সড়কে ট্রাফিক ব্যবস্থার দায়িত্ব পালন করছে ছাত্ররা। মঙ্গলবার রাজধানীর শাহবাগ মোড়
মঙ্গলবারও ভোরের আকাশে অন্যদিনের মতো উদিত হয়েছে সূর্য। কাকডাকা ভোরে প্রথম সূর্যকে স্বাগত জানিয়ে কর্মের তাগিদে বাইরে বের হয়েছেন কর্মজীবী মানুষ। শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে ছুটে চলে শিশুরা, অফিস-আদালতে হাজির হয়েছেন কর্মকর্তা-কর্মচারীরা। সংখ্যায় কম হলেও রাস্তায় দাপিয়ে বেড়িয়েছে বিভিন্ন প্রকার যানবাহন। ব্যক্তি জীবনে কারও কারও কাছে হয়তো নতুন প্রত্যাশাও ছিল।
ভোর থেকে পরবর্তী দিন আসার আগ মুহূর্ত পর্যন্ত সবই চলেছে এমনইভাবে, অন্যান্য দিনের মতো করে। তা সত্ত্বেও সব ঠিক থেকেও যেন ঠিক ছিল না মঙ্গলবারের দিনটা। ভোর থেকে পুরো দিনই যেন এক সুনসান নীরবতা বিরাজ করেছে রাজধানীজুড়ে। কী যেন হারানোর হাহাকার, শূন্যতাÑ যা ইতোপূর্বে দেখেনি স্বাধীন বাংলাদেশের মানুষ। এ যেন এক নতুন সূর্য, নতুন দিন।
টানা কয়েক দিন বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলন ছিল রাজধানীসহ সারাদেশে। আন্দোলনের সবশেষ কর্মসূচি ‘লং মার্চ টু ঢাকা’ ছিল সোমবার। এর আগে কয়েকদিন ধরে আন্দোলনকারীদের সঙ্গে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সঙ্গে সংঘর্ষ, হতাহতের ঘটনা ঘটে। এমন উদ্ভূত পরিস্থিতিতে শেখ হাসিনা প্রধানমন্ত্রীর পদ থেকে পদত্যাগ করে দেশ ছাড়েন। এমন খবরে নানা স্থানে অগ্নিসংযোগ করে উত্তেজিত জনতা।
ঢাকার রাস্তায় নামে ছাত্র-জনতার ঢল। রাতব্যাপী সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে ঢাকার বিভিন্ন জায়গায় হামলার গুজব চলে। এতে আরও বেশি আতঙ্কিত হয়ে পড়েন নগরবাসী। ফলে মঙ্গলবার প্রয়োজনীয় কাজ ছাড়া তেমন একটা বাইরে বের হয়নি লোকজন। যানবাহন চলেছে হাতেগোনা। দিনব্যাপী থমথমে পরিস্থিতি বিরাজ করেছে রাজধানীতে।
রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, রাস্তায় যানবাহনের সংখ্যা একেবারে কম। সিএনজি, অটোরিক্সা, বাইক চলাচল করলেও সংখ্যায় ছিল কম। গাড়িতে ছিল না যাত্রীর চাপ। শুধু চাকরিজীবী মানুষজনকে চলাচল করতে দেখা গেছে। পাড়া-মহল্লায় মানুষের জটলা, সরকারের পতন নিয়ে নানা আলোচনা। চায়ের দোকান থেকে অফিস-আদালতে সর্বত্রই পরিলক্ষিত হয়েছে এ আলোচনা। এলাকায় বিক্ষিপ্ত মিছিল বের করতে দেখা গেছে বিএনপির নেতাকর্মীদের।
আন্দোলন ঘিরে সংঘর্ষ, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগের ক্ষতচিহ্ন রাজধানীজুড়ে। সংঘর্ষে আন্দোলনকারী শিক্ষার্থী, সাধারণ মানুষের পাশাপাশি প্রাণ হারিয়েছেন আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর বেশ কয়েকজন সদস্য। ফলে নগরীতে ঘুরে কোনো ট্রাফিক পুলিশের দেখা মেলেনি। চলমান পরিস্থিতির কারণে কর্মবিরতি পালন করছেন থানা পুলিশ, ট্রাফিক পুলিশসহ সকল কর্মকর্তা। ফলে ছাত্র ও জনতা নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছে ট্রাফিকের দায়িত্ব।
মঙ্গলবার নগরীর বিজয় সরণি, ফার্মগেট, কাওরানবাজার, শাহবাগসহ কয়েকটি এলাকা ঘুরে এমন চিত্র দেখা গেছে। তবে বিগত কয়েক দিনের তুলনায় নগরীতে যানবাহনের উপস্থিতি বেশি দেখা গেছে। নগরীর বিজয় সরণিতে দেখা গেছে কয়েকজন ছাত্র-জনতা ট্রাফিক পুলিশের দায়িত্ব পালন করছেন লাঠি হাতে। নিয়মিতভাবে গাড়ি ছাড়ছেন এসব স্বেচ্ছাসেবীরা।
