ঢাকা, বাংলাদেশ   মঙ্গলবার ০৯ জুলাই ২০২৪, ২৪ আষাঢ় ১৪৩১

এক টাকাও আদায় করতে পারছে না বিতরণ সংস্থা

বিহারি ক্যাম্পে ৮ বছরে বিদ্যুৎ বিল বকেয়া ২০৮ কোটি টাকা

স্বপ্না চক্রবর্তী

প্রকাশিত: ২৩:৩৬, ৫ জুলাই ২০২৪

বিহারি ক্যাম্পে ৮ বছরে  বিদ্যুৎ বিল বকেয়া  ২০৮ কোটি টাকা

.

প্রতিরক্ষা মন্ত্রণালয়, স্থানীয় সরকার মন্ত্রণালয়, বাংলাদেশ পুলিশ, স্বাস্থ্য বিভাগ, পিডব্লিউডিসহ সরকারের নানা দপ্তরের কাছে বিপুল পরিমাণ বকেয়া রয়েছে বিদ্যুৎ বিভাগের। ধাপে ধাপে এসব বকেয়া আদায় করা হলেও বিদ্যুৎ বিভাগের সবচেয়ে বড় গলার কাঁটা হয়ে দাঁড়িয়েছেআটকেপড়া পাকিস্তানিবা বিহারি ক্যাম্পের বাসিন্দারা। এদের কাছে ২০০ কোটি টাকার বেশি বিদ্যুৎ বিল বকেয়া হলেও এক টাকাও আদায় করতে পারছে না বিতরণ সংস্থাগুলো। সরকারি সব সুযোগ-সুবিধা উপভোগ করলেও এর মূল্য দিতে নারাজ ক্যাম্পের বাসিন্দারা। বিশেষ করে বিদ্যুৎ বিল আদায় করতে গেলেই আদায়কারী বিদ্যুৎ কর্মীদের আটকে রেখে আন্দোলনের মতো ঘটনা পর্যন্ত ঘটাচ্ছে তারা। এক দিকে সরকার ভর্তুকি কমাতে বিদ্যুতের দাম বাড়াচ্ছে দফায় দফায়, অপর দিকে গ্রাহকদের কাছে দিনের পর দিন বড় পরিমাণ অর্থ বকেয়া পড়ে থাকছে। তাই বিহারি ক্যাম্পসহ যেসব প্রতিষ্ঠানে বিদ্যুৎ বিলের বড় পরিমাণ অর্থ বকেয়া রয়েছে, সেগুলো আদায় করার তাগিদ দিচ্ছেন বিশেষজ্ঞরা।

আটকেপড়া পাকিস্তানিবলতে সাধারণভাবে বোঝানো হয় সেসব উর্দুভাষীকে, যারা ১৯৭১ সালে মুক্তিযুদ্ধের পর এখানে ক্যাম্পে আশ্রয়ে থেকে পাকিস্তানে চলে যেতে চেয়েছিলেন। যুদ্ধ এবং যুদ্ধোত্তর সময়ে অনিশ্চয়তার মুখে এসব মানুষ শরণার্থীদের জন্য তৈরি অস্থায়ী ক্যাম্পগুলোতে আশ্রয় নিয়েছিলেন। সেই ক্যাম্পগুলো আছে, মানুষও আছে সেখানে। সারাদেশে রকম ক্যাম্প আছে কাগজপত্রে ১১৬টি। ঢাকায় আছে ৪৫টির মতো। সব মিলিয়ে এসব ক্যাম্পে থাকা উর্দুভাষীর সংখ্যা প্রায় আড়াই লাখ। এই ক্যাম্পবাসীর বাইরেও দেশে উর্দুভাষী আছেন। তাদের সংখ্যা ক্যাম্পের উর্দুভাষীদের চেয়েও বেশি। প্রায় তিন-চার লাখ।

