ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৯ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১

প্রধানমন্ত্রীর সফরে অগ্রাধিকার পাবে বাণিজ্য ও অর্থনৈতিক বিষয়

চীনে পোশাক রপ্তানি বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হবে

এম শাহজাহান

প্রকাশিত: ০০:৩০, ৬ জুলাই ২০২৪

চীনে পোশাক রপ্তানি বাড়ানোর  ওপর জোর দেওয়া হবে

.

কয়েক হাজার কোটি ডলারের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনতে চীনে পোশাক রপ্তানি বাড়ানোর ওপর জোর দেওয়া হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফরের সময়েই যাতে বিষয়টি জোরালোভাবে উপস্থাপন করা হয়, সেই চেষ্টা করছেন দেশের গার্মেন্টস খাতের উদ্যোক্তারা। একইভাবে ভারসাম্যপূর্ণ শুল্ক সুবিধা নিশ্চিত করতে মুহূর্তে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তির (ফ্রি ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট-এফটিএ) পরিবর্তে অগ্রাধিকারমূলক বাণিজ্য চুক্তি (প্রিফারেন্সিয়াল ট্রেড অ্যাগ্রিমেন্ট-পিটিএ) করা উচিত বলে মনে করা হচ্ছে। তাড়াহুড়া বা দ্রুত ধরনের চুক্তিতে না গিয়ে বরং আরও সময় নিয়ে এর সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রস্তুত করার তাগিদ দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। আগামী -১১ জুলাই প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা চীন সফরে যাচ্ছেন। তার এই সফরে বাণিজ্য অর্থনৈতিক বিষয়গুলো অগ্রাধিকার পাবে বলে আশা করা হচ্ছে।   লক্ষ্যে অর্থনৈতিক সহযোগিতা জোরদার করতে ১৭টি সমঝোতা স্মারক (এমওইউ) স্বাক্ষর এবং ১৪টি বিষয়ে যৌথ ঘোষণা হতে পারে।

জানা গেছে, বাংলাদেশের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য বিনিয়োগ বাড়াতে প্রায় আট বছর আগে প্রথম চীনের পক্ষ থেকেই এফটিএ করার ব্যাপারে তাগিদ দেওয়া হয়। ওই সময় চীনের পক্ষ থেকে বলা হয়, ধরনের চুক্তি করা গেলে চীনের সঙ্গে বাংলাদেশের বিপুল অঙ্কের বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা সম্ভব হবে। একইভাবে চীনের উদ্যোক্তারা বাংলাদেশে তাদের বিনিয়োগ সম্প্রসারণে আগ্রহী হবেন। এর পরই মূলত দুদেশের মধ্যে আনুষ্ঠানিকভাবে এফটিএ করা নিয়ে আলোচনা শুরু হয়। সম্প্রতি বাংলাদেশ চীনের মধ্যে বাণিজ্য এবং বিনিয়োগ বাড়ানোর লক্ষ্যে এফটিএ সই করার বিষয়ে যৌথভাবে খসড়া সম্ভাব্যতা সমীক্ষা প্রতিবেদন বিনিময় করেছে দুই দেশ। ওই সময় বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের পক্ষ থেকে বলা হয়, আগামী বছরের শেষ নাগাদ কিংবা ২০২৬ সালের শুরুতেই চীনের সঙ্গে এফটিএ করবে সরকার। এরই ধারাবাহিকতায় প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার আসন্ন চীন সফরের সময় এফটিএ চুক্তির বিষয়ে একটি সমঝোতা স্মারক সই হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে। তবে দেশের শিল্পোদ্যোক্তা, বিনিয়োগকারী অর্থনীতিবিদরা বলছেন, চীনের তুলনায় বাংলাদেশের অর্থনীতি খুবই ছোট।

চীন থেকে বেশিরভাগ পণ্য আমদানি করা হচ্ছে, বিপরীতে রপ্তানি হচ্ছে খুবই সামান্য। অবস্থায় দেশটির সঙ্গে মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করার আগে বিষয়টি নিয়ে গভীরভাবে পর্যালোচনা বিশ্লেষণ হওয়া প্রয়োজন। তাদের মতে, আগে চীনে রপ্তানি বাড়ানোর উদ্যোগ নিতে হবে। বিশেষ করে, দেশের প্রধান পণ্য তৈরি পোশাক রপ্তানি বাড়াতে হবে চীনে। শুধুমাত্র হস্তশিল্প পাটজাত পণ্যের মতো কয়েকটি আইটেম বিক্রি করে দেশটির সঙ্গে বাণিজ্য ঘাটতি কমিয়ে আনা সম্ভব নয়।