তাদের মধ্যে একজন তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থী সাইমুম হোসেন। শরীরে সাদা টিশার্ট, পরনে জিন্স ও হাতে ছোট লাঠি নিয়ে তিনি ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করছেন। সাইমুম বলেন, কোথাও পুলিশ নেই। আমরা যেহেতু একটা জঞ্জাল দূর করেছি, এই ট্রাফিক জ্যামও দূর করতে পারব।
মিরপুর-১০ নম্বরেও দেখা গেছে একই রকম চিত্র। সেখানে লাঠি হাতে দুই মিনিট পর পর বিভিন্ন পাশের গাড়ি ছাড়ছেন বেশ কয়েকজন তরুণ। বাইক চালকদের মাথায় হেলমেট না থাকলে অনুরোধ করছেন যেন, পরবর্তী সময়ে হেলমেট ব্যবহার করেন। রিক্সা চালকদের সারিবদ্ধভাবে একপাশে দাঁড় করিয়ে রেখেছেন।
এ বিষয়ে কথা হয় ঢাকা পলিটেকনিক ইনস্টিটিউটের ছাত্র রেজাউনুল রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, ‘বেলা ১১টা থেকে আমরা ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণ করা শুরু করি। আমাদের সঙ্গে বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থী রয়েছেন। আমাদের অভিজ্ঞতা কম এ বিষয়ে। তবু নিজেদের মধ্যে এ ও বি পদ্ধতি দাঁড় করিয়ে সড়ক নিয়ন্ত্রণ করেছি।’
ট্রাফিক নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি মিরপুর-১০নং গোল চত্বরে দাঁড়িয়ে রাষ্ট্রীয় সম্পদ নষ্ট না করারও আহ্বান জানানো হচ্ছে। সেইসঙ্গে পাড়া-মহল্লায় কেউ যেন আক্রমণের শিকার না হন, সে বিষয়ে সবাইকে কাজ করারও আহ্বান জানাচ্ছেন তারা।
এ বিষয়ে জানতে ঢাকা মেট্রোপলিটন পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার (ট্রাফিক) মো. মুনিবুর রহমানসহ ট্রাফিক বিভাগের একাধিক কর্মকর্তার সঙ্গে যোগাযোগ করেও তাদের পাওয়া যায়নি।
তবে না প্রকাশে অনিচ্ছুক ডিএমপির এক ট্রাফিক সার্জেন্ট বলেন, আমাদের সিনিয়র কর্মকর্তাসহ বেশিরভাগ সদস্য হাসিনা সরকারের অনুগত ছিল। তারা সরকারের চাহিদামতো কাজ করছে, দুর্নীতি করছে। যার ফলে পরিস্থিতি পুরোপুরি স্বাভাবিক না হলে দায়িত্ব পালনে জীবনের শঙ্কা রয়েছে।
শিক্ষার্থীদের এমন ভূমিকায় খুশি নগরবাসী। মিরপুর-১০ নম্বরের যাত্রী কাজী কামাল হোসেন বলেন, ট্রাফিক পুলিশের থেকে ভালো ভূমিকা পালন করছে আমাদের সোনার ছেলেরা। এই সোনার ছেলেরা দেশ থেকে যখন স্বৈরাচার দূর করতে পেরেছে ট্রাফিক জ্যাম নিরসনও তারা করতে পারবে। আমি নিয়মিতভাবে এই রুটে যাতায়াত করে থাকি আমার মনে হয় ট্রাফিক পুলিশের থেকে ছাত্ররা ভালো ভূমিকা পালন করছে।
তবে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগের ভয়ে অনেকে ব্যক্তিগত গাড়ি বের করেননি। ইয়ামিন রহমান নামের একজন ব্যবসায়ী জানান, তিনি ব্যবসায়িক কাজে প্রতিদিন ধানমন্ডি থেকে উত্তরায় যান। ব্যক্তিগত গাড়িতে করেই যাতায়াত করেন। চলমান পরিস্থিতি গাড়ি বের করেননি। মঙ্গলবার গাড়ি বের করার কথা চিন্তা করেছেন। কিন্তু সোমবার বিভিন্ন স্থানে ভাঙচুর-অগ্নিসংযোগ দেখে এবং রাতে গুজবের পর মঙ্গলবার গাড়ি বের করতে সাহস হয়নি তার। ফলে সিএনজি ভাড়া করে অফিসে গিয়েছেন।
ঢাকার কূটনীতিকপাড়া পাহারা দিতে দেখা গেছে সেনাসদস্যদের। সাধারণভাবে গুলশান ও বারিধারা জোনে বিদেশী মিশনগুলো এবং বিশেষ বিশেষ রাষ্ট্রদূতদের বাসা পাহারা দেওয়ার দায়িত্ব পুলিশের। কিন্তু সোমবার থেকে ছাত্র-জনতার আন্দোলনকে কেন্দ্র করে অস্থির পরিবেশ তৈরি হলে দায়িত্ব পালন থেকে সরে যান পুলিশ সদস্যরা।