এদের বেশিরভাগই বছরের পর বছর বিদ্যুৎ বিল না দিয়েই বিদ্যুতের সব সুযোগ-সুবিধা ভোগ করছেন। বিলের জন্য সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে হামলার শিকার হতে হয় বিদ্যুৎ কর্মীদের। এই ভয়ে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে যান না তারা। অপরদিকে উর্দুভাষীরা বলছেন, তাদের বিদ্যুৎ বিল আগে দিত বিদেশী সংস্থা। ২০১৬ সাল থেকে তাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দেওয়া হয়। এরপর থেকে বিদেশী সংস্থাগুলো আর বিদ্যুৎ বিল দিচ্ছে না। কারণে এই বিল বকেয়া পড়েছে। তাদের কিছু দাবি-দাওয়া রয়েছে। সেগুলো পূরণ না হওয়ায় তারা বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করছেন না।

ঢাকা ইলেক্ট্রিক সাপ্লাই কোম্পানি লিমিটেডের (ডেসকো) তথ্যমতে, রাজধানীর মোহাম্মদপুর মিরপুরের ৪৫ বিহারি ক্যাম্পের ৯৬ মাসে (আট বছর) মোট বকেয়া দুইশআট কোটি ৬৫ লাখ ৩৩ হাজার ৬৪০ টাকা। যার মধ্যে এক টাকাও আদায় করতে পারেনি বিদ্যুৎ বিভাগ।

এদিকে বিদ্যুতের বকেয়া বিল আদায়ে জোর দিয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। বিভিন্ন সময়ে তিনি বকেয়া আদায়ের বিষয়ে বলেছেন, আমার কাছেও বিল বকেয়া থাকলে ব্যবস্থা নিতে হবে। সরকারি-বেসরকারি অফিসের হাজার হাজার কোটি টাকা বিল বকেয়া রাখা যাবে না। আদায় করতে হবে। নইলে কাটতে হবে সংযোগ। কিন্তু সরকারপ্রধানের এমন বক্তব্যের পরও বিহারি ক্যাম্পগুলোর বিদ্যুৎ বিল আদায় করা যাচ্ছে না জানিয়ে নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক বিদ্যুৎ বিভাগের এক কর্মকর্তা জনকণ্ঠকে বলেন, মোহাম্মদপুরে জেনেভা ক্যাম্প, মার্কেট ক্যাম্প, সিআরও ক্যাম্প, টাউন হল ক্যাম্পসহ ছয়টি ক্যাম্প রয়েছে। এখানে বিদ্যুৎ বিল বকেয়া পড়েছে প্রায় ১০০ কোটি টাকা। ওপর থেকে সংযোগ বিচ্ছিন্ন করার নির্দেশ আছে। কিন্তু বিহারিদের তীব্র আপত্তির মুখে তা সম্ভব হয় না। লাইন কাটতে গেলেই তারা গণ্ডগোল শুরু করে। রাস্তা অবরোধ করে। এত টাকা বকেয়া। তবুও কিছু করা যাচ্ছে না।

মিরপুরের ক্যাম্পগুলোতে বিদ্যুৎ সরবরাহকারী সংস্থা ডেসকো জানায়, ২০১৬ সালের পর মিরপুরের ৩৯টি ক্যাম্প থেকে এক টাকাও বিদ্যুৎ বিল পাওয়া যায়নি।

জানা যায়, জেনেভা কনভেশন অনুযায়ী হাইকোর্টে ২০০৮ সালের ঘোষিত এক রায়ে বিহারিদের বাংলাদেশে ভোটার হওয়ার পাশাপাশি জাতীয় পরিচয়পত্র (এনআইডি) পাওয়ার সুযোগ তৈরি করে দেয়। সেই থেকেআটকেপড়া পাকিস্তানিপরিচয় কাটিয়ে দেশের মূলধারায় অন্তর্ভুক্ত হওয়ার পথ প্রশস্ত হলেও এত বছরেও বিহারি পরিচয় থেকে তারা বের হতে পারেননি। ২০১৬ সাল পর্যন্ত দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ত্রাণ মন্ত্রণালয়ই এসব ক্যাম্পের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করে এসেছে। কিন্তু যেহেতু তাদের এখন স্বাধীনভাবে কাজ করে উপার্জনের ব্যবস্থা করে দেওয়া হয়েছে, তাই মন্ত্রণালয় থেকে আর তাদের বিদ্যুৎ বিল পরিশোধ করা হবে না মর্মে সিদ্ধান্ত হয়। যার যার বিল তাকেই পরিশোধ করতে হবে।

