চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, হাবিবুর রহমান, হারুন অর রশিদ, বিপ্লব কুমার, আখতার ও মনিরুল ইসলাম
পুলিশ বাহিনীর এক সময়ের দোর্দ- প্রতাপশালী ছিলেন এমন অন্তত ২৫ পুলিশ কর্মকর্তার তালিকা তৈরি করছে পুলিশ সদর দপ্তর। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র জনতার আন্দোলনের সময়ে আগ্রাসী ভূমিকা পালন করেছে তারা। এসব পুলিশ কর্মকর্তার এখন আর খোঁজ মিলছে না। তালিকাভুক্ত পুলিশ কর্মকর্তা স্বপদে যোগদান করেননি বলে পুলিশ সদর দপ্তরের দাবি।
যেই পুলিশ কর্মকর্তাদের দাপটে বাঘে মহিষে এক ঘাটে জল খেতো সেই পুলিশ কর্মকর্তারা এখন কোথায় ? এসব পুলিশ কর্মকর্তার মধ্যে ইতোমধ্যেই কারও কারও বিরুদ্ধে মামলা দায়ের করা হয়েছে। এমনকি তারা হত্যা মামলার আসামি হয়ে এখন পালিয়ে বেড়াচ্ছে বলে জানিয়েছে পুলিশ সদর দপ্তর। তাদের গ্রেপ্তারের জন্য খুঁজছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে এ খবর জানা গেছে। পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা বলেছেন, দোর্দ- প্রতাপে তারা ছড়ি ঘুরিয়েছেন সবার ওপরে।
এমনকি পুলিশ প্রশাসনেও তারা ছিল দোর্দ- প্রতাপশালী। শেখ হাসিনার সরকারকে টিকিয়ে রাখতে নির্বিচারে দমন করেছেন ভিন্নমত ও প্রতিবাদকারীদের। কিন্তু ৫ আগস্ট ছাত্র-জনতার অভ্যুত্থানের পর আর দেখা মিলছে না তাদের। পুলিশ সদর দপ্তরের তালিকায় যে পুলিশ কর্মকর্তাদের খোঁজা হচ্ছে তারা হলেন, সাবেক আইজিপি চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন, সাবেক ডিএমপি কমিশনার হাবিবুর রহমান, অতিরিক্ত আইজিপি (এসবি প্রধান) মনিরুল ইসলাম, ডিআইজি হারুন অর রশিদ, ডিএমডি ডিসি বিপ্লব কুমার, মেহেদি হাসান, সুদীপ, এডিসি ইলিয়াস, রমনার এডিসি আখতার, এসি ইমরানসহ বেশকিছু পুলিশ কর্মকর্তা।
তারা এখন কোথায় আছেন, দেশে আছেন নাকি বিদেশে পাড়ি জমিয়েছেন ? পুলিশ সদর দপ্তর কিংবা ঢাকা মহানগর পুলিশ সদর দপ্তরের অফিসে তারা যোগদান থেকে বিরত আছেন। তবে তাদের খোঁজ করছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।
পুলিশ সদর দপ্তর জানায়, সাবেক আইজিপি, ডিএমপি কমিশনার ও র্যাব মহাপরিচালককে সরিয়ে দেওয়া হয়েছে তাদের পদ থেকে। আইজিপির চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ বাতিল করা হয়েছে। ওএসডি করা হয়েছে র্যাব মহাপরিচালক ও ডিএমপি কমিশনারকে। পুলিশের বিশেষ শাখার (এসবি) প্রধান মনিরুল ইসলামকে সরিয়ে সংযুক্ত করা হয়েছে পুলিশ অধিদপ্তরে।
৫ আগস্ট শেখ হাসিনা পদত্যাগ করে দেশত্যাগ করার একদিন পর ৬ আগস্ট বিকেলে চৌধুরী আবদুল্লাহ আল মামুন আত্মগোপন থেকে ভিডিও বার্তা পাঠান। তাতে পুলিশ সদস্যদের দৃঢ়মনোবল নিয়ে কাজ করে যাওয়ার আহ্বান জানান তিনি। সেদিন রাতেই বাতিল করা হয় এই আইজিপির চুক্তিভিত্তিক নিয়োগ। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্রে জানা গেছে, পুলিশের ঊর্ধ্বতন অন্তত ২৫ জন কর্মকর্তার খোঁজ মিলছে না। পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র বলছে, ৫ আগস্ট বিকেলে হারুন অর রশীদসহ কয়েকজন সিভিল পোশাকে দেওয়াল টপকে নগর ভবনে যান, সেখান থেকে তারা নিরাপদ আশ্রয়ে পালান। হারুনকে বিমানবন্দর থেকে আটক করে নিয়ে গেছে রাষ্ট্রীয় একটি সংস্থা এমন খবর জানা গিয়েছিল।