অন্যদিকে, সুই-সুতা থেকে শুরু করে মূলধনী যন্ত্রপাতি, শিল্পের কাঁচামাল, খাদ্যপণ্যসহ চাহিদার প্রায় সব ধরনের পণ্যসামগ্রী চীন থেকে আমদানি করা হয়। অবস্থায় ইউরোপ, আমেরিকা এমনকি মধ্যপ্রাচ্যে যেসব পণ্য রপ্তানি করা হয় তা যদি চীনেও রপ্তানি হতে পারে সেক্ষেত্রে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য অর্থনৈতিক সম্পর্ক জোরদার হওয়ার সুযোগ রয়েছে। প্রসঙ্গে পোশাক খাতের শীর্ষ সংগঠন বিজিএমইএ সাবেক সভাপতি ফারুক হাসান জনকণ্ঠকে বলেন, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার এবারের চীন সফর অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। দেশের অবকাঠামো খাত উন্নয়নে চীনের অবদান দিন দিন বাড়ছে। একই সঙ্গে দেশের প্রধান আমদানিকারক দেশ হচ্ছে চীন। তবে বাণিজ্য ঘাটতি কমাতে হলে দেশটিতে আমাদের রপ্তানি বাড়াতেই হবে। বিশেষ করে সেখানে তৈরি পোশাক রপ্তানির সুযোগ রয়েছে। তিনি বলেন, বিশ্বের গার্মেন্টস পণ্যের রপ্তানিকারক দেশ হিসেবে চীন প্রথম হলেও সেখানেও বিপুল পরিমাণ পোশাকের চাহিদা রয়েছে। সেখানে এখন উচ্চ দামের পোশাক তৈরি করে সারাবিশ্বে রপ্তানি করা হচ্ছে। উৎপাদন খরচ বেড়ে যাওয়ায় সেখানকার উদ্যোক্তারা ধীরে ধীরে ছোট ছোট শিল্প থেকে বেরিয়ে আসছেন। তারা এখন উচ্চ দামের পণ্য তৈরি করে বিক্রি করছে।

ফলে এসব জায়গায় আমাদের রপ্তানি বাড়ানোর সুযোগ রয়েছে। জাপানের মতো চীনে প্রতিবছর পোশাক রপ্তানি বাড়ছে। এটা আরও বাড়াতে হবে। তিনি বলেন, মুহূর্তে চীনের সঙ্গে এফটিএ না করে বরং পিটিএ করার দিকে এগিয়ে যেতে হবে। চীন ৯৭ শতাংশ পণ্যের শুল্কসুবিধা দিলেও এগুলো আসলে কোনো কাজে আসছে না। চীন থেকে সবকিছু আমদানি করা হয়। কিন্তু আমাদের রপ্তানি সেই অর্থে নেই। অবস্থায় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি হলে তারাই (চীন) সবচেয়ে বেশি লাভবান হবে। আমাদের শিল্পগুলো চরম প্রতিযোগিতার সম্মুখীন হবে। এমনকি সরকারের রাজস্ব আয় কমার ঝুঁকি রয়েছে। কিন্তু পিটিএ হলে আমাদের পণ্যগুলো নিয়ে বেশি কথা বলার সুযোগ থাকবে।

প্রসঙ্গে এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি মোঃ জসিম উদ্দিন বলেন, এফটিএ করার জন্য আমাদের বিদ্যমান নীতিমালা আগে সংস্কার করা দরকার। এফটিএ হলে পলিসির কারণে ব্যবসা-বাণিজ্য যাতে বাধাগ্রস্ত না হয়, তা নিশ্চিত করতে হবে।

আন্তর্জাতিক বাণিজ্য বিশ্লেষক মোস্তফা আবিদ খান মনে করেন, উন্নয়নশীল দেশ হলে, একপক্ষীয় সুবিধা আমরা পাব না। তখন আমরা কারও কাছে কিছু পেতে গেলে, তাকেও ছাড় দিতে হবে। কিন্তু, সার্বিকভাবে এফটিএ করার জন্য যে ধরনের বাণিজ্য বা বিনিয়োগ সহায়ক নীতি দরকার, তা এখনো হয়নি। দেশের রপ্তানি পণ্যের সংখ্যা আরও বাড়াতে হবে। 

জানা গেছে, চীনের সঙ্গে বর্তমান বাণিজ্য ঘাটতি হাজার ৪০০ কোটি ডলারের বেশি। প্রতিবছর চীন থেকে ২৫ বিলিয়ন ডলারের আমদানি হলেও বিপরীতে রপ্তানি হয় বিলিয়ন ডলারের কম পণ্যসামগ্রী। অবস্থায় মুক্ত বাণিজ্য চুক্তি করা হলে দেশের শিল্প খাত কঠিন পরিস্থিতিতে পড়ার আশঙ্কা রয়েছে বলে মনে করা হয়। চীনের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ কয়েকটি বিষয়ে গুরুত্ব দিচ্ছে জানিয়ে সংশ্লিষ্টরা বলেন, চীন থেকে বাংলাদেশ বছরে যে পরিমাণ পণ্য আমদানি করে তা থেকে বিপুল পরিমাণ শুল্ককর পায় সরকার। এফটিএ হলে খাত থেকে রাজস্ব আয় কমে যাওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। আবার, চীন থেকে আমদানি করা পণ্যের দাম অনেক কম হওয়ায় বাংলাদেশে ওই ধরনের পণ্য উৎপাদক প্রতিষ্ঠানগুলো ক্ষতিগ্রস্ত হতে পারে। অন্যদিকে সম্ভাবনার হাতছানিও রয়েছে বাংলাদেশের সামনে। কারণ, চীনে উৎপাদন খরচ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে। দেশটি অন্য দেশে বিনিয়োগ কারখানা স্থাপন করছে। বাংলাদেশেও চীনের ব্যাপক বিনিয়োগ সম্ভাবনা আছে।

