ঢাকা, বাংলাদেশ   বৃহস্পতিবার ১২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, ২৭ ভাদ্র ১৪৩১

অন্তর্বর্তী সরকার সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ: ড.ইউনূস

প্রকাশিত: ১৬:১৩, ১৭ আগস্ট ২০২৪; আপডেট: ০০:০৬, ১৮ আগস্ট ২০২৪

অন্তর্বর্তী সরকার সুষ্ঠু ও অবাধ নির্বাচন করতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ: ড.ইউনূস

প্রধান উপদেষ্টা ড. মুহাম্মদ ইউনূস

টেকসই ভবিষ্যৎ বিনির্মাণ ও নতুন বিশ্ব গড়ে তুলতে গ্লোবাল সাউথের কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে তরুণ ও ছাত্রদের রাখার আহ্বান জানিয়েছেন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেছেন, তরুণরা নতুন বিশ্ব গড়ে তুলতে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।
তিনি গ্লোবাল সাউথ নেতাদের উদ্দেশ বলেন, ‘আমাদের কৌশলগুলোর কেন্দ্রবিন্দুতে অবশ্যই তরুণ এবং ছাত্রদের রাখতে হবে, যারা গ্লোবাল সাউথের জনসংখ্যার উল্লেখযোগ্য অংশ। আমাদের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ তরুণ এবং তারা সমাজের সবচেয়ে শক্তিশালী অংশ।’
ড. মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, দেশে অন্তর্ভুক্তিমূলক, বহুত্ববাদী গণতান্ত্রিক রূপান্তর নিশ্চিত করতে অবাধ, সুষ্ঠু ও অংশগ্রহণমূলক নির্বাচন করতে সরকার প্রতিশ্রুতিবদ্ধ। শনিবার নয়াদিল্লির আয়োজনে তৃতীয় ‘ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথ সামিট’-এ ভার্চুয়ালি যুক্ত হয়ে এসব কথা বলেন প্রধান উপদেষ্টা। 
শনিবার সকাল সাড়ে ১০টা থেকে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত ঢাকা থেকে এই বৈঠকে যোগ দেন ড. মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, নির্বাচনব্যবস্থা, বিচারব্যবস্থা, স্থানীয় সরকারব্যবস্থা, গণমাধ্যম, অর্থনীতি ও শিক্ষাব্যবস্থা সংস্কার করা অন্তর্বর্তী সরকারের অন্যতম কাজ। এ সময় ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদিকে বাংলাদেশ সফরের আমন্ত্রণ জানান ড. মুহাম্মদ ইউনূস।
বক্তব্যে বিচার বিভাগ, নির্বাচনব্যবস্থা, স্থানীয় সরকার, শিক্ষা ও অর্থনীতিসহ রাষ্ট্রীয় কাঠামোর সব স্তরে প্রয়োজনীয় পরিবর্তন আনার পরিকল্পনার কথা জানান মুহাম্মদ ইউনূস। তিনি বলেন, আপনারা সবাই জানেন, ৫ আগস্ট বাংলাদেশ একটি ‘দ্বিতীয় বিপ্লব’-এর সাক্ষী হয়েছে। আমাদের বীর ছাত্রদের নেতৃত্বে এবং জনসাধারণের যোগদানের মাধ্যমে যা সম্ভব হয়েছে।