সাবেক আইজিপি, অতিরিক্ত আইজিপি, ডিএমপি কমিশনারসহ কয়েকজন কর্মকর্তা পালিয়ে বেড়াচ্ছেন ? এসব পুলিশ কর্মকর্তারা এখন কোথায় আছেন কেউ বলতে পারছে না। অথচ তাদের নির্দেশে ছাত্র-জনতার আন্দোলন দমাতে কাজ করেছেন মাঠপর্যায়ের পুলিশ সদস্যরা।
পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানিয়েছেন, পুলিশ সদস্যরা এত বিপুল ক্ষয়ক্ষতির জন্য পুলিশের সাবেক আইজিপি, সাবেক ডিএমপি কমিশনারসহ কয়েকজন কর্মকর্তা দায়ী। পুলিশের ব্যাপক দলীয়করণ, দমন, পীড়ন ও অজনপ্রিয় করার পেছনে দায়ী রয়েছেন মুষ্টিমেয় কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তা। পুলিশ সদর দপ্তর কর্মকর্তাদের মতে, অতিরিক্ত আইজিপি মনিরুল ইসলাম, ডিবির অ্যাডিশনাল কমিশনার হারুন অর রশিদ, ডিসি বিপ্লব কুমার, মেহেদি হাসান, সুদীপ, এডিসি ইলিয়াস, রমনার এডিসি আখতার, এসি ইমরানসহ বেশকিছু পুলিশ কর্মকর্তা পুলিশ প্রশাসনে মারাত্মক দোর্দ- প্রতাপশালী ছিলেন।
ডিবি পুলিশের প্রধান হারুন অর রশীদ ডিবি অফিসে ভাতের হোটেল চালু করে ভিন্নমতাবলম্বী রাজনৈতিক নেতা ও বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনের ছয় সমন্বয়ককে ভাত খাইয়ে ভিডিও করে তা সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ভাইরাল করার বিষয়টি মারাত্মক খারাপ নজির স্থাপন করেছে। এতই খারাপ নজির স্থাপন করেছে যে সদ্য পতন হওয়ার আগে শেখ হাসিনার সরকারের ভাবমূর্তি মারাত্মক ক্ষুণœœ করেছে। ডিবি প্রধান হারুন অর রশীদের ঘুষ ও দুর্নীতির সিন্ডিকেটের বিষয়টি সরকারি মহলসহ বিভিন্ন মহলে ছিল ওপেন সিক্রেট।
পুলিশ সদর দপ্তর সূত্র জানায়, ৫ আগস্ট শেখ হাসিনার সরকারের পতনের আগে বেপরোয়া হয়ে উঠেছিলেন পুলিশের কয়েকজন কর্মকর্তা। এসব পুলিশ কর্মকর্তার উস্কানিতে গুলি চালানো হয়েছে। এমনকি সাজোয়া যানে উঠে নির্বিচারে গুলি করেছেন। আর তাতে আরও ঘোলাটে হয় পরিস্থিতি। সাবেক প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার বিরুদ্ধে যে হত্যাসহ বিভিন্ন মামলা দায়ের করা হয়েছে তার মধ্যে বেশ কয়েকজন পুলিশ কর্মকর্তাকে আসামি করা হয়েছে। যেসব পুলিশ কর্মকর্তা আসামি হয়েছেন তারা পলাতক রয়েছেন বলে জানা গেছে।
ছাত্র-জনতার বিরুদ্ধে পুলিশকে আগ্রাসী করার পেছনে ভূমিকা পালনকারী ওই কর্মকর্তাদের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে কাজ করছে অন্তর্র্বর্তী সরকার এবং নতুন আইজপির নেতৃত্বে নতুন পুলিশ প্রশাসন। এমন পুলিশ কর্মকর্তাদের তালিকা তৈরি করা হচ্ছে। পুলিশ সদর দপ্তরের একজন কর্মকর্তা জানান, বিগত সরকারের সময়ে দোর্দ- প্রতাপশালী পুলিশ কর্মকর্তাদের দাপটে দলীয়করণে পুলিশ প্রশাসনে বঞ্চনার শিকার হয়েছেন অনেক পুলিশ কর্মকর্তা।
পদোন্নতি বঞ্চিত হয়ে অতি কম গুরুত্বপূর্ণ পদে তাদের নিয়োগ দেওয়া হয়েছে। পদোন্নতি বঞ্চিত পুলিশ কর্মকর্তা যারা আছেন তাদেরও তালিকা তৈরি করে পদোন্নতি প্রদান করে পুলিশ প্রশাসনে গতি সঞ্চার করার উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। পুলিশ প্রশাসনের সব ইউনিট যেমন সিআইডি, র্যাব, ডিবি, গোয়েন্দা সংস্থা, পুলিশ কমিশনার, রেঞ্জ ডিআইজি পদে বদলি, সংযুক্তি, বাধ্যতামূলক অবসর প্রদানসহ নানা ধরনের পদক্ষেপ গ্রহণ করা হচ্ছে। পুলিশের বিভিন্ন ইউনিটের রাজনৈতিক দলীয়করণ ভেঙে পুলিশ প্রশাসনে সংস্কার করা হচ্ছে বলে পুলিশ কর্মকর্তার দাবি।