চীন বাংলাদেশে বিনিয়োগ করে উৎপাদিত পণ্য চীনে নিলে নিজের দেশের বাজারের চাহিদা মেটানোর সুযোগও তৈরি হবে। এতে বাংলাদেশে বিপুল কর্মসংস্থান সৃষ্টি, প্রযুক্তি স্থানান্তর হওয়ার সুযোগ সৃষ্টি হবে বলে মনে করা হয়। বাংলাদেশ ট্রেড অ্যান্ড ট্যারিফ কমিশন চীনের সঙ্গে এফটিএ স্বাক্ষরের প্রভাব নিয়ে প্রতিবেদন তৈরির কাজ করছে বলে জানা গেছে। প্রসঙ্গে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, শুল্কমুক্ত রপ্তানি সুবিধার পাশাপাশি বিনিয়োগ আকর্ষণ, প্রযুক্তি সহায়তা নিশ্চিত করার ওপর দৃষ্টি রেখে ২০২৬ সালে এলডিসি উত্তরণ পরবর্তী বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ভবিষ্যৎ সুরক্ষিত করার জন্য বহুমুখী বাণিজ্য কৌশল অনুসরণ করছে সরকার। এরই অংশ হিসেবে চীনের সঙ্গে এফটিএ বা পিটিএ করা হতে পারে। নিয়ে আরও পর্যালোচনা বিশ্লেষণের প্রয়োজন। তবে রিসার্চ অ্যান্ড পলিসি ইন্টিগ্রেশন ফর ডেভেলপমেন্টের (্যাপিড) চেয়ারম্যান অধ্যাপক এমএ রাজ্জাক বলেন, বাংলাদেশের ম্যান-মেড ফাইবারে বিপুল বিনিয়োগ প্রয়োজন, যেখানে চীন বিশ্বে শীর্ষস্থানে রয়েছে। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রসহ সারাবিশ্বে রপ্তানিতে চীন প্রতিকূলতার সম্মুখীন হচ্ছে। কারণে এদেশে গার্মেন্টস বহির্ভূত খাতেও বিনিয়োগ করতে পারে চীন।

জানা গেছে, চীনা কোম্পানিগুলো বাংলাদেশে আইসিটি, টেক্সটাইল, অটোমোবাইল, চামড়া, পাটজাত, খাদ্যপণ্য এবং সোলারসহ ২৫টি সম্ভাবনাময় খাতে বিনিয়োগ করতে আগ্রহী। বাংলাদেশ চীনের কাছে ৫০০ কোটি ডলার বাজেট সহায়তা এবং ২০০ কোটি ডলারের বাণিজ্য সহায়তা চেয়েছে। প্রধানমন্ত্রীর সফরের সময় এসব অনুরোধের বিষয়ে চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত হতে পারে। বাজেট সহায়তার ৫০০ কোটি টাকা ইউয়ানে পরিশোধ করতে পারে চীন। এর ফলে আমদানির বিপরীতে চীনের ইউয়ান ব্যবহার করতে পারবেন উদ্যোক্তারা। ২০১৮-১৯ থেকে ২০২৩ সালের জুনের শেষ পর্যন্ত বাংলাদেশে চীনের নিট বিদেশী প্রত্যক্ষ বিনিয়োগের (এফডিআই) পরিমাণ প্রায় ২০০ কোটি ডলার। এর বেশিরভাগই বিদ্যুৎ খাতে।

আর উল্লেখযোগ্য কিছু বিনিয়োগ রয়েছে টেক্সটাইল, নির্মাণ এবং অন্যান্য ব্যবসায়ে। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা জুলাই বেজিংয়ে বাংলাদেশ বিনিয়োগ উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (বিডা) এবং বাংলাদেশ সিকিউরিটিজ অ্যান্ড এক্সচেঞ্জ কমিশন (বিএসইসি)-এর আয়োজনে সামিট অন ট্রেড, বিজনেস অ্যান্ড ইনভেস্টমেন্ট অপরচুনিটিজ বিটুইন বাংলাদেশ অ্যান্ড চায়না শীর্ষক দিনব্যাপী সম্মেলনে যোগ দেবেন বলে আশা করা হচ্ছে।

×