্পর্কে জানতে চাইলে মালিক সমিতির সভাপতি আবুল কালাম বলেন, দখল রাজনীতি থেকে সবসময়েই মুক্ত আমরা। এখানে আমাদের সমিতি দখল হয়নি। এখন পর্যন্ত সবকিছু ঠিকঠাক আছে। সামনে কী হয় জানি না। তবে আমরা আশাবাদী। কারণ এখানে একটা সিস্টেমে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব পরিবর্তন হয়। গঠনতন্ত্র অনুযায়ী গণতান্ত্রিক রীতিনীতি মেনেই মহাখালী টার্মিনালে মালিক ও শ্রমিক সংগঠনের নেতৃত্ব পরিবর্তন হয়। কেউ ইচ্ছা করলে এখানে এসে সাময়িক ঝামেলা সৃষ্টি করতে পারবে। কিন্তু এখানকার মালিক-শ্রমিকরা এতটাই সুসংগঠিত ও সুশৃঙ্খল যে দখলকারীরা সুবিধা করতে পারে না। 
জানতে চাইলে বর্তমানে ঢাকা সড়ক মালিক সমিতির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম দৈনিক জনকণ্ঠকে বলেন, বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকার যেভাবে রাষ্ট্র সংস্কারের মিশন নিয়েছে আমরাও চাই পরিবহনে একই ধরনের সংস্কার হোক। যিনি মালিক, যিনি প্রকৃত শ্রমিক, তিনিই থাকবেন এখানে। যার কোনো গাড়ি নেই, কিন্তু দল আছে- তেমন নেতা এসে প্রভাব খাটিয়ে ঢাকা সড়কের চেয়ারে বসে যাবেন এমন কালচার আর হতে দেওয়া যাবে না। আমরা এ বিষয়ে যথেষ্ট সতর্ক ও সংযত রয়েছি।

সাধারণ মালিক- শ্রমিকরাও এবার তাই চাচ্ছেন। আমাদের সবার চাওয়া পরিবহনে সত্যিকার অর্থেই একটা গুণগত পরিবর্তন আসুক। তিনি বলেন, সারাদেশে নতুন কমিটি করতে সময় লাগবে। আমরা চেষ্টা করছি। গত ১৪ আগস্ট ঢাকা সড়কের আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। নির্বাচনের আগ পর্যন্ত এই কমিটি দায়িত্ব পালন করবে। রবিবার থেকে নতুন কমিটির কার্যাবলী সংক্রান্ত রেজুলেশন হয়েছে।

আমরা কোনো কমিটি অগঠনতান্ত্রিকভাবে করিনি। গঠনতন্ত্র মেনে তলবি সভা করে সদস্যদের সর্বসম্মতিক্রমে পুরনো কমিটি বাতিল করে নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠন করা হয়েছে। মূলত সড়ক পরিবহন সেক্টর অরক্ষিত ছিল। আমরা দায়িত্ব নিয়ে সুরক্ষার ব্যবস্থা করেছি।
এদিকে গত এক সপ্তাহ ধরে সরেজমিনে দেখা গেছে, দখল-পাল্টা দখলের মতো এক ধরনের ভীতিকর ও অজানা শঙ্কা তৈরি হয়েছে রাজধানীর টার্মিনালগুলোতে। কে, কখন, কোথায় গিয়ে হানা দেয় তেমন আতঙ্কে মালিক-শ্রমিকরা। গাবতলী সায়েদাবাদ ও ফুলবাড়িয়ায় গিয়ে দেখা গেছে, ইতোমধ্যে এগুলোতে নেতৃত্বের পরিবর্তন ঘটে গেছে। বিএনপি আমলের পরিবহন নেতা জাহিদ আল লতিফ খোকা গত ১৫ আগস্ট বৃহস্পতিবার সায়েদাবাদ বাস টার্মিনাল মালিক সমিতি কার্যালয়ে অনুসারীদের নিয়ে বৈঠক করেছেন।

গত ৫ আগস্ট পর্যন্ত এই টার্মিনাল বাস মালিক সমিতির সভাপতি হিসেবে সবুর আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক আবুল কালাম আজাদ দায়িত্ব পালন করেন। এরপর থেকে তারা পলাতক আছেন। মোবাইল ফোনও বন্ধ পাওয়া গেছে। এই সুযোগে দখল হয়েছে টার্মিনাল মালিক সমিতি কার্যালয়। মালিক সমিতির মতোই সায়েদাবাদ টার্মিনালে থাকা ঢাকা মহানগর সড়ক পরিবহন শ্রমিক ইউনিয়ন কার্যালয় রহিম মুন্সি নামে একজন বিএনপিপন্থি শ্রমিক নেতা দখলে নিয়েছেন।

এরই মধ্যে কার্যালয়ে ভাঙচুরসহ পুরনো কাগজপত্র পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। এই শ্রমিক ইউনিয়নের সভাপতি ছিলেন মোহাম্মদ আলী শোভা ও সাধারণ সম্পাদক সেলিম সরওয়ার। ৫ আগস্টের পর থেকে তারাও গা-ঢাকা দিয়েছেন।
পরিবহন খাত সূত্রে জানা গেছে, ঢাকা সড়কের নতুন আহ্বায়ক কমিটি গঠনের পর রবিবার প্রথম কার্যসম্পাদন বৈঠক ডাকা হয়। নতুন কমিটির আহ্বায়ক সাইফুল ইসলাম পর্যায়ক্রমে রাজধানীর সিটি সার্ভিসগুলোকে একটা নিয়ম-শৃঙ্খলায় আনার পরিকল্পনা নিয়েছেন। এবার যাচাই-বাছাই করেই আঞ্চলিক কমিটিগুলোর অনুমোদন নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেওয়া হয় বৈঠকে। তবে এরই মধ্যে তুরাগ, রাইদা, লাভলী, শিকড়, ভিক্টর ক্ল্যাসিক, অনাবিল, প্রজাপতি, আট নম্বর, বনানী ট্রান্সপোর্ট, গাজীপুর পরিবহন, বলাকা, লাব্বাইক, মালঞ্চ, তরঙ্গ, আলিফ, অভিনন্দন, বিকাল, মেঘলা, ভিআইপি পরিবহন, মিডলাইন, রমজান, স্বপ্ন, ভুঁইয়া, স্বাধীন, দেওয়ান, গাবতলী পরিবহনসহ চার শতাধিক বাস কোম্পানির মালিক সমিতিতে পরিবর্তন এসেছে। এতে দায়িত্ব নিয়েছেন স্থানীয় বিএনপিপন্থি পরিবহন সেক্টরের সাবেক ও বর্তমান নেতারা। কিছু কমিটিতে আওয়ামীপন্থিদেরও রাখা হয়েছে।

×