ঘরে ঘরে মিটার না থাকায় ডেসকো কিংবা ডিপিডিসির বিহারি ক্যাম্প থেকে বিদ্যুতের বকেয়া আদায় করতে কিছুটা সমস্যা হচ্ছে জানিয়ে পাওয়ার সেলের মহাপরিচালক মোহাম্মদ হোসাইন জনকণ্ঠকে বলেন, ২০১৬ সাল থেকেই এসব ক্যাম্পে বিদ্যুতের বিল বকেয়া রয়েছে। বিষয়টি নিয়ে ২০১৮ সালে বড় ধরনের সমস্যার সৃষ্টি হয়। বিপণন সংস্থা ক্যাম্পগুলোর বিদ্যুৎ সংযোগ বিচ্ছিন্ন করতে গেলে তাদের পাল্টা আক্রমণ করে সেখানকার বাসিন্দারা। তাদের সঙ্গে আলোচনা করে একটা সমাধানে আসতে হবে। সেটির ব্যবস্থা করা হবে শীঘ্রই।

এসব বিষয় নিয়ে উর্দু স্পিকিং পিপলস ইয়ুথ রিহ্যাবিলিটেশন মুভমেন্টের (ইউএসপিওয়াইআরএম) কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদাকাত খান ফাক্কু সাংবাদিকদের বলেন, আমাদের বিদ্যুৎ বিল তো বাংলাদেশ সরকার দিত না, দিত বৈদেশিক সংস্থা। ২০১৬ সাল থেকে আমাদের জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে এই সেবা বন্ধ করে দেওয়া হলো। একটা জাতীয় পরিচয়পত্র দিয়ে আমাদের কী লাভ হয়েছে? আমরা তো কিছু পাইনি। আমাদের কিছু দাবি আছে। সেগুলো পূরণ করতে হবে। বকেয়া বিল আমরা দেব না। এটা ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের বিষয়। আমরা কেন এই বিল দেব?

তবে বছরের পর বছর এই বিল পরিশোধ করে আসলেও বর্তমানে দুর্যোগ ত্রাণ মন্ত্রণালয় বলছে, এখন আর তারা এই বিল পরিশোধ করবে না। এতদিন মানবিক কারণে বিদ্যুৎ বিল দিয়ে আসলেও এই ঘানি আর টানতে চায় না মন্ত্রণালয়।

মন্ত্রণালয়ের এক কর্মকর্তা জানান, যে শর্তে বিহারি ক্যাম্পের বিদ্যুৎ বিল এতদিন পরিশোধ করা হয়েছে, সেই অবস্থার পরিবর্তন হয়েছে। এখন যেহেতু তারা বাংলাদেশের ভোটার তাই তাদের নিজেদের বিদ্যুৎ বিল নিজেদেরই দিতে হবে। মন্ত্রণালয় আর দেবে না।  বিষয়ে কোর্টের রায় রয়েছে। এখন শুধু প্রয়োজনীয় না, তারা লেদ মেশিনসহ বিভিন্ন ব্যবসায়িক কাজে বিদ্যুৎ ব্যবহার করছে। তাই এত টাকা তো আর মন্ত্রণালয় বহন করতে পারে না। এমন পরিস্থিতিতে বিপুল পরিমাণ এই বকেয়া আদায় অনেকটাই অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে বলে মনে করছেন সংশ্লিষ্টরা।

×