মুহাম্মদ ইউনূস বলেন, ‘আমার জীবনের দীর্ঘ অভিজ্ঞতা থেকে দেখতে পাই, আমাদের আর্থিক ব্যবস্থা সম্পদ আত্তীকরণের বিষয়টিকেই প্রাধান্য দেয়। এ ক্ষেত্রে সবার সম্পদ প্রাপ্তি নিশ্চিত করতে আর্থিক ব্যবস্থাকে নতুন করে ঢেলে সাজাতে হবে।’
অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের প্রধান উপদেষ্টা বলেন, সম্পদের একমুখী প্রবাহ থাকা উচিত নয়। আমাদের অবশ্যই সকল মানুষের, বিশেষ করে নারী ও যুবকদের জন্য আর্থিক সেবা নিশ্চিত করতে হবে। আমরা একে অপরের কাছ থেকে শিখতে পারি যে কীভাবে এটি সফলভাবে করা যায়। এ বিষয়ে বহু দেশ অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছে। এ ক্ষেত্রে আমাদের আরও এগিয়ে যেতে হবে।
ভারতের নয়াদিল্লিতে তৃতীয় ভয়েস অব দ্য গ্লোবাল সাউথ সামিট অনুষ্ঠিত হয়। শুক্রবার ফোনালাপে সামিটে যোগ দেওয়ার জন্য ড. মুহাম্মদ ইউনূসকে আমন্ত্রণ জানান ভারতের প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদি। তাঁর আমন্ত্রণে সাড়া দিয়ে ঢাকা থেকে ভার্চুয়ালি সম্মেলনে যোগ দিতে রাজি হন তিনি।
অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান হিসেবে শপথ নেওয়ার পর এটাই অধ্যাপক ইউনূসের প্রথম বহুপক্ষীয় কোনো অনুষ্ঠানে যোগদান। প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির সঞ্চালনায় রাষ্ট্র বা সরকারপ্রধান পর্যায়ের উদ্বোধনী অধিবেশনটি অনুষ্ঠিত হয়। সম্মেলনের মূল প্রতিপাদ্য হলো ‘অ্যান এমপাওয়ারড গ্লোবাল সাউথ ফর এ সাসটেইনেবল ফিউচার।’
বক্তব্যে ড. ইউনূস বলেন, গ্লোবাল সাউথের জনসংখ্যার একটি উল্লেখযোগ্য অংশ তরুণ ও শিক্ষার্থীদের অবশ্যই তাদের কৌশলের কেন্দ্রবিন্দুতে রাখতে হবে। তিনি বলেন, ‘আমাদের জনসংখ্যার দুই-তৃতীয়াংশ তরুণ। এরা সমাজের সবচেয়ে ক্ষমতাধর অংশ। তারা আলাদা। তারা একটি নতুন বিশ্ব গড়তে প্রতিশ্রুতিবদ্ধ।’ 
ক্ষুদ্র ঋণের বাজার উন্নয়নে অবদানের জন্য ২০০৬ সালে নোবেল শান্তি পুরস্কার পাওয়া অধ্যাপক ড. ইউনূস বলেন, ‘তরুণ ও শিক্ষার্থীরা সক্ষম এবং প্রযুক্তিগতভাবে তারা আগের প্রজন্মের চেয়ে অনেক এগিয়ে।’
তিনি বলেন, তারা সব অসম্ভবকে সম্ভব করতে পারে। তারা উদ্যোক্তা। গরিব মানুষের ব্যাংকার হিসেবে পরিচিত অধ্যাপক ইউনূস বলেন, তারপরও সব মানুষই সৃজনশীল জীব হিসেবে জন্মগ্রহণ করে। তারা স্বভাবজাত উদ্যোক্তা। কিন্তু আমাদের শিক্ষাব্যবস্থা ও আর্থিক ব্যবস্থা গড়ে উঠেছে শুধু চাকরিপ্রার্থী তৈরি ও তাদের কর্মসংস্থানের ব্যবস্থা করার জন্য।
তিনি বলেন, আমাদের ব্যবস্থাটি পুনরায় সাজাতে হবে। তিনি আশা করেন যে, তারা গ্লোবাল সাউথে একসঙ্গে এটি করতে পারেন। এটি দারুণভাবে সৃজনশীল তরুণ জনগোষ্ঠী সমৃদ্ধ।
সামাজিক ব্যবসার সঙ্গে উদ্যোক্তা সমন্বয় অলৌকিক কিছু ঘটাতে পারে উল্লেখ করে অধ্যাপক ইউনূস বলেন, সামাজিক ব্যবসার মাধ্যমে তরুণ জনগোষ্ঠীর সৃজনশীলতা ও শক্তিকে বিকাশে সুনির্দিষ্ট পদক্ষেপ নিতে তিনি গ্লোবাল সাউথে কিছু সাধারণ সুযোগ-সুবিধার প্রস্তাব করতে চান।
অধ্যাপক ইউনূস সকল পরিবেশগত ও সামাজিক সমস্যা সমাধানে সামাজিক ব্যবসা গড়ে তুলতে গ্লোবাল সাউথের নেতাদের একযোগে কাজ করার আহ্বান জানান। তিনি বলেন, আমরা যদি একসঙ্গে কাজ করি তবে এটি একটি বিশাল শক্তি হয়ে উঠতে পারে। 
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, বুড়ো হওয়ার অর্থ এই নয় যে আপনাকে অবসর নিতে হবে, অর্থনৈতিক কর্মকা- থেকে নিজেকে গুটিয়ে নিতে হবে। তিনি বলেন, রাষ্ট্র নির্ধারিত মানুষের আয়ু অনুযায়ী সৃজনশীলতা কখনো থেমে থাকে না। শেষনিঃশ্বাস পর্যন্ত থামে না। আমরা একসঙ্গে কাজ করে দেখতে পারি কীভাবে সমাজকে সব মানুষের সৃজনশীলতার সহায়ক করে তোলা যায়, যতদিন তারা বেঁচে থাকবে।