পরে কূটনীতিকরা নিরাপত্তাহীনতা বোধ করে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সঙ্গে যোগাযোগ করলে গুলশান ও বারিধারা জোনের প্রবেশপথগুলোতে পাহারা বসানো এবং নিয়মিত টহলের ব্যবস্থা করে সেনাবাহিনী।
এ বিষয়ে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের এক জ্যেষ্ঠ কর্মকর্তা বলেন, আমরা নিরাপত্তা ব্যবস্থা গ্রহণ করেছি। কূটনীতিক পাড়া এখন আর্মি পাহারা দিচ্ছে। বিদেশী কূটনীতিকদের সঙ্গেও আমরা যোগাযোগ রাখছি।
তবে সোমবার রাজধানীর বিভিন্ন স্থানে সেনাবাহিনীর অবস্থান বা টহল চোখে না পড়লেও গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা ঘিরে নিরাপত্তা ব্যবস্থা জোরদার করতে দেখা গেছে। বিশেষ করে গণভবন, জাতীয় সংসদ ভবন, থানা কম্পাউন্ড, সচিবালয় এলাকায় সেনাবাহিনী মোতায়েন ছিল।
যাত্রাবাড়ী-ধানমন্ডি থেকে সাতজনের লাশ উদ্ধার ॥ সকালে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধু ভবনের সামনে লেকের পাড়ে উঁচু পেভমেন্টে চারটি লাশ পড়ে থাকতে দেখা গেছে।
ইমরান নামে এক পথশিশু জানায়, সোমবার বিকেলে বঙ্গবন্ধু ভবনে ভাঙচুরের সময় সে এখান থেকে ছোট ছোট রড কুড়াতে ঢুকে। তখন হাতে ব্যান্ডেজওয়ালা (চার লাশের একটি) তরুণকে ভেতরে জিনিসপত্র কুড়াতে দেখেছিল। সকালবেলা দেখে, এখানে তার লাশ পড়ে আছে।
সকালে সেখানে আশপাশের মানুষের জটলা দেখা গেছে। তারা বলছিলেন, পুলিশ নেই, লাশ কে উদ্ধার করবে?
শুক্রাবাদের দিক দিয়ে ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে গিয়ে চারদিকে দাউ দাউ করে আগুন জ্বলতে দেখেন প্রত্যক্ষদর্শীরা। তিনি বলেছিলেন, যেখানে শ্রদ্ধা নিবেদন করা হয় সেই প্রতিকৃতি জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। বই বিক্রয়কেন্দ্র ও বাড়ির সবগুলো রুমও জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। অবশিষ্ট আর কিছু নেই, দেওয়াল, জানালা সব পুড়ে যাচ্ছে।
এর আগে বেলা পৌনে ১২টার দিকে যাত্রাবাড়ী থানার সামনে তিনজনের মরদেহ পড়ে থাকতে দেখা গেছে। এর মধ্যে দুজনের মরদেহের ওপরে পুলিশের পোশাক দেখা গেছে। আরেকজনের মরদেহের হাতে হাতকড়া পরানো রয়েছে। মরদেহগুলো ঘিরে শত শত মানুষের জটলা দেখা গেছে। থানার সামনে অন্তত সাত থেকে আটটি পুলিশের গাড়ি পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। পোড়া গাড়ি থেকে বিভিন্ন জিনিস লুট করে নিয়ে যেতে দেখা গেছে মানুষকে। থানার ভেতরেও মানুষজনকে ঢুকতে দেখা গেছে।
যাত্রাবাড়ীর ঘটনার প্রত্যক্ষদর্শী মো. শোয়াইব ঢাকা মেডিক্যাল কলেজ হাসপাতালে বলেন, সোমবার জোহরের নামাজ আদায়ের পর আমরা সবাই যাত্রাবাড়ী থানার সামনে ছিলাম। হঠাৎ পুলিশ আমাদের ওপর গুলি করতে শুরু করে। আমি অন্তত ১০-১৫ জনকে থানার সামনে মরে পড়ে থাকতে দেখি। পরে যখন গোলাগুলি থামে, তখন থানার সামনে পড়ে থাকা লাশগুলো নিয়ে আসি।
সোমবার দিনভর পুলিশ সদর দপ্তরসহ রাজধানী ঢাকার ১৩টি থানায় হামলা, ভাঙচুর, অগ্নিসংযোগ ও লুটপাটের ঘটনা ঘটেছে। এতে মঙ্গলবার কর্মবিরতি পালনের ঘোষণা দিয়েছেন পুলিশ কর্মকর্তারা। রাজধানীর সব কটি থানার গেট বন্ধ দেখে গেছে। ভেতরে কোনো পুলিশ সদস্যদের দেখা যায়নি।