তিনি বলেন, ১২-১৩ বছর বয়সী তরুণ শিক্ষার্থী এবং শিশুরা ৪০০ বছরের পুরনো এই শহরের দেয়াল ‘নতুন গণতান্ত্রিক’ পরিবেশবান্ধব বাংলাদেশের চিত্র দিয়ে রাঙিয়ে তুলছে।
প্রধান উপদেষ্টা বলেন, এজন্য কোনো কেন্দ্রীয় পরিকল্পনা বা দিকনির্দেশনা নেই। ‘কারও কাছ থেকে বাজেট সহায়তা পায়নি তারা। এটা দ্বিতীয় বিপ্লবের লক্ষ্যের প্রতি তাদের আবেগ ও অঙ্গীকারের বহিঃপ্রকাশ মাত্র।’
তিনি বলেন, তারা তাদের জন্য রং এবং ব্রাশ কিনতে দোকানে যায়। তারা তাদের নিজস্ব বিষয় এবং নিজস্ব বার্তা তৈরি করে। ‘তারা যে বার্তাগুলো আঁকছে তা যে কাউকে শিহরিত করবে। তরুণরা কী স্বপ্ন দেখছে তা যে কেউ পড়তে পারে। তাদের স্বপ্নকে সত্যি করাই আমাদের কাজ।’
তিনি ইতিহাসকে উদ্বৃত করে বলেন, ১৯৫২ সালে মাতৃভাষার জন্য বাংলাদেশী ছাত্ররা প্রাণ দিয়েছিল। এটি সারা বিশ্বে মাতৃভাষায় কথা বলার অধিকারের জন্য সংগ্রামকে অনুপ্রাণিত করেছিল। প্রায় সাত দশক পরে আমাদের ছাত্র-নেতৃত্বাধীন দ্বিতীয় বিপ্লব গণতন্ত্র, মানবাধিকার, মর্যাদা, সমতা এবং অংশীদারিত্বমূলক সমৃদ্ধির জন্য তাদের কণ্ঠস্বর উত্থাপন করতে গ্লোবাল সাউথ জুড়ে যুবকদের অনুপ্রাণিত করছে।
অধ্যাপক ইউনূস বলেন, “আমি সবচেয়ে বয়স্ক ‘তরুণ’ হিসেবে এই বিপ্লবে অংশ নিতে পেরে এবং তাদের স্বপ্ন বাস্তবায়নে সহায়তা করতে পেরে সম্মানিত বোধ করছি। তাদের সবার সহযোগিতা প্রয়োজন। তাদের সর্বাঙ্গীণ সাফল্য কামনা করি।”
ভারতের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জানায়, প্রধানমন্ত্রী নরেন্দ্র মোদির ‘সবকা সাথ, সবকা বিকাশ, সবকা বিশ্বাস অউর সবকা প্রয়াস’ দর্শনের প্রচারে এই অনন্য উদ্যোগটি শুরু হয়েছিল। আর এটি মূলত ভারতের ‘বসুধৈব কুটুম্বকম’ দর্শন। এটি গ্লোবাল সাউথের দেশগুলোকে তাদের দৃষ্টিভঙ্গি এবং অগ্রাধিকারগুলোকে একটি সাধারণ প্ল্যাটফর্মে ব্যাপক পরিসরে ভাগ করে নেওয়ার পরিকল্পনার অংশ।
ভারত ২০২৩ সালের ১২ ও ১৩ জানুয়ারি প্রথম ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথ সামিট (ভিওজিএসএস) এবং একই বছরের ১৭ নভেম্বর দ্বিতীয় ভয়েস অব গ্লোবাল সাউথ সামিটের আয়োজন করে। তবে দুটো সামিটই ভার্চুয়াল ফরম্যাটে আয়োজন করা হয়েছিল। উভয় আয়োজনে গ্লোবাল সাউথ থেকে ১০০টিরও বেশি দেশ অংশগ্রহণ করেছিল।

তাসমিম

×